পূর্বোত্তরে গান্ধীজিঃমালগাড়িতে যুক্ত কোচে করে শিলচরে

পান্নালাল রায়

রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় এসেছিলেন সাতবার। কিন্তু শিলচরে কবির আগমন ঘটেনি। অবশ্য গৌহাটি থেকে ট্রেনে করে সিলেট যাবার সময় বরাক উপত্যকার বদরপুর আর করিমগঞ্জ কবির সাক্ষাৎ পেয়েছিল। আবার শিলচরে গান্ধীজি এসেছিলেন। কিন্তু আগরতলাতে গান্ধীজির আগমন ঘটেনি। কুমিল্লায় অভয় আশ্রমে অবশ্য দুবার সফরে এসেছিলেন তিনি।

শিলচরের ইতিহাসে গান্ধীজির সফর নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এরপর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে শতবর্ষ। সেদিন মালগাড়ির সঙ্গে যুক্ত কোচে করে শিলচর পৌঁছেছিলেন গান্ধীজি। তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল তাও ধরা আছে ইতিহাসের পাতায়।মূলত কাদের উদ্যোগে গান্ধীজি শিলচর সফরে এসেছিলেন সেদিন, তাঁর যাত্রাপথ, শিলচরে অবস্হান,ফাটকবাজারে সভা সব কিছুই আজ ঐতিহাসিক দলিল। শুধুমাত্র উত্তরপূর্বাঞ্চলের উৎসাহীদের জন্য নয়,সামগ্ৰিক ভাবে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের তথ্যানুসন্ধানীদের কাছেও তা কম প্রয়োজনীয় নয়। এমনটাও জানা যায় যে, কাছাড়ের তৎকালীন ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সেদিন গান্ধীজির সফরের এক প্রচ্ছন্ন বিরোধিতা করেছিলেন।

দক্ষিণ অসমের বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক লেখক দেবব্রত দত্ত গান্ধীজির শিলচর সফরের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর এক সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে।১৯২১ সালের ২৭ ও ২৮ আগষ্ট ছিল শিলচরে গান্ধীজির সফর। সেবার অসহযোগের বাণী প্রচারের জন্য আসামে এসেছিলেন তিনি।শ্রীদত্ত লিখেছেন, কামিনী কুমার চন্দের মতো একজন নেতা ছিলেন বলেই গান্ধীজিকে শিলচর শহরে আনা সম্ভব হয়েছিল।কারণ কংগ্রেসের শীর্ষ স্তরের নেতাদের সঙ্গে কামিনী কুমার চন্দের খুবই হৃদ্যতা ছিল।

এরকম ঠিক হয়েছিল যে,ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গৌহাটি,তেজপুর,নগাঁও,জোরহাট ও ডিব্রুগড় ভ্রমণ শেষে গান্ধীজি শিলচর আসবেন।ট্রেনে করেই তিনি আসাম সফর করেছিলেন। কাছাড়ের তৎকালীন ডিভিশনাল কমিশনার চাইছিলেননা শিলচরে গান্ধীজি আসুন। তিনি কামিনী কুমার চন্দকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, গান্ধীজির সফরতো আনন্দেরই। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁর এখানে না আসাটাই ভালো।ডিভিশনাল কমিশনার আরও লিখেছিলেন, তাঁর পক্ষে চিঠি দিয়ে গান্ধীজিকে সফরে বারণ করা সম্ভব নয়।তাই চন্দ মহোদয়কে তিনি এজন্য গান্ধীজিকে চিঠি লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু চন্দ মহোদয় কমিশনারকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন যে, তাঁর পক্ষে এখন আর গান্ধীজিকে চিঠি লেখা সম্ভব নয়।তাই নির্দিষ্ট সফর সূচি অনুসারেই শিলচর এসেছিলেন গান্ধীজি।

গান্ধীজির সফরসঙ্গী কৃষ্ণদাসের লেখা Seven Months with Mahatma বইটি তথ্য সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে শ্রীদত্ত দীর্ঘকাল আগে লেখা তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন, এই বইটি না থাকলে গান্ধীজির শিলচর সফরের কথা লেখা সম্ভব হতো না।তাই এই সফর বিবরণের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে মোটিমুটি সন্দেহের অবকাশ নেই।

দুপুরে সদলবলে শিলচর রওয়ানা হলেন গান্ধীজি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শেঠ যমুনালাল বাজাজ,মৌলবী মহম্মদ আলি, মৌলানা আজাদ শোভানী প্রমুখ। বিশেষ কোনো গাড়ি নয়, সাধারণ গাড়িতেই তিনটি কামরা রাখা হয়েছিল তাদের জন্য। কিন্তু ডিব্রুগড় থেকে ট্রেনটি লামডিং পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। নির্দিষ্ট ট্রেনটি এর আগেই ছেড়ে যায় বদরপুরের দিকে। এবার কি হবে? শেষ পর্যন্ত বদরপুর গামী একটি মালগাড়ির সঙ্গে জুড়ে দেয়া হলো তিনটি কামরা।কৃষ্ণদাসের বর্ণনায়- প্রতিটি স্টেশনে গভীর রাতেও দলবদ্ধভাবে মানুষ এসেছিল গান্ধীজিকে দেখতে। সবাই গান্ধীজির নামে জয়ধ্বনি দিয়েছিল। একটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল লাট সাহেবের গাড়ি।অন্য সময় হলে তাই দেখতে ছুটে আসতো মানুষ। কিন্তু সেদিন সবাই ভিড় জমিয়েছিল গান্ধীজির গাড়ির সামনে। বদরপুর যখন গাড়ি এসে পৌঁছে তখন স্টেশন লোকে লোকারণ্য।শিলচর থেকেও অনেক লোক বদরপুরে ছুটে যান গান্ধীজিকে অভ্যর্থনা জানাতে।স্হানীয় মানুষেরা বদরপুরে স্টেশনের পাশেই গান্ধীজির একটি সভার ব্যবস্হা করেছিল। সেই সভার পরই ট্রেন যাত্রা শুরু করে শিলচরের দিকে।ধ্বনি উঠে'মহাত্মা গান্ধী কি জয়'।শিলচর আসার পথেও স্টেশনে স্টেশনে অভ্যর্থনা। হাজার হাজার মানুষ শুধু গান্ধীজিকে দেখতে চায়। যাত্রাপথে ট্রেনেও চলছিল একনাগাড়ে স্বদেশী গান।

রাতে যখন শিলচর এসে ট্রেন পৌঁছল তখন স্টেশনে জনঢল।

কামিনী কুমার চন্দের বাসভবনে অবস্হান করেছিলেন গান্ধীজি। পরদিন সকালে গান্ধীজিকে দেখতে লোকের ভীড়‌ সেখানে।গ্ৰামাঞ্চল ও চা বাগান থেকে হাজার হাজার মানুষ গান্ধীজিকে দেখতে ছুটে আসেন। এমনকি চাবাগানের সাহেবরাও গোপনে পাশের বাড়ি হয়ে দেখে যান গান্ধীজিকে। শিলচরে গান্ধীজির কর্মসূচি ছিল সংক্ষিপ্ত। ফাটক বাজারে তিনি একটি জনসভায় হিন্দিতে ভাষণ দিয়েছিলেন।জনসভা থেকে গান্ধীজি চলে যান ন্যাশনাল স্কুলটি দেখতে।সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুক্ষণের মধ্যেই সদলবলে সিলেট রওয়ানা হয়ে যান তিনি।

কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য তাঁর 'শিলচরের কড়চা' গ্ৰন্হে শৈশবের স্মৃতিচারণ করে গান্ধীজির শিলচর সফর সম্পর্কে লিখেছেন চন্দবাড়িতে ধুতি কামিজ পরা ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় তিনি দেখেছিলেন গান্ধীজিকে। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন আরও তিন জন।বিকেল তিনটায় ফাটক বাজারে ছিল জনসভা।সভার জন্য ফাঁকা জায়গায় উঁচু মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল।শ্রীভট্টাচার্য্য লিখেছেন,নিতান্ত শিশু বলে তিনিও মঞ্চে উঠার সুযোগ পেয়েছিলেন অভিভাবকের সঙ্গে। সেদিন দুপুর থেকেই ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই হাজার হাজার মানুষ সভাস্হলে উপস্হিত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, তখনকার সময়ে মাইকের কথা কল্পনাও করা যায় না। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাই বক্তৃতা করছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর পরনে ছিল ধুতি, গায়ে লম্বা কামিজ।

কৃষ্ণদাসের গ্ৰন্থ সূত্রে শ্রীদত্ত আরও লিখেছেন, গান্ধীজির সফরসঙ্গী মহম্মদ আলী জ্বালাময়ী ভাষণে বলেছিলেন, হিন্দুদের গায়ের বিলিতি কাপড়ের জামাটি গরুর চামড়ায় আর মুসলমানদের গায়ের বিলিতি কাপড়ের জামা ও টুপি শূকরের চামড়ায় তৈরি। তখন উপস্হিত অনেকেই জামা খুলে ছুঁড়ে ফেলেন।সভাস্হলেই আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এই জামার স্তূপে।

১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের প্রচারে গান্ধীজি আসাম সফরে এসেছিলেন। দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরায় তখন রাজতন্ত্রের শাসন হলেও ব্রিটিশ বাংলার ঘটনা প্রবাহের প্রভাবমুক্ত ছিল না ত্রিপুরা।ত্রিপুরাতেও সেদিন খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল।এই আন্দোলনের জন্য চাঁদা সংগ্রহে কিছু কর্মী আগরতলা এলে ত্রিপুরার রাজসরকার তাদের বহিষ্কারাদেশ জারি করে। শুধু আগরতলা নয়, ত্রিপুরার উত্তরাঞ্চলের কৈলাসহর, ধর্মনগর এবং দক্ষিণাঞ্চলের বিলোনিয়াতে অসহযোগ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। আগরতলায় মহাত্মা গান্ধীর পদার্পণ না ঘটলেও তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার কুমিল্লায় অভয় আশ্রমে গান্ধীজি দুবার সফরে এসেছিলেন ১৯২৫ ও ১৯২৭ সালে। বাংলার অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীবাদী অভয় আশ্রমের এক বিরাট প্রভাব ছিল। বৃটিশ সরকার তিনবার অভয় আশ্রমকে বেআইনি ঘোষণা করেছিল।সব মিলিয়ে গান্ধীজির সফর এই অঞ্চলের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.