।। পুছো না ক্যাইসে ।।

অরিন্দম নাথ

লোকটি আমারই বয়সী । তামাটে রঙ । উচ্চতা মানানসই । কালো টিকালো নাক । দাড়ি নেই । গোঁফ বীরাপ্পনের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ । চোখগুলো বেশ বড় । গোলাকার । একটু লালাভ । ক্রোধোদ্দীপ্ত মনে হয় । আকর্ষণীয় চরিত্র । পাড়ায় হঠাৎ হঠাৎ দেখি । আগে কখনও কথা হয়নি । আজই প্রথম কথা হল । বলেই অবাক হয়েছি । বিশেষত শাস্ত্রীয় সংগীতের উপর তাঁর জ্ঞানের বহর দেখে।

আজকাল আমি একটি রুটিন মেনে চলি । প্রতিদিন রিলিজিয়সলি মর্নিং ওয়াক করি । সকাল সোয়া পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে যাই । ঘন্টা খানেক পর ফিরে আসি । তারপর চা খেয়ে কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করি । সাথে প্রাণায়াম । টনিক হিসেবে থাকে গান শুনা । মোবাইলের ইউটিউবে । ব্লু-টুথ দিয়ে সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে এমপ্লিফায়েড করে । গান শুনার একটি রুটিন আছে । সোমবারে লোকগীতি । মঙ্গলবারে বাংলা আধুনিক । বুধবারে রবীন্দ্র সংগীত । বৃহস্পতিবারে রাগপ্রধাণ গান । শুক্রবারে নজরুল গীতি । শনিবার পুরাতন হিন্দি গান । রবিবারে যন্ত্র সঙ্গীত । মাঝে মাঝে রুটিন ভেঙ্গে যায় । বিশেষ কোনও গান পছন্দ হলে কয়েকদিন লাগাতর শুনি । গানটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি । মোবাইল ইন্টারনেট খুবই বুদ্ধিমান । শ্রোতাদের রুচি বুঝতে পারে । সেই অনুযায়ী ইউটিউবে পছন্দের গানগুলো প্রম্পট করে । বৃহস্পতিবার ছিল রাগপ্রধাণ গান শুনার দিন । মোবাইল আহির ভৈরব রাগের একটি খেয়াল অফার করলো । আগে শুনিনি । কৌশিকী চক্রবর্তীর কণ্ঠে । প্রায় বিশ মিনিট চললো । খুব উপভোগ করলাম । সার্চ করে আরো কিছু আহির ভৈরব রাগে গান শুনলাম । এরমধ্যে সিনেমার গানও ছিল । এক্সারসাইজ শেষ করে পত্রিকা নিয়ে বসলাম । ন'টার দিকে পত্রিকা পড়া যখন শেষ করলাম হৃদয়জুড়ে আহির ভৈরব । বিকেলে সেই আমেজ রইলো না । স্ত্রী ঘরে নেই । কর্মস্থলে । রাত্রিতে ফিরবে না । ভারত ইংল্যান্ডের খেলা ছিল । ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ । ভারত বিশ্রীভাবে হেরে যায় । খেলার শেষটা দেখিনি । ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ঘুম থেকে ওঠে একটু ফ্রেশ হয়ে জলিকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম । সন্ধ্যে নেমেছে । রাস্তায় লোকজন বেশি নেই । আর তখনই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা । তিনিই কথা শুরু করলেন, "স্যার, কেমন আছেন ? অবসর জীবন কেমন কাটছে ?"

আমি পুলিশ সেবায় ছিলাম । অনেকেই আমায় চেনে । আমি চিনি না । আজকাল অবাক হই না । তাই উত্তর করি, "ভালো আছি । উপভোগ করছি । জীবন আগের থেকে ছন্দবদ্ধ হয়েছে ।

- বুঝতেই পারছি । আপনার চোখের নিচে দীর্ঘদিনের কালি ছিল । এখন মিলিয়ে গেছে ।

- আপনাকে কিন্তু আমি চিনতে পারিনি ।

- আজ বলবো না । হয়তো আমাদের মধ্যে পূর্ব পরিচয় ছিল । অন্য শহরে । অন্য আঙ্গিকে ।

- বেশ! আপনি আমাকে এত দেখার সুযোগ পেলেন কখন ?

ভদ্রলোক মুচকি হেসে বলেন, "সে-ও না হয় তোলা রইল ভবিষ্যতের জন্য ! আপনার গানের চয়েজ কিন্তু দারুন! আজ যেমন আহির ভৈরব শুনছিলেন।"

- আপনি জানলেন কিভাবে?

- রাস্তা থেকেইতো দিব্যি শুনা যায় ।

- তা-ও বটে ! মনে হচ্ছে, শাস্ত্রীয় সংগীত আপনার পছন্দ ।

- গান মাত্রেই আমার পছন্দ । আপনারও যেমন ! সব ধরনের গানই শুনেন । বিশেষত শাস্ত্রীয় সংগীতে আপনার ইন্টারেস্ট আমার ভালো লাগে ।

- শুধু এই একটা জিনিস নিয়েইতো ভারতবাসী হিসেবে আমরা গর্ববোধ করতে পারি । আমার ইন্টারেস্ট ফেসবুকের এক মিতার কল্যাণে ।

- সে কিরকম ?

- সে একটি সান্ধ্যরাগের সমানামী । ওরা দুই বোন । সে বড় । কথায় কথায় একদিন সে তার জীবন কাহিনী বলেছিল । বাবা ক্লাসিক্যাল সিঙ্গার । রেওয়াজ, গানের টিউশন আর অনুষ্ঠান নিয়েই মত্ত থাকেন । সংসারে সেরকম স্বচ্ছলতা ছিল না । হাসপাতাল থেকে যখন মেয়ের জন্মের খবর এলো তখন ভদ্রলোক একটি অনুষ্ঠানে । তখন সন্ধ্যে বেলা । একটি সান্ধ্য রাগে গান গাইছিলেন । তিনি মেয়ের নাম রাখলেন সেই রাগের নামে ।

- ইমন ?

- পূরবী নয় কেন ? দু'জনের একজনের নাম পূর্বী ।

- পূরবী বা পূর্বী দিন শেষের রাগ । বিকেল ৪ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত গাওয়া হয় । ভীষণই গম্ভীর প্রকৃতির । ইমনে একইসঙ্গে আনন্দ বেদনার মিলন ঘটে । গানের সুরে যেন কান্না ঝরে । মন চায় গাইতে । সন্ধ্যায় । দিনের অন্তিম আলাপন । ইমন রিক্ত প্রাণের আশ্রয় । নজরুল যেমন গেয়েছেন, "আমি দ্বার খুলে আর রাখব না, পালিয়ে যাবে গো"।

- আপনার পরিচয় যেদিন জানবো, সেদিন বলবো । আর আহীর ভৈরব?

- আহীর ভৈরব রাগটি ভীষণই জনপ্রিয় । ভোরবেলার রাগ।

আহীর অর্থ গোয়ালা।

- কমলপুরের মরাছড়ায় আহীর সম্প্রদায়ের লোক পেয়েছি । মোষ পালে ।

- হ্যাঁ । আহীররা সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । বিশেষ করে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে । অধিকাংশ আজকাল যাদব উপাধি লিখে ।

- উইকিপিডিয়াও তাই বলে ।

- ভৈরব কথার অর্থ ভয়ঙ্কর । ভয়াবহ । শিবের একটি বিশেষ রূপ । ব্রহ্মা জগতের সৃষ্টিকর্তা । প্রথমদিকে তাঁর পাঁচটি মুখ ছিল । তিনি শিবের থেকে নিজেকে বড় ভাবতেন । কথায় কথায় তাঁর অহঙ্কার ঝরে পড়তে । একদিন শিব রেগে গিয়ে ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তকটি কর্তন করেন । শিবের উপর ব্রহ্মহত্যার দোষ বর্তায় । তিনি ব্রহ্মার কাঁটা-মুন্ড নিয়ে ঘুরতে থাকেন । শেষে বারাণসীতে গিয়ে স্থিত হন । শিবের এই ভ্রাম্যমাণ রূপই ‘ভৈরব’।

- কিন্তু শিব কি সংগীত চর্চা করেন?

- ভৈরব গান করেন না, গান করান । কালভৈরব সময়ের শাসক। প্রতিটি হিন্দু মন্দিরে কালভৈরবের মূর্তি থাকে । মন্দিরের রক্ষক ।

হিসেবে বিবেচিত হন । শিব মন্দিরে কালভৈরব এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ওই মন্দিরের চাবির রক্ষক বলে গণ্য হন। অষ্টাঙ্গ ভৈরব । আটটি দিক দেখেন । অসিতাঙ্গ ভৈরব । রুরু ভৈরব । চণ্ড ভৈরব । ক্রোধ ভৈরব । উন্মত্ত ভৈরব । কপালি ভৈরব । ভীষণ ভৈরব । সংহার ভৈরব । সবমিলিয়ে ভৈরবের উদ্দেশে গীত । গম্ভীর মেজাজ । পাশাপাশি সম্পূর্ণ সমর্পণ । 'অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি, নীরবে হেসে দাঁড়াইলে এসে, প্রখর তেজ তব নেহারিতে নারি।'

- নজরুলের মত রবীন্দ্রনাথও ভৈরবকে ভয়াল কিন্তু সুন্দর রূপে কল্পনা করেছেন ।

"ভৈরব, তুমি কী বেশে এসেছ, ললাটে ফুঁসিছে নাগিনী, রুদ্র-বীণায় এই কি বাজিল সুপ্রভাতের রাগিণী?"

- ঠিক তাই! আমার মনে হয় পুরোটাই রূপক ! ভোরে আহীরেরা গ্রামে গ্রামে দুধ নিয়ে যায় । গরুর গলার ঘন্টা বাজে । আহীর ভৈরব রাগে সেই ভোরের সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে ।

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় । দেখি টিভি চলছে । মান্নাদের কন্ঠে, 'পুছো না ক্যাইসে ম্যা ইয়ে রাত বাতায়ে.....' গানটি বাজছে । সঙ্গে সিনেমার দৃশ্য । মনে আসে 'মেরি সুরত তেরি আঁখি' নামে একটি পুরানো হিন্দি ছবি দেখছিলাম । এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম । তবে সেই লোকটি কে ছিল ? কোমরে বাঘছাল । হাতে ত্রিশূল । আর কানে ধুতরো ফুল গুঁজে দিলে কালভৈরব মনে হত । কিংবা পঞ্চানন শিব ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.