ইতিহাস ও লোকশ্রুতির আলোকে কাঁচাকান্তি
পান্নালাল রায়
কাছাড়ের কাঁচাকান্তি দেবীর মন্দির ঘিরে পুণ্যার্থীদের প্রবল আগ্ৰহের পাশাপাশি এর ইতিহাস নিয়েও কৌতুহল কম নয়।প্রাপ্ত ঐতিহাসিক সূত্রে বলা হয়েছে যে কাছাড়ে ষোড়শ শতকের কোচ রাজত্বের সাক্ষ্য বহন করছে দেবী কাঁচাকান্তি। আবার এমনও কেউ কেউ বলেন,অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ডিমাছা বা কাছাড়ি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কাঁচাকান্তি দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।কাছাড়ে কাঁচাকান্তি দেবীর পূজা প্রচলনের আলোচনার সূত্রে এসে যায় ত্রিপুরার প্রসঙ্গও।ডিমাছাদের আগে কোচ এবং কোচদেরও আগে ত্রিপুরার রাজার অধীনে ছিল সমতল কাছাড়।
শিলচর শহর থেকে কুম্ভিগ্ৰাম বিমানবন্দরে যাবার পথেই উদারবন্ধ। সেখানেই কাঁচাকান্তি মায়ের মন্দির। বিমানবন্দরগামী মূল সড়ক থেকে একটি শাখা সড়ক চলে গেছে মন্দিরের পাশ দিয়ে। দেবীর পূজা কিংবা দেবীর প্রতিষ্ঠা যেমন প্রাচীনকালের, বর্তমান মন্দিরটি কিন্তু তেমন নয়। নতুন মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে প্রায় সাড়ে চার দশক আগে।তার আগে সেখানে টিনের বেড়া দেয়া ছোট একটি চারচালা ঘর ছিল। হয়তো তার আগেও দেবীর স্হানের অস্তিত্ব ছিল সেখানে কিংবা কাছাকাছি অন্য কোথাও।
এবার কাঁচাকান্তি দেবীর প্রতিষ্ঠা সূত্রে সমতল কাছাড়ে কোচ রাজত্বের কথায় আসা যাক। একসময় সমতল কাছাড় ত্রিপুরার অধীনে ছিল। কিন্তু ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি কাছাড়ে ত্রিপুরার আধিপত্য লুপ্ত হয়।এক ভীষণ যুদ্ধে কোচদের কাছে ত্রিপুরার রাজা পরাজিত হন। উপেন্দ্র চন্দ্র গুহ তাঁর সুবিখ্যাত গ্ৰন্হ 'কাছাড়ের ইতিবৃত্ত'-তে বলেছেন -"...কথিত আছে যে লঙ্খাই নামক স্থানে চিলারায়ের সহিত ত্রিপুরা রাজের এক ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে সৈন্যাধ্যক্ষ ভীমবল পাত্র ও এক তৃতীয়াংশ কোচ সৈন্য প্রাণত্যাগ করে এবং ত্রিপুরা রাজ১৮০০০ সৈন্য সহ নিহত হন।যুদ্ধাবসানে ত্রিপুরা ও কোচ রাজ্যের যে সীমা নির্দ্ধারিত হয় তাহাতেই কাছাড় হইতে ত্রিপুরার আধিপত্য একেবারে লোপ হইয়া যায়।..." অসমের ইতিহাসেও রয়েছে,চিলারায় চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং রাজাকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে আঠারো হাজার সৈন্য সহ ত্রিপুরার রাজা নিহত হন।
ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি কোচদের সঙ্গে ত্রিপুরার এই যুদ্ধের বিবরণ কিন্তু ত্রিপুরার ইতিহাস বা 'রাজমালা'-তে পাওয়া যায় নি। যদিও পঞ্চদশ শতক থেকেই মোটামুটি ভাবে ত্রিপুরার একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আমরা 'রাজমালা'-তে পেয়ে যাই, কিন্তু তাতে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে কোচদের যুদ্ধজয়ের কথা নেই। হয়তো ত্রিপুরার রাজার পরাজয়ের ঘটনা সচেতন ভাবেই 'রাজমালা'তে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই সূত্রে ত্রিপুরার পরবর্তী ইতিহাসেও তা স্হান পায়নি। কিংবা তেমনটা আদৌ ঘটেনি। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন বিজয় মানিক্যের(১৫৩২-৬৩ খ্রীঃ) রাজত্বকালের পর ত্রিপুরার কোনো দুর্বল রাজার সময়ে এমনটা ঘটে থাকতে পারে। Sir EDWARD GAIT তাঁর A History of Assam গ্ৰন্হটিতে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে কোচদের যুদ্ধজয়ের কথা উল্লেখ করেও বলেছেন এর ঐতিহাসিক ভিত্তি পর্যাপ্ত নয়।
'রাজমালা'-তে রয়েছে হেড়ম্ব অর্থাৎ প্রাচীন কাছাড় রাজ্যের রাজকন্যার সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা ত্রিলোচনের বিবাহের কথা। সেটা মহাভারতের সময়কার কথা।তারও অনেক অনেক পরে হেড়ম্ব ও ত্রিপুরার রাজার মধ্যে যুদ্ধের কাহিনী জানায় 'রাজমালা'। তারপর ত্রিপুরার রাজারা ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ দিকে সরে আসেন। ঐতিহাসিক কৈলাস চন্দ্র সিংহ তাঁর সুবিখ্যাত গ্ৰন্হ 'রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস'-এ বলেছেন, ত্রিপুরা ও কাছাড় রাজবংশ একই আদি পিতা হতে উদ্ভুত। কৈলাস চন্দ্র সিংহ বলেছেন,ত্রিপুর বংশীয় গণ দক্ষিণ দিকে রাজ্য বিস্তারে যত্নবান ছিলেন। তারা ক্রমে ক্রমে উত্তর কাছাড় থেকে মধ্য কাছাড় এবং সেখান থেকে দক্ষিণ কাছাড় হয়ে কৈলাসহরের দিকে গিয়েছিলেন।
সেসব অবশ্য অনেক অনেক আগেকার কথা।এর সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বললে ভুল বলা হবে না। তবে পঞ্চদশ শতকের পর থেকে আমরা মোটামুটি ত্রিপুরার যে এক ধারাবাহিক ইতিহাস পাই তাতে কুকি রাজা, আরাকান, গৌড়বঙ্গ এবং মোগলদের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজাদের যুদ্ধের কথা থাকলেও কোচদের সঙ্গে ত্রিপুরার যুদ্ধের বিবরণ নেই।
যাইহোক, আবার কাছাড়ে কোচ রাজত্ব এবং সেই সূত্রে কাঁচাকান্তি দেবীর প্রতিষ্ঠার কথায় আসা যাক। 'কাছাড়ের ইতিবৃত্ত' সূত্রে জানা যায় সমতল কাছাড় ত্রিপুরার রাজার কাছ থেকে অধিকার করে নেয়ার পর কোচরাজা নরনারায়ণের আদেশে সেনাপতি চিলারায় ব্রক্ষ্মপুরে(খাসপুর) একদল সৈন্য রেখে ফিরে যান। তখন ব্রক্ষ্মপুরে শাসনকর্তা হয়ে আসেন কোচরাজার অপর এক ভাই গোহাই কমল বা কমল নারায়ণ। এভাবেই কাছাড়ে কোচ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা। রাজধানী খাসপুর।কেউ কেউ বলেছেন কোচদের রাজপাটের পর নাম হয়েছিল কোচপুর,তা থেকেই হয়েছে খাসপুর। রাজা কমল নারায়ণ খুবই ধার্মিক ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যে ব্রাক্ষ্মণ এনে দেবদেবীর পূজার ব্যবস্হা করেন। 'কাছাড়ের ইতিবৃত্ত'-তে উল্লেখ করা হয়েছে যে সেসময় কাছাড়ের থালিগ্ৰামে শ্যামা,উদারবন্দে কাঁচাকান্তি(কাঁচাখাউরী),রণবাউলী,আন্ধেরি,চান্দাই,মাল,ভৈরব স্হাপিত ছিলেন। মহামারীর ভয়ে কাঁচাকান্তি দেবীর পূজার্চনা হতো। দেবীর সামনে নরবলিও দেয়া হতো। যাইহোক,কাছাড়ে কোচ রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। কাছাড়ের সমতল অঞ্চলে ক্রমে ক্রমে কাছাড়ী তথা ডিমাছাদের আধিপত্য কায়েম হতে থাকে।আর খাসপুর সহ সন্নিহিত কিছু অঞ্চল কোচ সেনাপতির বংশধর গণ শাসন করতে থাকেন। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে খাসপুর সহ সমতল কাছাড় পুরোপুরি কাছাড়ীদের নিয়ন্ত্রণে আসে।মাইবং পরিত্যাগ করে রাজধানী তখন খাসপুর।এক সেনাপতির হাতে অর্পিত হয় উত্তর কাছাড়ের শাসনভার।
কোচ রাজত্বে কাঁচাকান্তি দেবীর প্রতিষ্ঠার কথা জানা গেলেও অপর একটি সূত্রে অন্য কথাও বলা হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কাছাড়ী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কাঁচাকান্তি দেবীর প্রতিষ্ঠার জন্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন।তারপর স্বপ্নাদিষ্ট দেবীর রূপ নিয়ে পণ্ডিত সোনারাম শর্মা দেশমুখ্যের সঙ্গে আলোচনা করে ১৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের চতুর্ভুজা সুবর্ণ বিগ্ৰহ গড়িয়ে রাজা তা উদারবন্দের গভীর জঙ্গলে স্হাপন করেন। সেই থেকে পণ্ডিত দেশমুখ্য নির্দিষ্ট বিধি অনুসারেই কাঁচাকান্তি মায়ের পূজা চলে আসছে। কিন্তু কোথায় গেল দেবীর সেই সুবর্ণ বিগ্ৰহ? তাতেও আছে কাহিনি। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৭৮০-১৮১৩ খ্রী) একবার নাকি জয়ন্তিয়ার রাজা ভ্রমণে এসেছিলেন কাছাড়। তিনি দেবীর সুবর্ণ বিগ্ৰহ দেখে আকৃষ্ট হয়ে দেবীকে তাঁর রাজধানীতে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্র জয়ন্তিয়ারাজকে বিগ্ৰহটির পরিবর্তে সমপরিমাণ স্বর্ণ দিতে চান। জয়ন্তিয়ারাজ কিন্তু তখন কাছাড়রাজের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে নিজ রাজ্যে ফিরে যান।পরে তিনি কয়েকজন অশ্বারোহী পাঠিয়ে বিগ্ৰহটি অপহরণ করিয়ে নিয়ে যান জয়ন্তিয়ায়। সেই রাত্রেই দেবী কাছাড়রাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানান, তিনি এখন জয়ন্তিয়া রাজ্যে আছেন। কিন্তু তাঁর মুখ থাকবে কাছাড়ী রাজ্যের দিকে। তাঁকে পাওয়ার চেষ্টা না করে পূজার্চনা যেন আগের মতোই চালিয়ে যাওয়া হয়।দেবী আরও জানান যে, তিনি জয়ন্তিয়ায় চলে যাওয়ায় কাছাড়ের কোনো অমঙ্গল হবে না।
কাঁচাকান্তির সুবর্ণ বিগ্ৰহ অপহরণের পর দীর্ঘদিন মায়ের বেদীতে একটি খড়্গ পুঁতে পূজার্চনা চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি গড়িয়ে পূজা হতে থাকে। আরও পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয় সিমেন্টের বিগ্ৰহ। বর্তমানে কাঁচকান্তি মায়ের এই বিগ্ৰহতেই চলে আসছে পূজার্চনা। দেবীর নাম নিয়েও আছে নানা কথা।কেউ বলেন কাঁচা খাউরী থেকে এসেছে কাঁচাকান্তি।কেউ বলেন কেছাই খাতি গোসানী থেকে এসেছে কাঁচাকান্তি। ঐতিহাসিক সূর্য কুমার ভূঞা 'কেঁচাই খাঁতী গোঁসানী' বলে উল্লেখ করেছেন কাঁচাকান্তি দেবীকে।বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ দেবব্রত দত্ত বলেছেন,কাছাড়ীদের আরাধ্যা দেবী ছিলেন কেছাই খাতি গোসানী।এই কেছাই খাতিই ক্রমে ক্রমে রূপান্তরিত হন কাঁচাকান্তিতে।চুটিয়াদেরও আরাধ্য দেবী ছিলেন তিনি। তাঁর কাছে নরবলি দেয়া হতো। তাহলে দেখা যাচ্ছে কোচ,ডিমাছা বা কাছাড়ী এবং চুটিয়াদের দ্বারাও পূজিত হতেন এই দেবী।চুটিয়াদের এই দেবীর পূজা সম্পর্কে Sir EDWARD GAIT তাঁর সুবিখ্যাত A History of Assam গ্ৰন্হে বলেছেন They worshipped various forms of Kali with the aid,not of Brahmans, but of their tribal priests of Deories.The favourite form in which they worshipped this deity was that of Kesai Khati,'the eater of raw flesh', to whom human sacrifices were offered.
যাইহোক,কেছাই খাতি,কাঁচা খাউরী কিংবা কাঁচাকান্তি দেবীর নাম কি ভাবে হলো এবং কেনই বা এই দেবীর সামনে নরবলি হতো তার একটা ধারণা পাওয়া গেল। অবশ্য নরবলি শুধু কেছাই খাতি কিংবা কাঁচাকান্তি দেবীর সামনেই নয়, ত্রিপুরা,কাছাড়ি,কোচ, জয়ন্তিয়া সহ আসামের নানা জনজাতিদের মধ্যেও দেবদেবীর সামনে নরবলির প্রচলন ছিল বলে Sir GAIT উল্লেখ করেছেন।
নামের প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার মায়ের রূপের প্রসঙ্গে আসা যাক। জনশ্রুতি,রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদিষ্ট দেবীর রূপ নিয়ে পণ্ডিত সোনারাম শর্মা দেশমুখ্যের সঙ্গে আলোচনা করে যে বিগ্ৰহ গড়িয়ে ছিলেন তা ছিল দুর্গাকালীর মিশ্রিত রূপ। সুদীর্ঘ কাল ব্যাপী মায়ের পূজা পদ্ধতিও পণ্ডিত সোনারাম নির্দিষ্ট বিধি অনুসারেই চলছে। সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতগণ বলেছেন, দেশের অনেক স্হানে দুর্গা কালীর মিশ্রিত রূপে শক্তিপূজার প্রচলন রয়েছে।কাঁচাকান্তিও দুর্গা আর কালীর এক মিশ্রিত রূপ। কিন্তু কাছাড়রাজকে স্বপ্নাদেশ এবং দেবীর রূপ কল্পনাতো অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকের ঘটনা।তার আগের ইতিহাস? কোচ এবং চুটিয়াদের 'কেছাই খাতি'র রূপই বা কেমন ছিল? এই ভাবে ইতিহাস আর জনশ্রুতি যেন ঘিরে আছে দেবী কাঁচাকান্তিকে। দেবীর প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে এসে যায় যুদ্ধ বিগ্ৰহের কথাও।আসে নরবলির প্রসঙ্গও। একদিন আহোমদের কাছে পরাজিত হলো চুটিয়ারা। কোচদের যুদ্ধাভিযানে সমতল কাছাড় ত্রিপুরার রাজার অধিকারচ্যুত হলো। এই ভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নানা রাজত্বের উত্থান আর পতনের মধ্যেও কিন্তু পূজিত হয়ে আসছেন মা কাঁচাকান্তি। শুধু কাছাড় বা বরাক উপত্যকা নয়, সংলগ্ন ত্রিপুরা কিংবা ডিমা হাসাও সহ অসমের নানা এলাকার মানুষ নানা কাজে শিলচর এলে আজ তাদের এক অনিবার্য গন্তব্য হয়ে উঠেছে উদারবন্দের কাঁচাকান্তি বাড়ি। ইতিহাসকে ছাপিয়েও আজ লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্তরে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে চলেছে মায়ের প্রতি অনন্ত বিশ্বাস আর ভক্তির ধারা।