আহোম রাজার মোগল বিরোধী তৎপরতা ও ত্রিপুরা
পান্নালাল রায়
আহোম রাজার মোগল বিরোধী তৎপরতার সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল 'ত্রিপুরা বুরঞ্জী'। পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার রাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বলেছেন এটি এক আশ্চর্য গ্ৰন্হ।রাজা নিজেই নাকি এই গ্ৰন্হটির ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কি সেই গ্ৰন্হ 'ত্রিপুরা বুরঞ্জী'? কখন কিভাবে লেখা হয়েছিল তা?এই গ্ৰন্হ রচনার সঙ্গে মোগল বিরোধী তৎপরতার যোগসূত্রই বা কি? এবার এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোঁজা যাক।
১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন আহোম রাজা স্বর্গদেব রুদ্র সিংহ। আহোম রাজাদের মধ্যে তাঁকে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি সামাজিক সংস্কার সহ সাংস্কৃতিক কর্মসূচি রূপায়ন সহ বাণিজ্য ক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন। সিংহাসনে আরোহণের আগে নরহত্যা, রাজাদের সমাধিতে জীবিত মানুষ পুঁতে রাখা ইত্যাদি অমানবিক প্রথারও অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি। ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্হাপন সহ সাংস্কৃতিক আদান প্রদানেও উদ্যোগী ছিলেন তিনি। এমনকি পাশাপাশি রাজ্য সমূহকে সঙ্গে নিয়ে মোগলদের পরাজিত করে এক সুদৃঢ় হিন্দু রাজ্য গঠনেও সচেষ্ট হয়েছিলেন তিনি। পূর্ব ভারতকে মোগল শৃঙ্খল মুক্ত করতে উদ্যোগের জন্য আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন 'পূর্ব ভারতের শিবাজি'। যাইহোক, মোগলদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়ে তিনি বিভিন্ন রাজ্যে রাজাদের কাছে এবং জমিদার বর্গের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন।এই কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে ১৭০৯ থেকে ১৭১৫ সালের মধ্যে তিনবার অসমের দুই রাজদূত ত্রিপুরা সফর করে। দুই আহোম রাজদূত রত্ন কন্দলী শর্মা ও অর্জুন দাস বৈরাগী ত্রিপুরা সফর করে যাবার প্রায় এক দশক পর 'ত্রিপুরা দেশর কথার লেখা' নামে রচনা করেন ত্রিপুরার সমকালীন ইতিহাস। সেসময় ত্রিপুরার সিংহাসনে ২য় রত্ন মানিক্য। সিংহাসন নিয়ে রাজপরিবারে ষড়যন্ত্র,অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করা, নৃশংস ভাবে রাজার হত্যা কান্ড সব কিছু নিঁখুতভাবে স্হান পেয়েছে রাজদূতদ্বয়ের ঐতিহাসিক বিবরণে। শুধু তাই নয়, সেদিনকার রাজধানী উদয়পুরের বিবরণ, রাজবাড়ী, মন্দির, পূজা পার্বণ, দোকানপাট, ঘরবাড়ি, পথঘাট সব কিছু উঠে এসেছে সেই বিবরণে। অসমের সুবিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড.সূর্য্যকুমার ভূঞা ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত সাঁচি পাতায় লেখা এই পান্ডুলিপি মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে সংগ্ৰহ করেন।১৯৩৮ সালে ড.ভূঞার সম্পাদনায় অসম সরকারের 'বুরঞ্জী ও পুরাতত্ত্ব' বিভাগ থেকে 'ত্রিপুরা বুরঞ্জী' নামে গ্ৰন্হটি প্রকাশিত হয়।গ্ৰন্হটিতে ত্রিপুরার অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকের ইতিহাস ধরা পড়েছে। বিশেষত ২য় রত্ন মানিক্যের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ রাজত্বকাল। পাশাপাশি উঠে এসেছে রাজ্য শাসন ব্যবস্থা সহ আর্থ সামাজিক চিত্রও।'ত্রিপুরা বুরঞ্জী' অসমে খুবই পরিচিত একটি গ্ৰন্হ। কিন্তু অসমে তার পঠন পাঠন ও প্রসার থাকলেও ত্রিপুরায় তেমনটি নয়। হয়তো অসমিয়া ভাষা এর প্রতিবন্ধক। তবে ১৯৬৫ সালে ত্রিপুরার বিশিষ্ট বিদ্যোৎসাহী ইতিহাসবিদ ত্রিপুর চন্দ্র সেন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে মাইক্রোফিল্মের মাধ্যমে আহোম দূতদ্বয়ের সেই পান্ডুলিপি আনিয়ে বাংলাতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন 'ত্রিপুরা দেশের কথা'।ত্রিপুরাতেও তারপর থেকে আহোম দূতদের সেদিনকার ত্রিপুরার বিবরণ নিয়ে চর্চা শুরু হয়। সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি ত্রিপুরার অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকের ইতিহাস আলোচনায় অপরিহার্য হয়ে পড়ে রত্নকন্দলী ও অর্জুন দাস বৈরাগীর বিবরণী। আবার ২০১২ সালে অসম সাহিত্য সভা 'ত্রিপুরা বুরঞ্জীর' অনুবাদ 'ত্রিপুরা দেশের কথা' গ্ৰন্হটি প্রকাশ করেন। অনুবাদ করেছেন মুক্তি চৌধুরী।বলাই বাহুল্য,অসম সাহিত্য সভা প্রকাশিত এই গ্ৰন্হটির মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যক উৎসাহী পাঠকদের নজরে আসবে ত্রিপুরার তদানীন্তন ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ।
মোগলদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক তৎপরতায় আহোম রাজা স্বর্গদেব রুদ্র সিংহ সেদিন অন্যান্য রাজ্যের মতো ত্রিপুরাতেও দূত পাঠিয়েছিলেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তখন মোগল সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ছে। এরকম একটা অনুকূল পরিস্থিতিতে হয়তো আহোম রাজা মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া সহ পূর্ব ভারতকে মোগলদের শৃঙ্খল মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।আর এজন্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোকেও তিনি সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। হয়তো ত্রিপুরার পূর্ববর্তী রাজাদের বীরত্বের কাহিনী,গৌড়বঙ্গের সঙ্গে অতীতে তাদের সংঘাত, অতীত ত্রিপুরার ভৌগোলিক সীমা ইত্যাদি আহোম রাজা রুদ্র সিংহকে ত্রিপুরার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে মিত্রতা স্হাপনের উদ্দেশ্যে প্রেরীত দূতদ্বয়ের উপর অতিরিক্ত কিছু দায়িত্বও দিয়েছিলেন রাজা। সেসময়ে ত্রিপুরার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।যদি মোগলদের বিরুদ্ধে সত্যিই কোনো যৌথ কর্মসূচি নেয়া হয় তবে ত্রিপুরা থেকে কতটা সাহায্য পাওয়া যেতে পারে তা যাচাই করাই হয়তো আহোম রাজার উদ্দেশ্য ছিল।
দুই আহোম রাজদূতের ভ্রমণ বিবরণীতে রয়েছে চমকপ্রদ নানা তথ্য। ত্রিপুরার রাজবাড়ির আভ্যন্তরীণ অবস্থা সহ নানা গোপনীয় তথ্য সংগ্রহে তারা যে পন্হা অবলম্বন করেছিলেন তা রীতিমতো কৌতুহলোদ্দীপক। ত্রিপুরার নানা তথ্য সংগ্রহে আহোম দূতগণ দু'জন গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন।১৭১২ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিলে ত্রিপুরার রাজা ২য় রত্ন মানিক্য আহোম দূতদ্বয়কে রাজদরবারে মধ্যে বরণ করেছিলেন।এটি ছিল দূতদের দ্বিতীয়বারের ত্রিপুরা সফর।আহোম দূতদের বিবরণীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্ভবত ত্রিপুরার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং সিংহাসন থেকে রাজাকে উৎখাতের অধ্যায়। রাজার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ঘনশ্যাম বড় ঠাকুর ২য় রত্ন মানিক্যকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে মহেন্দ্র মানিক্য নামধারণ পূর্বক ১৭১২ সালের মে মাসে সিংহাসনে বসেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র সহ সিংহাসনে রাজা বদলের সময়কালে আহোম দূতদ্বয় ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরে অবস্হান করছিলেন। এমনকি রাজাকে যে সিংহাসন থেকে টেনে নামানো হয়েছিল সেই ঘটনাও তাদের চোঁখের সামনেই ঘটেছিল। তারা লিখেছেন -"....এমন সময় ঘনশ্যামের প্রেরিত এবং বাঙ্গালা দেশ হইতে নবনিযুক্ত পীতাম্বর হাজারি অনুমান কুড়িজন হিন্দুস্হানী সঙ্গে লইয়া সিংহাসন ঘরে উঠিয়া রাজাকে বলিল,'তুমি সিংহাসন হইতে নামিয়া আস।ঘনশ্যাম ঠাকুর রাজা হইয়াছে।'.... তখন পীতাম্বর হাজারি রাজার হাত ধরিয়া তাহাকে সিংহাসন হইতে নামাইয়া আনিল।..."
আহোম রাজা রুদ্র সিংহের কূটনৈতিক তৎপরতা সূত্রে যদি দূতদ্বয় সেসময়ে ত্রিপুরা সফরে না আসতেন এবং তাদের সফর বিবরণী লিপিবদ্ধ না করতেন তবে আমরা হয়তো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র সহ রাজাকে সিংহাসন থেকে উৎখাতের ঘটনা এমন ভাবে জানতে পারতাম না।
আহোম রাজার দূত যেমন ত্রিপুরায় এসেছিল, তেমনই ত্রিপুরার রাজাও সেদিন অসমে দূত পাঠিয়েছিলেন। আমরা কিন্তু ত্রিপুরার দূতদের এই সফরের সূত্রে রুদ্র সিংহের রাজ্য সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। প্রথমে ত্রিপুরা থেকে রামেশ্বর ন্যায়ালঙ্কার ভট্টাচার্য ও উদয় নারায়ণ বিশ্বাস নামে দু'জন দূতকে পাঠানো হয়েছিল আহোম রাজার দরবারে। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাঠানো হয় অরিভীম নারায়ণকে। কিন্তু ত্রিপুরা থেকে পাঠানো দূতগণ তেমন কিছু লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন বলে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।কাজেই উল্লিখিত কূটনৈতিক তৎপরতা সূত্রে আমাদের যেটুকু জানা হয় তার সবটাই আহোম দূতদের বিবরণী থেকে। তারা সেদিনের ত্রিপুরা যাত্রাপথের বর্ণনাও দিয়েছিলেন। সেই বর্ণনায় রয়েছে খাসপুর,উদারবন,মখুরা (মথুরা),বরাক নদীর কথা।কাছাড়ি রাজা খাসপুরে খাওয়া দাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।কাছাড়-ত্রিপুরা সীমান্তে রূপিনী নদীর কথা উল্লেখ করেছেন আহোম দূতদ্বয়। ত্রিপুরায় পার্বত্য এলাকা,স্হানীয় অধিবাসী,পণ্যসামগ্ৰীর লভ্যতা ইত্যাদি প্রসঙ্গেরও উল্লেখ রয়েছে তাদের বর্ণনায়।দূতেরা দেবগাঙ্গ ও মনুগাঙ্গ নামে দুটি নদীর কথা উল্লেখ করে লিখেছেন-"...দেবগাঙ্গ নামে নদীতে বাঁশের ভেলায় করে ভাটির দিকে গিয়ে মনুগাঙ্গ দিয়ে উজানে চললেন।..."এই দুটি নদী যে দেও এবং মনু তা অবশ্য অনুমান করতে অসুবিধা হয়না।এই ভাবে সেদিনের অনেক নাম, পথঘাট বর্তমানে অনেক অনেক পাল্টে গেছে। তবু অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকের ত্রিপুরার দুর্গম যাত্রাপথের একটা ধারণা পাওয়া যায় আহোম দূতদের বর্ণনা থেকে।
মোগলদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হবার জন্য আহোম রাজার উদ্যোগ শেষপর্যন্ত কতটুকু সাফল্য পেয়েছিল তা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে ত্রিপুরার সঙ্গে মিত্রতা স্হাপনের সূত্রে দূত প্রেরণের ফলশ্রুতিতে আমাদের পাওনা হয় ত্রিপুরার ইতিহাসের উপকরণ।আহোম রাজা স্বর্গদেব রুদ্র সিংহ সেদিন ত্রিপুরার পাশাপাশি কোচবিহার সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের রাজা ও জমিদারদের কাছেও দূত প্রেরণ করেছিলেন। তিনি নিজের সেনাবাহিনীর শক্তি সহ অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি করেছিলেন।কাছাড় ও জয়ন্তিয়ার রাজা সহ অন্যান্য স্হানীয় জনজাতি লোকেরা তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল বলে জানা যায়।মোগল বিরোধী অভিযানে সামিল হতে কাছাড়ি রাজা চৌদ্দ হাজার ও জয়ন্তিয়ার রাজা দশ হাজার সৈন্য পাঠান। গুয়াহাটিতে এসে রুদ্র সিংহ সবমিলিয়ে চার লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর আহোম রাজার মোগল বিরোধী প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হলো না।অভিযানের আগেই ১৭১৪ সালে গুয়াহাটিতে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
যাইহোক, সেদিনের মোগল বিরোধী কূটনৈতিক তৎপরতার সূত্রে যেন ত্রিপুরার ইতিহাস আমাদের সামনে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সেই সূত্রেই লেখা হয়ে যায় 'ত্রিপুরা বুরুঞ্জী'।সূর্য্যকূমার ভূঞার লেখা সূত্রে জানা যায়, ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম বলেছিলেন-"এই 'ত্রিপুরা বুরঞ্জী' একটি আশ্চর্য গ্ৰন্হ। আমি নিজেই গ্ৰন্হটির ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেছি।"কিন্তু শেষপর্যন্ত তার পরিণতি সম্পর্কে আমাদের আর কিছু জানা নেই।আহোম রাজার মোগল বিরোধী অভিযান যেমন তাঁর মৃত্যুর জন্য বাস্তবায়িত হয়নি, তেমনই হয়তো ত্রিপুরার দূরদর্শী রাজার অকালমৃত্যুর জন্য সেদিন সম্পন্ন হয়নি 'ত্রিপুরা বুরঞ্জী'র ইংরেজি অনুবাদের কাজও!