শ্যাম বেনেগালঃ শৈল্পিক দক্ষতায় সেলুলয়েডে সংরক্ষণ করেছেন প্রান্তকথা
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
December 28, 2024
৯ ডিসেম্বর(২০২৪)’এ আগরতলায় আমার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে দেশ বিদেশ থেকে বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এসেছিলেন। তাঁদের একজন ছিলেন অভিনেত্রী সীমা বিশ্বাস। তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর সঙ্গে সেদিন চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কিছু কথা হয়েছিল। প্রসঙ্গ ক্রমেই আলোচনায় উঠে এসেছিল শ্যাম বেনেগাল’এর নাম। তাঁর পরিচালনায় সীমা বিশ্বাস লেখক হর্ষ মান্দার’এর " আনহার্ড ভয়েসস: স্টোরিজ অফ ফরগটেন লাইভস " অবলম্বনে তৈরি ‘সমর’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। সীমা বিশ্বাস অভিনীত ‘সমর’ সেবার সেরা ফিচার ফিল্ম হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। ফের শ্যাম বেনেগাল’এর সঙ্গে কাজ করতে তিনি যে ইচ্ছুক –সে কথা আমায় বলেছিলেন।
এর ক’দিন পর অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর (২০২৪) ছিল শ্যাম বেনেগাল’এর জন্মদিন। তাঁকে সামনাসামনি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য হাজির ছিলেন কুলভূষণ খারবান্দা, শাবানা আজমি, দিব্যা দত্ত, নাসিরুদ্দিন শাহ, রাজিত কাপুর, অতুল তিওয়ারি, কুনাল কাপুর সহ আরও অনেকেই। তাঁদের একটি সম্মিলিত ছবি সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করা হয়। শ্যাম বেনেগাল’ ছিলেন সেই ছবির মধ্যমণি ! সমাজ মাধ্যমে ছবিটি আসলে শেয়ার করেছিলেন শাবানা আজমি। তিনি মজার ছলে সেই ছবির নীচে লিখেছিলেন, ‘’ একসঙ্গে অভিনয় করার জন্য আমাদের কী কেউ আর আহ্বান জানাবেন না!’’ বলা বাহুল্য, শ্যাম বেনেগাল’কে নিয়ে ক্যাপশন সহ শাবানা আজমি’র সেই হৃদয় স্পর্শী ছবিটি ভাইরাল হয়েছিল। সবাই শ্যাম বেনেগাল’কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান; তাঁর দীর্ঘ জীবনের জন্য প্রার্থনা করেন।
কিন্তু জন্মদিনের ঠিক নয় দিন বাদে এই পৃথিবীকে বিদায় জানান সমান্তরাল সিনেমার একামেবাদ্বীতিয়ম মসীহা। ৯০ বছর বয়সে চলে গেলেন চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। তাঁর প্রয়াণে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সহ সারা দেশেই নেমে এসেছিল শোকের ছায়া । তিনি সত্তর এবং আশি’র দশকে সিনেমার একটি স্বতন্ত্র ধারাকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন এবং বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রকে ।
সমান্তরাল চলচ্চিত্রের পথপ্রদর্শক শ্যাম বেনেগাল ছিলেন অগ্রজ বিমল রায়ের মতোই এক পরিশ্রমী পরিচালক। চিত্র গ্রহণের সময় প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। তাঁর চলচ্চিত্র দর্শনে প্রতিভাত হয়েছিল ইতালীয় নিওরিয়ালিস্ট আন্দোলনের প্রভাব । এরই ফলশ্রুতিতে তাঁর চলচ্চিত্রের মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল সমাজের প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষের জীবন। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বিভিন্ন জটিল সমস্যাকে যেন ব্যবচ্ছেদ করতেন। শ্রেণী বৈষম্য, লিঙ্গ গতিশীলতা এবং সাংস্কৃতিক সত্তার মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সততা, মানবতাবাদ এবংচিত্তাকর্ষক কাহিনী ভিত্তিক তাঁর চলচ্চিত্রগুলি সামাজিক পরিবর্তন এবং দ্বন্দ্বের জালে আটকে থাকা ব্যক্তিদের জীবনকে সত্যের প্রতি অন্বেষণমুখী করে তোলে। বেনেগাল’এর স্বতন্ত্র নির্দেশনা শৈলী, কাহিনীর বর্ণন, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের ব্যবহার ভারতীয় চলচ্চিত্রকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
বাস্তববাদের গভীরে প্রোথিত তাঁর চলচ্চিত্রগুলি ছিল বলিউডের বাণিজ্যিক ফরমুলা গল্পের বিপ্রতীপ। শামা জাইদি এবং গিরিশ কারনাড’এর মতো চিত্রনাট্যকারদের সঙ্গে কাজ করার ফলে তাঁর আখ্যানগুলির ভাষ্য হয়ে উঠেছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রভাব বিস্তারকারী ! সেলুলয়েডের চরিত্রগুলিকে বাস্তব রূপে উপস্থাপিত করার দক্ষতা হয়ে উঠেছিল সম্ভবত তাঁর সৃজনশীলতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর চলচ্চিত্রগুলি মেলোড্রামা বর্জিত। আবেগের গভীরতা বোঝাতে চরিত্রগুলির স্থিতধী অভিব্যক্তির ওপর তিনি বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন।
বাস্তবধর্মী চরিত্র, প্রান্তজনের গল্প এবং গড় বাজেট - এই সবই ছিল তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র প্রকল্পের অংশ। মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করেন নি, নিজের দর্শন আর শৈল্পিক শর্তে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন । যথেষ্ট সম্ভাবনা জাগিয়েও অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা শেষ পর্যন্ত নিজেদের সত্তা বিসর্জন দিয়ে বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে আপস করেন। কিন্তু শ্যাম বেনেগালের কাজ করার পদ্ধতি, যা ১৯৭৪-৭৫’এ পরিস্ফুট হয়েছিল অঙ্কুর এবং নিশান্ত’এ - তা অক্ষত এবং অব্যাহত ছিল তাঁর শেষতম চলচ্চিত্র ‘মুজিব: দ্য মেকিং অব নেশন’ পর্যন্ত । তিনি নিপুণভাবে সিনেমাকে বৈষম্য ক্লিষ্ট সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন ! বলা বাহুল্য, তাঁর প্রতিটি ছবিই মাইলফলক হয়ে উঠেছে।
শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত অঙ্কুর, নিশান্ত, মন্থন, ভূমিকা, অরোহন, অন্তরনাদ, জুনুন, কলযুগ, বিজেয়তা, হরি ভরি, সুরজ কা সাতবাঁ ঘোড়া, সমর, জুবেইদা;র মতো আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র ছিল শৈল্পিকতা এবং সৃজনশীলতার উজ্জ্বল প্রতীক। কী করে ভোলা সম্ভব মন্থন’এর সেই মর্মভেদী সংলাপ, “দুধ সিরফ পয়সা নাহি হ্যায়, ভাই। দুধ ইজ্জত হ্যায় !" উল্লেখ্য, মন্থন (১৯৭৬), বেনেগাল’এর অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্র, ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল। নাসিরুদ্দিন শাহ এবং প্রয়াত স্মিতা
পাতিল অভিনীত এটি ছিল ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ জনগণের –অনুদানে নির্মিত ফিল্ম। ৫০০,০০০ কৃষক এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেছিলেন। মাথা পিছু মাত্র দু’ টাকা ছিল এই অনুদান। গল্পের অনুপ্রেরণার মূলে ছিলেন শ্বেত বিপ্লবের জনক ডক্টর ভার্গিস কুরিয়েন। সেই সময় দুগ্ধ উৎপাদন ছিল সমবায় আন্দোলনের অংশ। ১৯৭৭’এ মন্থন শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের জন্য দু’টি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৭৬’এ একাডেমি পুরস্কারের জন্য শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার ফিল্ম ক্যাটেগরিতে ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে মন্থন মনোনীত হয়েছিল। মন্থন সফলতা পেয়েছিল বক্স অফিসেও । ছবির লভ্যাংশ তখন কৃষকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইউনাটেড নেশন’ও মন্থন চলচ্চিত্রটি বিশ্বের সর্বত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিল।
শ্যাম বেনেগাল ও যেন আসলে লেখকই ছিলেন; তবে তাঁর মাধ্যম ছিল রূপোলী পর্দা ! এ বিষয়ে তিনি বলেওছিলেন, "একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়া মানে একজন লেখক বা চিত্রশিল্পী হওয়ার মতো !" ১৯৮৮’এ তিনি যখন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরুর লেখা ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’র উপর ভিত্তি করে দূরদর্শনের জন্য ‘ভারত এক খোজ’ নামে ৫৩ এপিসোডের একটি সিরিয়াল বানিয়েছিলেন, সেটিও তখন যেন একটি বই আকারেই পরিস্ফুট হয়েছিল ছোট পর্দায় ! সিরিয়ালের প্রতিটি পর্ব ছিল যেন বইটির এক একটি অধ্যায়। প্রতিটি ফ্রেমই ছিল দেখার মতো। হাজার বছরের ইতিহাস অন্বেষার মাধ্যমে প্রতিটি পর্ব তৈরি করাটা ছিল গবেষণা ধর্মী কাজ। এর আগে দূরদর্শনের জন্য বানিয়েছিলেন ’যাত্রা’ (১৯৮৬) নামে একটি ভ্রমণ ভিত্তিক সিরিয়াল।
শ্যাম বেনেগাল ইন্ডাস্টিতে যোগ দিয়েছিলেন এমন এক সময়ে যখন মশলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। সত্তর দশকের প্রথমার্ধে মনে হচ্ছিল মূল ধারার চলচ্চিত্রই চরম আপসকামী হয়ে উঠছে। সেসব চলচ্চিত্রের কাহিনী ছিল দেশের আর্থ –সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সংস্পর্শহীন। শুধুমাত্র সংগীতই হয়ে উঠেছিল সেসব চলচ্চিত্রের মূল ভাষ্য ! রাজেশ খান্নার উত্থান এবং তার পরেই উদিত হন অ্যাংরি ইয়ংম্যান অমিতাভ বচ্চন। তিনি সিনেমার জনপ্রিয়তার মাপকাঠি বদলে দেন। বাণিজ্যিক ছবির ফরমুলা বদলে যায়। অ্যাকশন ধর্মী চলচ্চিত্রে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত চরিত্রগুলি লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে উঠে। এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে তখন প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। এস্টাব্লিশমেন্টের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের সুপ্ত আশা আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে উঠলেও আদতে তা ছিল রূপোলী রাংতায় মোড়া বাস্তবতা বহির্ভূত বাণিজ্যিক ধারার সেই মশলা চলচ্চিত্রই । এমন পরিস্থিতিতেই সমান্তরাল চলচ্চিত্রের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল, যেখানে আপসহীন ভাবে সমাজের কিছু নির্মম সত্যকে বাস্তবধর্মী কায়দায় উপস্থাপন করা যায়। দেশের সমস্যাগুলি খুবই জটিল প্রকৃতির এবং এসব সমস্যার কোনও চটজলদি সমাধানও বের করা দুষ্কর । এসকেপিজম কিম্বা আপসের পরিবর্তে তাই সমস্যার গভীরে প্রবেশের পর সমাধান সূত্র খুঁজে বের করাটাই বিধেয় ! এই চিন্তা ভাবনার প্রেক্ষিতেই আন্দোলনের রূপ পায় সমান্তরাল চলচ্চিত্র। গ্ল্যামার কিম্বা সুপারস্টারডমের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই এমন সব অভিনেতাদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন শ্যাম বেনেগাল । তাই শাবানা আজমি, সীমা বিশ্বাস, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি এবং স্মিতা পাতিলের মতো দক্ষ অভিনেতাদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন।
বেনেগাল বিশ্বাস করতেন যে সত্য দেখানোর জন্য ফ্যান্টাসি এবং স্টারডমের প্রয়োজন নেই। চলচ্চিত্রের ভাষা, চরিত্র ও পরিস্থিতি সমূহ বইয়ে লেখা গল্পের মতো হতে হবে। তিনি ‘মন্থন’ এ দেখিয়েছেন যে, শুধুমাত্র বাস্তববাদী শৈলীতেই জনশিক্ষার প্রচার করা যেতে পারে। স্পষ্টতই আর্থিক দিক থেকে এমন পরীক্ষানিরীক্ষা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ । ওই সময়ে বাণিজ্যিক ধারার বিপরীতে নির্মিত এমন সব ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্রের আর্থিক সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু চলচ্চিত্র কখনই বেনেগাল’এর কাছে সম্পদ আহরণের জন্য নিছক বাণিজ্যিক উদ্যোগ ছিল না। তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রই সমাজের কোনও না কোনও সমস্যাকে উত্থাপন করে এবং সেসব সমস্যার নির্দিষ্ট পরিণতির দিকেও আমাদের চিন্তা ভাবনাকে বাহিত করেন। তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, ওমপুরি, দীপ্তি নাভাল, স্মিতা পাতিল, অমরীশ পুরির মতো শিল্পীদের। মূল ধারার চলচ্চিত্রের তথাকথিত উজ্জ্বল বৃত্তের বাইরে অবস্থানরত এমন সব প্রতিভাবান এবং বুদ্ধিদীপ্ত শিল্পীদের তিনি অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আসলে সমান্তরাল চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি তাঁর সময়ের একটি পুরো প্রজন্মকে নতুন চেতনার স্তরে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। ‘শ্যাম বেনেগাল: ফিল্ম মেকার অব দ্য রিয়েল ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের লেখক অর্জুন সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, ‘’তাঁর দূরদৃষ্টি এবং অনুভূতিপ্রবণ মন তাঁকে এমন এক নির্মাতা হিসেবে উত্তীর্ণ করে তুলেছে যাঁর চলচ্চিত্রের অন্যতম বিষয় হল ভারত!’’ নারীর বিভিন্ন সমস্যাবলী নিয়েও তিনি ভেবেছেন। ১৯৯০’এর দশকে, চিত্রনাট্যকার এবং সাংবাদিক খালিদ মোহাম্মদের সহযোগিতায় বেনেগাল, মুসলিম মহিলাদের সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রের একটি ট্রিলজি তৈরি করেন।, মাম্মো (১৯৯৪), সরদারি বেগম (১৯৯৬), এবং জুবাইদা (২০০১) ছিল সেই ট্রিলজিরই অংশ।
শ্যাম বেনেগাল তাঁর সমান্তরাল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য স্বীকৃতি শুধু ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও পেয়েছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণে শৃঙ্খলা পরায়ণতায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। অবিশ্রান্তভাবে একটানা চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উপ মহাদেশের মানুষকে যৌক্তিক ও সংস্কৃতিবান করে তোলার প্রয়াসে ব্রতী ছিলেন। শ্যাম বেনেগাল আসলে মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটকের ঐতিহ্যের অনুসারী একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। সংলাপ এবং তীক্ষ্ণ সামাজিক সমালোচনার মাধ্যমে, তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাসে নিজের জন্য একটি বিশেষ স্থান তৈরি করে
নিয়েছেন । তাঁর চলচ্চিত্র দর্শকদের শুধু বিনোদনই দেয় না, শিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করে। কিছু বৌদ্ধিক চিন্তা ভাবনায় প্রাণিত করে। এই বৈশিষ্ট্গুলিই তাঁকে চলচ্চিত্র জগতের একজন সত্যিকারের আলোকিত ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে।
পরিচালক হিসেবে তাঁর শেষ ছবি ছিল গত বছর অর্থাৎ ২০২৩’এ মুক্তিপ্রাপ্ত বায়োপিক 'মুজিব: দ্য মেকিং অফ আ নেশন'। চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নির্মিত। গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই ছবি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘’ মুজিব প্রথমাবস্থায় ছিলেন একজন সাধারণ রাজনীতিবিদ। পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। একজন অসাধারণ ক্যারিশম্যাটিক নেতা এবং অবিশ্বাস্য বক্তা হিসেবে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। একজন মহান জাতীয় নেতা তো ছিলেনই; একই সঙ্গে তিনি তাঁর আশেপাশের লোকজনদের নির্বিচারে বিশ্বাসও করতেন খুব। গ্রীক ট্র্যাজেডির মতো এই বিশ্বাসবোধ হয়ে উঠেছিল তার ব্যক্তিত্বের এক দুঃখজনক ত্রুটি। কেউ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে - এমন ধারনাটাই যেন তাঁর মন থেকে মুছে গিয়েছিল। কিন্তু সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন । তাঁর ওপর যে কোনও সময় প্রাণঘাতী হামলা হতে পারে – একাধিকবার সে বিষয়ে দেশ বিদেশের গুপ্তচর সংস্থা তাঁকে অবহিত করেছিল। এমন কী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত মুজিবকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু কারোর কোনও সতর্কবার্তায় তিনি কর্ণপাত করেন নি। এর দুঃখজনক পরিণতির কথা আজ সবারই জানা। ১৯৭৫’এ বাংলাদেশে সেই রক্তাত্ত ঘটনার দীর্ঘকালীন অভিঘাতে অশান্ত হয়েছে উপমহাদেশ। তার রেশ চলছে এখনও। মুজিব: দ্য মেকিং অব আ নেশন ছবিতে এই বিষয়গুলিও তুলে ধরা হয়েছে।‘’
শ্যাম বেনেগাল তাঁর শেষতম ছবিটির মাধ্যমে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন আজ তা প্রফেসির মতোই প্রকট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে । সে দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জাতীয় সংগীত সহ পর্যায়ক্রমে মুজিবর রহমান’কে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। এরই প্রেক্ষিতে আবারও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর ওপর শ্যাম বেনেগাল নির্মিত চলচ্চিত্রটি। তাঁর নির্দেশিত মুজিব দ্য মেকিং অব আ নেশন সহ অন্যান চলচ্চিত্রগুলির মতোই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থারও যেন কোনও সুখদায়ক পরিসমাপ্তি নেই ! প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, মুজিব: দ্য মেকিং অফ আ নেশন বাংলাদেশে এখনও নিষিদ্ধ হয় নি, তবে এরই মধ্যে এটি নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এই হ্যাজিওগ্রাফিক ছবিটির প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের (বিজেএএফ) আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল।
অনিশ্চয়তায় ভরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন কম্পমান । মুজিব দ্য মেকিং অব আ নেশন - যে কোনও সময় সে দেশে নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হতে পারে। যদি নিষিদ্ধ হয়ও বা - তাতে ছবিটির কোনও ক্ষতি হবে না। মুজিব’এর সংগ্রামের মাধ্যমে শ্যাম বেনেগাল আসলে একটি দেশ এবং জাতির আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরেছেন। শৈল্পিক দক্ষতায় সেলুলয়েডে সংরক্ষণ করেছেন সেই প্রান্তকথার ইতিবৃত্ত । আসলে শ্যাম বেনেগাল নির্মিত চলচ্চিত্রগুলি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার এক একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল স্বরূপ। মুজিব দ্য মেকিং অব আ নেশন - সেই ধারাবাহিকতারই অংশ বিশেষ। এমন তথ্যনিষ্ঠ গবেষণা ধর্মী কাজকে মুছে ফেলা কী এতোই সহজ !
আরও পড়ুন...