ক্ষুদ্র স্বার্থে এই খুন ইতিহাস ক্ষমা করবেনা
পুরুষোত্তম রায় বর্মন
সরকারি কাগজে বয়স ৭৬। প্রকৃত বয়স আশির কম নয়। ছোট ভাই জানালো, আমার বয়স ৭৫ / ৭৬। দাদা আমার চাইতে তিন চার বছরের বড় হবে। অশীতিপর শহীদ মিঞাকে ৩০শে নভেম্বর বেলা দুটো নাগাদ চড়িলামে জাতীয় সড়কের উপর আরক্ষা বাহিনীর সামনে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত পিটিয়ে খুন করেছে। দুর্বৃত্তরা লাঠি ও রড দিয়ে আঘাত করে ৮০ বছরের বৃদ্ধের মাথার ঘিলু বের করে দিয়েছে। বৃদ্ধের হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। বৃদ্ধ চিৎকার করছিল , তোরা আমাকে মারবি না। আমরা আজ গিয়েছিলাম চড়িলাম উত্তরমুড়া গ্রামে শহীদ মিঞার বাড়িতে। এলাকাবাসী জানালো, অজাতশত্রু ছিলেন তিনি। নিপাট ভদ্রলোক। বামপন্থায় বিশ্বাস নিয়ে চলতেন । দলের সভায় যেতেন এবং সভায় মনোযোগী শ্রোতা। শুরু থেকে শেষ অব্দি নেতাদের বক্তৃতা শুনতেন। ৩০ তারিখ ও বেরিয়েছিলেন দুপুরবেলায় চড়িলাম বাজারে দলের সভায় যোগ দিতে। পুলিশের অনুমতি নিয়ে সভার কর্মসূচি ছিল। তারপর যা হয়েছে তা রাজ্যবাসীর অজানা নয়। তিন চারশো জন দুর্বৃত্ত বাহিনী পুলিশের সামনে সশস্ত্র অবস্থায় হামলা করে সবার উপর। তাদেরই হামলায় শহীদ মিঞা খুন হয়। অনেকেই গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ রাজ্যে বিরোধী দলের কর্মসূচি যেখানেই থাকে সেখানেই শাসকদলের সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা অবধারিতভাবে হামলা চালাবে, পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। ৮০ বছরের একজন প্রবীণ নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যার দায় রাজ্য সরকার, পুলিশ প্রশাসন কোনভাবেই এড়াতে পারেনা । সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা খুন করেছে এবং সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের খুনের অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন ও সরকার । রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে বিরোধী দলের সভায় যোগদান করার তথাকথিত অপরাধে একজন বৃদ্ধকে নৃশংস মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। তারপরও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য হোমরা চোমড়ারা একটি নিন্দা বাক্যও ব্যয় করেননি। বরং তাদের বক্তব্যে পরোক্ষভাবে দুষ্কৃতিকারীদের আড়াল করা হয়েছে ও প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কোথায় আছি আমরা। এই রাজ্যে আইনের শাসন নেই। সংবিধান প্রদত্ত সবগুলো মৌলিক অধিকার এখানে বিপন্ন। আরক্ষা বাহিনী নির্লজ্জভাবে আইনি দায়িত্ব ভুলে নির্লজ্জভাবে দলদাসে অধ:পতিত। বিরাজমান চরম নৈরাজ্যে দুর্বৃত্তরা চরম পৈচাশিকতায় প্রবীণ নাগরিকের দেহ ছিন্ন ভিন্ন করে। রাজপথে গণতন্ত্র দুর্বৃত্তদের বুটের নিচে হাঁসফাঁস করে। এখন অব্দি প্রকৃত অপরাধী একজনকেও ধরা হয়নি। শহীদ মিঞার তিন ছেলের সাথে কথা হল। দুই ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। আরেক ছেলে বেসরকারি গাড়ির চালক। তিন মেয়েই বিবাহিত। একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। জমি জমা বলতে কিছুই নেই। বিচার পাওয়া খুব কঠিন। ব্যবস্থাটাই ন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে ক্রমশ বেশি করে। দুর্বৃত্তরা বনভোজনে -পান ভোজনে উল্লাসে চামুন্ডা নৃত্যরত। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে হবে শহীদ মিয়ার খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করার প্রশ্নে। ভয়াবহ রাজনীতির সন্ত্রাসের হোতাদের জনবিচ্ছিন্ন করার দৃঢ় শপথে। ত্রিপুরা হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন এই লড়াইয়ে শহীদ মিনার পরিবারের পাশে থাকবো। এই প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়ে এসেছি আজ। শহীদ মিয়ার মৃত্যুর জন্য সরকারকে দশ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। না দিলে আইনী লড়াই শুরু হবে। শহীদ মিয়ার পরিবারের পাশে আরো দৃঢ়ভাবে থাকা দরকার। শুধু শোক ও সমবেদনা প্রকাশই যথেষ্ট নয় । এই পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করাও জরুরী । এই কাজটা কিন্তু এখনো যাদের করার কথা তারা করে উঠতে পারেননি। শহীদ মিয়ার পারলৌকিক কাজকর্ম ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্যে সম্পন্ন হচ্ছে। নাগরিক সমাজের ও দায়িত্ব আছে । শহীদ মিয়ার মৃত্যু আমাদের চৈতন্যে আঘাত করুক সজোরে। সন্ত্রাসের ভারি চাদর ত্রিপুরার বুক থেকে সরাতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এখন সবচাইতে জরুরী প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে দলের ঝান্ডা না দেখে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। একটাই লক্ষ্য ত্রিপুরাকে দু:শাসন মুক্ত করা। যারা এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবেন ক্ষুদ্র স্বার্থে তাদেরকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।