ত্রিপুরাইনফো ২২ এবং মেগা ক্যুইজ ১৭-তে পদার্পন

জয়ন্ত দেবনাথ

মিডিয়াতে খারাপ কাজের নিন্দা করার লোকের অভাব নেই, কিন্তু ভালো কাজের প্রশংসা করার লোকও আছে। বড়ই অভাব শুধু সত্যকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার লোকের। তাই শুরু থেকেই আমরা সত্যকে সত্য হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করে চলেছি নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা ত্রিপুরার নেগেটিভ সাইড গুলির বদলে পজিটিভ সাইড গুলিকেই বিশ্ববাসীর কাছে বেশী করে তুলে ধরার। গত ২২ বছর ধরেই একাজে আমরা দেশ-বিদেশ এবং রাজ্যবাসীর কাছ থেকে ব্যপক সাড়া পাচ্ছি। ভবিষ্যতেও আমরা একই রকম ভাবে ত্রিপুরাকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার একই কাজ চালিয়ে যেতে চাই। এটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য এবং একাজে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ।

নানা কাজে যখনই রাজ্যের বাইরে যেতাম এবং ট্রেনে বাসে কিংবা প্লেইনে বসে পরিচিত বা অপরিচিত যার সঙ্গেই কথা হতো তাদের প্রায় অধিকাংশরই একটাই প্রশ্ন ছিল - 'ত্রিপুরা?' এটা কোথায়? আসামে না অন্ধ্রে? শুধু আমার একার নয়, দেশ ও বিদেশের মাটিতে গিয়ে ত্রিপুরার অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রথম প্রথম বহিঃ রাজ্যের এসব মানুষদের সাধারণ জ্ঞান খুব একটা নেই মনে করে মনকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এটা ৮০ এর দশকের শেষ দিকের কথা। পরবর্তী কালে ৯০ এর দশকের শুরুতে যখন রাজ্যের বাইরে অপরিচিত লোকজনদের সঙ্গে নানা কারণে কথা বার্তা হতো তখন অনেকেই জিজ্ঞেস করতেন ত্রিপুরায় কি উগ্রপন্থী ছাড়া আর কিছু নেই?

১৯৯০ সাল। তখন আমি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সবে ঢুকেছি। কংগ্রেস -টি ইউ জে এস এর জোট সরকার রাজ্যের ক্ষমতায়। প্রায় প্রতিদিনই রাজ্যের কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসবাদীদের হামলা লুটপাট অপহরণ লেগেই থাকতো। কি কারণে জানিনা। দৈনিক সংবাদের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ভূপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ভৌমিক শুরু থেকেই এসব দাঙ্গা হাঙ্গামার ঘটনা কভার করতেই আমাকে বেশি করে পাঠাতেন। আর এসব সন্ত্রাসী কাজ কর্মের ঘটনা কভার করতে গ্রাম পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে আমার সব সময়ই একটি কথা মনে হতো -আমরা কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি? স্বাধীন ত্রিপুরার এসব শ্লোগান দিয়ে যারা দিনরাত শুধু মানুষ খুন, অপহরণ করে যাচ্ছে তার শেষ কোথায়? একটা রাজ্যের গোটা একটা প্রজন্ম জন্মের পর থেকেই শুধু উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী কাজ কর্ম দেখে আসছেন। এভাবে বহিঃরাজ্যের মানুষের কাছে এরাজ্যের পরিচয় হয়ে গেলো একটা সন্ত্রাসী রাজ্যের। যেন এরাজ্যের সব মানুষই এদেশ থেকে আলাদা। উগ্রবাদী কার্যকলাপ ছাড়া এরাজ্যে ভালো কাজ কিছুই হয় না।

যদিও এনিয়ে ভাবনা চিন্তা করার জন্য আমি নিছকই একটা ছোট্ট মানুষ তাও প্রায়শই মনে মনে ভাবতাম তার থেকে বেরোনোর রাস্তা কোথায়। এনিয়ে দৈনিক সংবাদের হয়ে খবর কভার করতে করতে, পাশাপাশি সংগঠিত এসব সন্ত্রাসী ঘটনার উৎস খোঁজার চেষ্টা শুরু করলাম। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল টানা দশ বছর ধরে রাজ্যের সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের শুলক সন্ধানের পাশাপাশি ঘটমান এসব সন্ত্রাসী কাজকর্মের ইতি বৃত্তান্ত নিয়ে ২০০০ সালে 'সন্ত্রাসক্লান্ত ত্রিপুরা' নাম দিয়ে একটি গবেষণা ধর্মী বই লিখে ফেললাম। কলকাতা বই মেলায় দৈনিক সংবাদের সৌজন্যে বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটে। বেশ সাড়াও পরে। বইটির প্রকাশক ছিল দৈনিক সংবাদ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। কলকাতা বইমেলায় 'সন্ত্রাসক্লান্ত ত্রিপুরা' -এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর মেলা প্রাঙ্গনে সেখানকার একাধিক প্রিন্ট ও টিভি মিডিয়াতে আমার ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে। কোলকাতায় সর্বভারতীয় মিডিয়ার লোকজন আমাকে ত্রিপুরায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বিষয়ে এমন সব প্রশ্ন করলেন যার থেকে বার বারই মনে হচ্ছিল ত্রিপুরার মানুষ এবং তার ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বহিঃ রাজ্যের সাংবাদিকরা তো বটেই পাশের বাঙালি প্রধান রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরই তেমন জ্ঞান নেই। হবে নাই বা কেন, স্থানীয় মিডিয়াতো বটেই, বহিঃরাজ্যের মিডিয়াতেও তখন শুধু রাজ্যের এসব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ইত্যাদি সম্পর্কে নেগেটিভ প্রচারটাই বেশি হতো। রাজ্য সরকারের তরফে রাজ্যের ভালো কিছুর পজিটিভ প্রচার করার খুব একটা বড় রকম উদ্যোগ কখনই ছিল না। তাই ১৯৯৮ সাল থেকেই মনে মনে একটা অন্য চিন্তা মাথায় এলো কিভাবে ত্রিপুরাটাকে বহিঃরাজ্য বা বহিঃবিশ্বে একটু তুলে ধরা যায়। দেশ জুড়ে তখন তেহেলকা ডট কম নিয়ে প্রচন্ড মাতামাতি চলছে। কিন্তু এরাজ্যে তখন সেভাবে ইন্টারনেট ওয়েবসাইটের প্রচলন হয় নি। সরকারি স্তরে কিছু কিছু দপ্তরে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হলেও ওয়েবসাইটের ব্যাপারে আইডিয়া খুব কম লোকেরই ছিল। গোটা আগরতলা শহরে মাত্র একটিই সাইবার কাফে ছিল। ওয়েবসাইট বানানোর মতো দক্ষ তথ্য প্রযুক্তির লোকও কম ছিল। মনে মনে ভাবতে থাকলাম কি করা যায়। এক বন্ধু বর্তমানে সিনিয়র এডভোকেট সুব্রত সরকার খবর দিলেন কলকাতায় তার জানা শোনা একটি কোম্পানি আছে যারা ওয়েবসাইট তৈরী করে দেয়। কিন্তু কত টাকা নেবেন ইত্যাদি ব্যাপারে তার কোনো আইডিয়া নেই। কিন্তু মনে মনে প্রচন্ড ইচ্ছা একটা ওয়েবসাইট খোলবো। রাজ্যটাকে বহিঃরাজ্যের মানুষের কাছে তুলে ধরতে ওয়েবসাইটের মতো কোনো মাধ্যমই আগামী দিনে একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে। তাই একদিন হঠাৎ করে একাই কলকাতা পাড়ি দেই। এবং কলকাতার সেই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তথ্য ডট কম নামে ওয়েবসাইট তৈরির কোম্পানিতে গিয়ে হাজির হই। গিয়ে দেখি সেই কোম্পানিতে এরাজ্যেরই দুই যুবক কর্মরত। এবং তারাই মূলত ওই কোম্পানির হয়ে ওয়েবসাইট তৈরীর মূল কারিগর। এর মধ্যে একজন আবার বর্তমানে আমার সহধর্মিনীর ছোট ভাই সৌগত ভট্টাচার্য। অন্যজনের নাম সুনির্মল সেন। তাদের মাধ্যমে কথা বার্তা বলি কোম্পানির ডিরেক্টর শ্রী ইন্দ্রনীল ব্যানার্জীর সঙ্গে। কিন্তু যে সব প্রটোকল ও টাকা পয়সার কথা বললেন অনেকটা নিরাশ হয়েই সেখান থেকে ফিরে আসতে হলো।

কিন্তু মনের মধ্যে প্রতি নিয়তই একই চিন্তা। কাকে দিয়ে কিভাবে একটা ওয়েবসাইট তৈরী করা যায়। হঠাৎ করে একদিন খবর পেলাম বাধারঘাটের কাছে একটা ছেলে রয়েছে নাম সিদ্ধার্থ। সাথে সাথে মোটর সাইকেল নিয়ে খোঁজতে বের হয়ে গেলাম।কিন্তু পেলামনা।এভাবে অনেকদিন চলে গেলো।একদিন খবর পেলাম রবীন্দ্র ভবনের পাশে একটি সাইবার ক্যাফেতে বিপ্লব চৌধুরী নামে একটি ছেলে রয়েছে।সে মোটামুটি ‘ওয়েব সাইট’ তৈরীর কাজে পারদর্শী। কাল বিলম্ব না করে সেই সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে হাজির হই।‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’-গিয়ে বিপ্লবকে পেয়েও গেলাম। .........বাস আর দেরী নয়।মোটামুটি সব কথা বার্তা পাকা করে সিদ্ধান্ত হলো-www.tripurainfo.com হবে আমাদের ওয়েবসাইটের এড্রেস। রেজিস্ট্রেশনও করে নিলাম অনলাইনে।কদিন বাদে সব ঘটনা জানালাম আমার বন্ধু এখন সরকারী ভাবে স্বীকৃত ‘ভেটেরান সাংবাদিক’ মানস পাল ও টেলিগ্রাফ পত্রিকার বর্ষীয়ান সাংবাদিক শ্রী শেখর দত্তকে। দুজনকেই গোটা পরিকল্পনার কথা খুলে বললাম। শেখরদা ও মানস এক কথাতেই সব রকমের সাহায্যে রাজী হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে শুরু করলাম কনটেন্ট ডেভেলপমেন্টের কাজ। এর আগে সন্ত্রাস ক্লান্ত ত্রিপুরা ছাড়াও ত্রিপুরার উপর জেনারেল নলেজ, কারেন্ট এফেয়ার্স ইত্যাদি নিয়েও আমি একাধিক বই প্রকাশ করেছিলাম। এসব বই-এ প্রকাশিত তথ্যাবলী ইত্যাদি কম্পাইল করে এনে দিলাম ওয়েবমাস্টারকে। প্রথম দিকে আমাদের ওয়েবসাইটে খুব বেশী তথ্যাবলী ছিলনা। তিন চারটি ওয়েব পেজ আর ছিল ত্রিপুরার গ্রাম পাহাড় সবুজ বনানী সহ বেশ কিছু পর্যটন স্থলের ছবি। ‘ত্রিপুরাইনফো ডটকম’ নাম দিয়ে সার্চ করলে লাল ও সাদা কালারের ওয়েব পেইজ-এ ত্রিপুরার উপর যখন এসব ছবি ইন্টারনেটে ভেসে উঠতো তখন মনটা আনন্দে ভরে যেতো। বহিঃ রাজ্যের যতজন জানা চেনা লোক ছিল একে একে টেলিফোন করে সবাইকে ত্রিপুরাইনফো ডটকম নামে ত্রিপুরা থেকে বেসরকারি পর্যায়ে চালু প্রথম ওয়েবসাইট দেখার বার্ত্তা পৌঁছে দিতে থাকলাম। পাশাপাশি রাজ্যের সরকারী অফিসার, বুদ্ধিজীবী অংশের মানুষ ও সিনিয়র সাংবাদিকদের এই আনন্দঘণ সংবাদটি দিতে শুরু করলাম। সবাই আনন্দ ভরে এই উদ্যোগের সাধুবাদ জানালেন।এবং যে যার সাধ্যমতো সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। শিলচরবাসী অনিরুদ্ধ লস্কর তখন আগরতলায় আজতক টি ভি-র সাংবাদিক। ক'দিন বাদে সেও আমাদের টিমে জয়েন করলো। ক'দিন বাদে ফটোগ্রাফার হিসাবে জয়েন করলো সুমন দেবরায় ও কাজল কৈরী এবং সাংবাদিক হিসাবে জয়েন করলো প্রদীপ মজুমদার। প্রদীপ আবার ত্রিপুরা অবজারভারেও কাজ করতো। রবীন্দ্র ভবনের পাশে একটি সাইবার ক্যাফে থেকেই কাজকর্ম চললো। কিন্তু এভাবে সাইবার ক্যাফে থেকে ওয়েবসাইট প্রতিদিন আপডেট করা কতটা সম্ভব। তার মধ্যে টাকা একটা অন্যতম ফেক্টর। ওয়েবসাইট তখন দেখেনই বা কতজন যে সরকারী বা বেসরকারী স্তরে কাউকে গিয়ে বলবো যে বিজ্ঞাপন দিন। দৈনিক সংবাদে বেতন হিসাবে যে টাকা পেতাম তার প্রায় পুরোটাই চলে যেতো ওয়েবসাইট চালাতে। কিন্তু এই উদ্যোগকে অনেকেই সাধুবাদ দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে কম বেশি সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন। অনেকে সাহায্য করলেন ও এভাবে একটা বছর চলে গেলো এলো। ২০০১ সালের ২৬শে মে শুভারম্ভের পরের বছর ২০০২ সালে রাজধানী শহরের প্রতিটি বড় ক্লাব ও পূজো উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করলাম আপনাদের পূজোর প্রতিমা ও প্যান্ডেলের ছবি তোলে আমরা ত্রিপুরাইনফো ওয়েবসাইটে দেবো। তাহলে বহিঃ রাজ্যের মানুষও আপনাদের পূজো বিদেশে বসে দেখতে পারবেন। অবিশ্বাস্য রকমভাবে প্রায় এক ডজনের বেশি ক্লাব কর্তৃপক্ষ রাজী হয়ে গেলেন। আমার বন্ধুবর চিত্র সাংবাদিক সুমন দেব রায়-কে সঙ্গে নিয়ে পূজো শুরুর আগের দিনই রাজধানীর সমস্ত দুর্গাপূজোর প্যান্ডেল, প্রতিমার ছবি তোলে এনে ওয়েব সাইটে আপলোড করলাম। প্রথম বছর এভাবে যে টাকা পেলাম এদিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমের খরচ উঠে গেল। এবং ওয়েবসাইট চালুর পর এটাই ছিল আমাদের প্রথম উপার্জন। আগরতলার দুর্গাপূজো পরিক্রমা ওয়েবসাইটে দেখে বহিঃরাজ্য থেকে কম করেও শতাধিক মানুষ এই উদ্যোগের প্রশংসা করে ই-মেল পাঠানোর সাথে সাথে অনেকেই যেকোন রকম সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির কথা লিখলেন। অনেকে বুদ্ধি পরামর্শও পাঠালেন কিভাবে কি করলে অর্থের যোগান আসতে পারে। এভাবে বেশ পাঁচ বছর চলার পর ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে একদিন ঠিক হলো- আমরা আমাদের অর্থাৎ ত্রিপুরাইনফো-র পঞ্চম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে একটি ক্যুইজ অনুষ্ঠান করবো। শ্যামলীবাজারের স্কুল অব সায়েন্স এর অধ্যক্ষ অভিজিৎ ভট্টাচার্যী হলেন গিয়ে ক্যুইজ মাস্টার। টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই ক্যুইজ অনুষ্ঠান। ক্যুইজ অনুষ্ঠানের সাফল্য প্রথম বছরই এমন পর্যায়ে চলে গেল যে অনুষ্ঠানের উদ্ভোধন করতে এসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মানিক সরকার অনুষ্ঠান মঞ্চে ভাষণ দিতে গিয়ে এই অনুষ্ঠানটিকে প্রতি বছর করা যায় কিনা তা ভেবে দেখার অনুরোধ করলেন। ত্রিপুরাইনফো-র মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে শেখরদা মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে এধরনের ক্যুইজ অনুষ্ঠান এখন থেকে প্রতি বছরই করার চেষ্টা হবে বলে মাইকে ঘোষণা দিলেন। তাঁর পর থেকে প্রতি বছরই আগরতলা শহরে ত্রিপুরাইনফো গত ১৭ বছর ধরে ক্যুইজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে যাকে আজ সবাই “ইনফো ক্যুইজ” হিসাবেই জানেন। শুধু তাই নয়, ক্রমে ক্রমে ত্রিপুরাইনফো-র মেগা ক্যুইজ এক্ষণে রাজধানী আগরতলা শহরের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানে পরিনত হয়ে গেছে। পাশাপাশি রাজ্যের অন্যান্য স্থানেও যখনই কোন সরকারী বেসরকারী সংস্থা ক্যুইজের মতো মেধা বিকাশের অনুষ্ঠান করতে চান আমরা ডাক পেলেই সাহায্য করি। এভাবে ক্যুইজ অনুষ্ঠান আজ এরাজ্যের প্রতিটি নগর শহরে মেধা বিকাশের একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

ত্রিপুরাইনফো কখনই শুধু মাত্র ব্যবসায়িক দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে কোনো কিছু করেনি। আজও করছেনা। বহু মানুষের সাহায্য সহযোগিতাতেই এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিলম্ব হলেও পূর্বতন সরকারের কাছ থেকেও বহু ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সাহায্য কম বেশি পাওয়া গেছে। ত্রিপুরা সরকার ২০০৯ সালে তাদের বিজ্ঞাপন নীতির সংশোধন করলো এবং তাতে ওয়েবসাইটেও বিজ্ঞাপন প্রদানের সিদ্ধান্ত হল। বিশেষ করে বড় বড় ঠিকাদারি কাজের বিজ্ঞাপন যেখানে বহিঃরাজ্যের ঠিকাদার বা সাপ্লায়ার কোম্পানি গুলির জানা প্রয়োজন এমন সব কাজের বিজ্ঞাপনের ২৫% বিজ্ঞাপন সরকারী ওয়েবসাইটের পাশাপাশি বেসরকারী ওয়েবসাইটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। তা যাই হোক তখনকার সময়ে রাজ্য সরকারের এই বিজ্ঞাপন নীতির কারনে আমাদের বিজ্ঞাপন পেতে খানিকটা সুবিধা হয়। এবং ধীরে ধীরে সামান্য একটা আর্থিক সাপোর্ট আসে বেসরকারি পর্যায় থেকেও। তখন বেশ কয়েকজনকে স্থায়ী ভাবে নিয়োগ করা হলো। সহযোগী সহকর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতা ও পরিশ্রমের কারণে দেখতে দেখতে ত্রিপুরাইনফো একটা অনলাইন মিডিয়া হাউসের পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের রূপ পেয়ে গেল। কিন্তু ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটের পর হঠাৎ করে আমদের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রশাসনিক স্তরে অনেক চিঠি চালাচালি এবং সুশান্ত চৌধুরী তথ্য দপ্তরের মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে অবশ্য ইদানিং আমাদের ওয়েবসাইটেও নিয়ম মেনে বিজ্ঞাপন প্রদান করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গক্রমে, এখানে একটা বিষয় বলতে চাই ত্রিপুরার ট্রু-পটেটো সিড সংক্ষেপে যাকে বলা হয় TPS এক সময় এ রাজ্যে প্রচুর পরিমানে উৎপাদন হতো। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে এরাজ্যের কৃষি বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত TPS কে বহিঃবিশ্বে তো দূরের কথা বহিঃরাজ্যে পর্যন্ত সেভাবে মার্কেটিং করা হয়নি। আমার এখনো মনে আছে তৎকালীন কৃষি দপ্তরের অধিকর্তা ড: পি কে পাল একদিন TPS সম্পর্কে একটি লেখা ওয়েবসাইটে আপলোড করতে আমাকে পাঠান। আমরাও তিন চার পৃষ্ঠায় আলোকচিত্র সহ লেখাটি ত্রিপুরাইনফো ডটকম ওয়েবসাইটে আপলোড করি। আশ্চর্যজনক ভাবে লক্ষ্য করি তিন চারদিনের মধ্যেই বেশ কিছু ইমেল আমাদের কাছে এলো। অনেকেই TPS চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তৃত জানতে চাইলো। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে একটি ইমেল-এ জানতে চাওয়া হলো TPS এর মজুত কতটা রয়েছে এবং কি দামে কতদিনের মধ্যে কত পরিমানে এই বীজ পাঠানো যাবে। ইমেইলটি প্রিন্ট করে আমি দপ্তরে পাঠিয়ে দেই। পরে অবশ্য জানতে পারি কিছু বীজ নাকি ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল।দপ্তরে মজুত ছিলনা বলে চাহিদা অনুযায়ী অবশ্য ত্রিপুরার ট্রু-পটেটো সিড বিদেশে পাঠানো যায়নি। একই রকম ভাবে ত্রিপুরার বাঁশ বেতের সামগ্রী, পর্যটন সম্ভাবনা , রাবার, আনারস, চা সম্পর্কেও তখন প্রায়শই বিস্তৃত জানতে চেয়ে আমাদের কাছে প্রচুর ইমেল আসতো। আমরা অবশ্য এসব ইমেল গুলি সংশ্লিষ্ট দপ্তর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিতাম। এখনও তাই করি।

প্রসঙ্গত, আরও একটি বিষয় আজ এখানে না উল্লেখ করে পারছিনা আর সেটি হলো- ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ-এর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল (রেজাল্ট) ওয়েবসাইটে প্রদান। যাতে রাজ্যের বাইরে থেকেও যে কেউ পর্ষদ এর ফলাফল জানতে পারে। ইতিমধ্যেই সিবিএসই, আইসিএসসি-সহ জাতীয় স্তরে অধিকাংশ জয়েন্ট-এন্ট্রান্সের ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রদান শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে আমরা এনিয়ে ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। কিন্তু পর্ষদ কর্তৃপক্ষ ফলাফল বিনে পয়সাতেও ওয়েবসাইটে দিতে কোনও ভাবেই রাজি হচ্ছিল না। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালে গিয়ে রাজী করানো গেলো। এবং ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের রেজাল্ট আজকাল ছেলেমেয়েরা বাড়ীতে বসেই দেখতে পারছে। শুধু তাই নয়, একই রকম ভাবে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে তৎকালীন ত্রিপুরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের রেজাল্টও অনলাইনে আপলোড করার কাজটি আমরাই প্রথম শুরু করি। পরে তাদের ওয়েবসাইটও আমরা তৈরি করে দেই। তার পর ২০১০ সাল নাগাদ ধীরে ধীরে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর গুলিও নিজস্ব ওয়েব পোর্টাল চালু করতে শুরু করে। কিন্তু প্রথম দিকে এন আই সি ছাড়া এরাজ্যে তেমন কোন ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কোম্পানী ছিলনা। এন আই সি-র পক্ষে সব দপ্তরকে সাহায্য করা সম্ভব ছিলনা। তাই বেশকিছু দপ্তর টেন্ডার করে বহিঃরাজ্যের কোম্পানীর সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বহিঃরাজ্যের কোম্পানী গুলি এত কম টাকার কাজে আসতে চাইতনা। তখন আমাদের ওয়েবসাইটের ওয়েব মাষ্টাররা নাম মাত্র টাকায় ধীরে ধীরে সরকারী দপ্তরের ওয়েবসাইট গুলি বানানো ও আপডেট করার কাজেও যুক্ত হতে থাকে। এতে তাদেরও একটা এক্সট্রা ইনকাম আসতে থাকে।বেশ কজন দক্ষ প্রোগ্রামার ও ওয়েব ডিজাইনার যারা এরাজ্যেরই ছেলে মেয়ে দিল্লী কলকাতা ব্যাঙ্গালোরে কাজ করছিল তাদেরকে খোঁজে বের করে আমরা এরাজ্যে নিয়ে আসি। যেহেতো শুধু নিউজ ওয়েবসাইট থেকে আসা রাজস্ব দিয়ে এত বড় একটি কর্ম যজ্ঞের খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছিলনা, তখন ধীরে ধীরে আমরা আমাদের কর্ম পরিধি বাড়াতে থাকি।২০১২ সালে আমিও দৈনিক সংবাদ ছেড়ে দেই। সরকারী বেসরকারি স্তরে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট, ছোট খাটু সফটওয়ার তৈরী, বিভিন্ন টেকনিক্যাল সাপোর্ট, ত্রিপুরার উপর তথ্যমূলক বেশ কিছু বই প্রকাশ ইত্যাদির কাজ আমরা আরও বেশি করে করতে শুরু করি। বাংলা ও ইংরেজীতে কনটেন্ট ডেভেলপমেন্টের বেশ কিছু জাতীয় স্তরের কাজও আগরতলায় বসে আমরা করতে শুরু করি। এক সময় আগরতলায় বসে গোয়া ও ব্যাঙ্গালোরের কিছু যুবকের সাহায্য নিয়ে আমরা গোয়া সরকারের পোর্টাল আপডেট-এর কাজও করি। তিন বছর সমানে নেশন্যাল পোর্টালে ত্রিপুরা থেকে যাবতীয় তথ্যাবলী বাংলা ও ইংরেজীতে আমরাই আপডেট করতাম। এক সময় কাজের চাপ এত বেশী বেড়ে গেছিল তখন আর আমাদের পোস্ট অফিস চৌমুহনীর অফিসে সবার বসার জায়গা হচ্ছিলনা। তখন রাজ্য সরকার তথ্য-প্রযুক্তি নীতি সংশোধন করেন। আই টি সেক্টরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোম্পানি গুলিকে জমি প্রদান সহ বেশ কিছু বিশেষ সুবিধা ও ছাড়ের কথা ঘোষনা করলেন। এই অনুযায়ী আমরা আবেদন করি এবং রাজ্য সরকারের কাছ থেকে সরকারী নিয়মে ও যথাযথ প্রিমিয়ামের মাধ্যমে লিচুবাগানের জমিটি তৎকালীন বাজার মূল্যে ক্রয় করি এবং ব্যাঙ্ক থেকে ঋন নিয়ে ধীরে ধীরে লিচুবাগানে একটি স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তুলি যেখানে আজকে বহু এরাজ্যেরই যুবক যুবতী ওয়েবসাইটে নিউজ রাইটিং, তথ্যমূলক পুস্তক প্রকাশ, বিভিন্ন সিটিজেন সার্ভিসেস, মার্কেট সার্ভে, তথ্য প্রযুক্তিগত অন্যান্য কাজকর্ম যেমন বিপিও, স্কিল ট্রেনিং সহ চাকুরি ক্ষেত্রে দক্ষতা ও মেধা বিকাশ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রজেক্টে সাফল্যের সাথে কাজ করছেন।ইতিপূর্বে আমাদের সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ শেষে এরাজ্যের বহু ছেলেমেয়ে বহিঃরাজ্যে এমনকি বিদেশে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এখন সাফল্যের সাথে কাজ করছেন।

এটা আজ অনস্বীকার্য যে অখ্যাত এই রাজ্যটি সম্পর্কে বহিঃরাজ্যের মানুষের মধ্যে ত্রিপুরা ইতিহাস ঐতিহ্য সহ এরাজ্যের মানুষের ভালো কাজের প্রচার প্রসারে ত্রিপুরার প্রথম অনলাইন মিডিয়া হাউজ হিসাবে ত্রিপুরাইনফো ডটকম প্রথম থেকেই সচেষ্ট এবং একথায় আজ সফল। আগামী দিনেও আমাদের এই প্রচেষ্টা জারি থাকবে। তাই আমরা আমাদের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ক্ষুদ্র ও পিছিয়ে পড়া ত্রিপুরাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার কাজকেই আগামী দিনে আরও বেশী করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতকে সামনে রেখে ত্রিপুরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ত্রিপুরাইনফো ডটকম যে বদ্ধপরিকর তার সবচাইতে বড় প্রমান হল ত্রিপুরাইনফো ডটকম এর গত ১৭ বছর ধরে চলে আসা মেগা ক্যুইজের আসর। যাকে অনেকেই ত্রিপুরার বার্ষিক নলেজ ফেস্টিবল বলে থাকেন। ইন্টারনেটে যে কেউ গুগলে গিয়ে সার্চ করলেই বুঝতে পারবেন ত্রিপুরার মতো দেশের একটা প্রান্তিক রাজ্যেও ক্যুইজ অনুষ্ঠান আজ কতটা জনপ্রিয়। কিভাবে ক্যুইজ একটা রাজ্যের ছেলে বা মেয়েদের কাছে বার্ষিক একটা উৎসবের রূপ নিয়ে ফেলেছে। আগামী ২৭শে নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রিপুরাইনফো মেগা ক্যুইজের ১৭তম আসর। এবছর রাজধানীর রবীন্দ্রভবনের ১ নং হল-এ অনুষ্ঠিত হবে এই অনুষ্ঠান। সবাইকে আমন্ত্রণ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.