"মঞ্চ আর পুরস্কারের বাসনা নিয়ে সাহিত্য করা চলে না।"
সৌম্যদীপ দেব
উত্তরপূর্বের বাংলা কথাসাহিত্য নিয়ে যাঁর কাজ ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। গল্প-প্রবন্ধ-উপন্যাস সবেতেই যাঁর সমান পদচারণা, তিনি লেখক সৌম্যদীপ দেব। আজ তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অশেষ সেনগুপ্ত।
অশেষ : প্রথমেই যেটা জানতে চাই, জেনারেশন জেড যখন ইংরেজি ও হিন্দির প্রতি প্রবল আসক্ত, যখন সময়ে বুদ্ধিজীবী মহল বাংলা ভাষা গেলো গেলো রব তুলছেন স্বচ্ছন্দের সঙ্গে সেই সময়ে আপনার একের পর এক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে চলেছে। পাঠক মহলে আপনার লেখালেখি নিয়ে যথেষ্ট ইতিবাচক গুঞ্জন শুনতে পাই৷ কীভাবে এপথে আসা ? বাড়িতেও কী আগে থেকেই লেখালেখির পরিবেশ পেয়েছিলেন ?
সৌম্য : এই যে প্রশ্নটা তা-ও কি বাঙালি আর বাংলা ভাষায় লিখি বলেই। আজ ইংরেজি বা হিন্দি আমার লেখার ভাষা হলে কী একই করা হতো! ভাষাগত আগ্রাসনের মুখেই আঞ্চলিক ভাষারা টিকে থাকে। তবে বাংলা ভাষাকে শুধু আঞ্চলিক বলতে আমি নারাজ। পৃথিবীর কোণায় কোণায় আজ বাংলা ভাষার চর্চা হয়। বিভিন্ন দেশ-মহাদেশে বাংলা স্বীকৃতি পাচ্ছে। সিরিয়াস পাঠক সেকালেও ছিল, একালেও আছে। নিজেদের বোধকে যদি আমরা এই স্বীকৃতি বোধে উন্নীত করতে পারি তাহলে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ বিপদ কেটে যাবে, তা নিশ্চিত।
কীভাবে এ-পথে তা আর সেভাবে মনে নেই। তবে বাড়িতে চিন্তাচর্চার নিবিড় পরিবেশ বরাবরই ছিল। উচ্চ মার্গের সাহিত্য-সমাজমনস্ক স্থিতধী পরিবেশ। আমার এক দাদু অসম্ভব শাস্ত্র জ্ঞানী ছিলেন। ছোটবেলায় বহু গল্প শুনেছি। তিনি লেখালেখিও করতেন কিছু কিছু। বাবা-পিসিরা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ছোট থেকে বাবার প্রচুর বইয়ের সংগ্রহ দেখেছি। কয়েক হাজার বই। এক পিসি সেই সময়ে সংস্কৃতে স্নাতকোত্তরে গোল্ড মেডেলিস্ট ছিলেন। বাকিরা প্রায় সকলেই শিক্ষা বিভাগে কর্মরত। পড়াশোনার জন্য কখনও বকা খেতে হয়নি এটুকু মনে আছে।
অশেষ : নানান আলোচনায় একাধিকবার আপনি বলেছেন 'সমালোচনা সাহিত্য সাহিত্যের গতিপথ নির্ধারণ করে।' — ত্রিপুরায় বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের বর্তমান গতিপ্রকৃতি নিয়ে কী বলবেন?
সৌম্য : ফলিত সূর্যের প্রতি বেশি টান থাকলে নিজেকে, নিজের অঞ্চলকে নামান্তরে উপেক্ষা করাই হয়ে থাকে। এখানে বছরে প্রবন্ধের বইয়ের তুলনায় গল্প-উপন্যাস ও কবিতার সংকলন প্রকাশের হার দেখলেই তা বুঝতে পারবে। বেশ কয়েকজন অবশ্যই প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। এটুকু বলতে পারি সিরিয়াস প্রবন্ধে সাম্প্রতিককালে শুধু ত্রিপুরা নয়, সমগ্র উপরপূর্বেই লেখকের বড্ড অভাব।
অশেষ : বায়োগ্রাফিকেল নভেলকে অনেক নেটিজেন দ্বিতীয় শ্রেণির নভেল বলেন। জীবনীমূলক উপন্যাস 'উপন্যাস' হিসেবে কতটা বিবেচ্য? আপনার গবেষণা কর্ম উপন্যাস নিয়ে। এবিষয়ে কী বলবেন?
সৌম্য : না না এটা একেবারেই সত্য নয়। যাকে নিয়ে লেখা হবে, আর যিনি লিখবেন ; তিনি যদি ওই সত্তায় নিজেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেন তাহলে সেই আখ্যান নিয়ে আর প্রশ্ন তৈরি হতে পারে না। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যেও এমন বহু নজির আছে, আরভিং স্টোনের ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের জীবন নিয়ে লেখা 'লাস্ট ফর লাইফ' বা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের জীবন অবলম্বনে 'দ্যা পেশনস্ অফ দ্যা মাইন্ড'। কিংবা বাংলা সাহিত্যে সমরেশ বসুর কালজয়ী উপন্যাস শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে 'দেখি নাই ফিরে', সমীরণ দাসের লেখা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন অবলম্বনে 'মধুময় তামরস', গান্ধীজির জীবনী অবলম্বনে 'প্রভু আমার প্রিয়' প্রভৃতি। আসলে মুখ্য হল সমর্পণ। জোয়ারে নাও বাইবার ক্ষমতা যিনি রাখেন জোয়ারের জল তাকে অসফল হতে দেয় না।
অশেষ : 'ঈশান কোণের ভয়' শুধু ত্রিপুরা নয়, সমগ্র উপরপূর্বেই প্রথম অলৌকিক গল্পের সংকলন। পাঠক মহলে কেমন সাড়া পেয়েছেন? আমরা দেখেছি আপনি বরাবর সামাজিক গল্পই বেশি লেখেন, বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রিকাতেও আপনি লিখেছেন। অলৌকিক নিয়ে কাজটি করবেন কেনো মনে হয়েছিল?
সৌম্য : হ্যাঁ, পাঠক যথেষ্ট ভালো সাড়া দিয়েছেন। বইটি ভালো বিক্রি হচ্ছে বলেই শুনেছি। অনেকেই সংগ্রহ করেছেন। প্রথম কাজ হিসেবে পাঠক যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন — আমরা তা পূরণ করতে চেষ্টা করেছি। এটা ঠিকই আমি সামাজিক গল্পই হয়তো তুলনায় বেশি লিখেছি এখন পর্যন্ত, তবে আমার বেশকিছু অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ভাবনাচিন্তা নির্ভর গল্প রয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। মনে কিছুই হয়নি, কাজটি সময়ের দাবি। লেখকরাই সহায়তা করেছেন। পালক পাবলিশার্সের অন্যতম কর্ণধার কবি তন্ময় মণ্ডলের একান্ত আগ্রহ এবং প্রশ্রয় পাশে ছিল।
অশেষ : উপন্যাসে চরিত্রের ঘনঘটা সবসময়ই লক্ষ করা যায়। চরিত্র কখনও আখ্যানের চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে ?
সৌম্য : অবশ্যই। আখ্যানের কথক চরিত্রকে মাঠে নামানোর পর তার কথা মতোই কাহিনি এগোয়। কথক তখন তার সৃষ্ট চরিত্রের দর্শক মাত্র। কিছুই করার থাকে না। পিছিয়ে আসারও উপায় নেই। চরিত্র হয়ে ওঠে একমাত্র নিমন্ত্রক। তাকে উপেক্ষা করা যায় না। দাবি মানতেই হয়। আমিও পারিনি উপেক্ষা করতে, করা যায় না৷
অশেষ : সম্প্রতি সাহিত্য মহলে কেউ কেউ বলছেন সৌম্যদীপ দেব উপন্যাস নিয়ে বেশকিছু গবেষণাধর্মী কাজ করার পর এবার উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছেন। তা কি ঠিক? আপনার পাঠক জানতে চায়।
সৌম্য : কী বলি বলো। যে করিয়ে নেওয়ার সে যদি করিয়ে নেয়। যেখানে 'আমার' আর 'আমি' শব্দবন্ধ বড্ড তুচ্ছ। উপন্যাস — সে তো আমার পছন্দের। ঘর-সংসার কেউ কেউ বলেন। উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এর বেশি এখন কিছু বলবো না।
অশেষ : শতাব্দীর গল্প চর্চা। ত্রিপুরার গল্পের একশো বছরের স্মারক। অতীতকে পুনর্নির্মাণ। উত্তরপূর্বের উপন্যাসে দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন নীরিক্ষা — এহেন কিছু কাজও আপনার ঝুলিতে। মান্যজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কেমন ছিল কাজগুলির অভিজ্ঞতা যদি আমাদের বলেন।
সৌম্য : কাজ করার সময়ের কষ্ট পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলে ভুলে যাই। তবে এটা ঠিক একাডেমিক রিসার্চ ওয়ার্ক ধর্মী কাজ করা এখানে খুব সমস্যা। না আছে আর্কাইভ, না বিশেষ সংগ্রহশালা। আমাদের ভরসার জায়গা 'রমাপ্রসাদ গবেষণাগারে'র অব্যবস্থা দেখলে কষ্ট হয়। প্রজন্মকে ভুগতে হবে।
অশেষ : আপনার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে লক্ষ করেছি আপনি বরাবর ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের থেকেও ব্যক্তির কাজকেই বেশি প্রাধান্য দেন। এটা সাহিত্যিকের ঔদার্য বলা যেতেই পারে। — এই কাজের সূত্র ধরেই আপনার পাঠক জানতে চায় নতুন কী কী কাজ আমরা পেতে চলেছি?
সৌম্য : হ্যাঁ, এটা আমি বিশ্বাস করি কাজ, একমাত্র কাজই জীবনের শেষ কথা। নতুন বলতে উপন্যাসে দেশভাগ নিয়ে একটি কাজ প্রকাশকের টেবিলে আছে। এছাড়া 'ত্রিপুরা : নারীবাদের নানা পরিসর' ও 'ত্রিপুরার ছক ভাঙা গল্প' কলকাতা থেকে বেরোচ্ছে। আরও কিছু আছে এখন বলছি না।
অশেষ : 'পুরস্কার শ্রেষ্ঠ কাজের একমাত্র স্মারক' — কথাটি বিশ্বাস করেন না কেনো?
সৌম্য : পৃথিবীতে কোনও পুরস্কারই উপযুক্ত ব্যক্তি বিশেষে, উপযুক্ত শ্রম ও উপযুক্ত সময়ের নিরিখে সমকালের যোগ্যজনের প্রতি বিবেচিত হয় না। পুরস্কারের পেছনে বহু কেচ্ছা থাকে। আর এই 'উপযুক্ত' শব্দটির তাৎপর্যে পুরস্কার ব্যক্তির কাজের যোগ্য মূল্যায়ন করতে পারে না। মঞ্চ আর পুরস্কারের বাসনা নিয়ে সাহিত্য করা চলে না। হ্যাঁ, এটাও ঠিক পুরস্কার কাজের প্রতি উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করে।
অশেষ : যদি বলা হয়, ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের দুটি বড় অন্তরায় নির্ধারণ করতে তাহলে কোন দুটির কথা বলবেন?
সৌম্য : প্রত্যন্ত পার্বত্য রাজ্য এই অভিধা আমাদের ঘুচেনি, ফলত সমস্যা তো থাকবেই। অনুবাদ সাহিত্য একটি ভাষা-অঞ্চলের সাহিত্যের বিকাশে বড়ো ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্রনাথ নিজে যদি 'গীতাঞ্জলি'র অনুবাদ না করতেন এবং সেই পাণ্ডুলিপি যদি তখন ইয়েটসের কাছে গিয়ে না পৌঁছত, তাহলে ১৯১৩ সালে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অন্যরকম হতো। যার মূলে অনুবাদ সাহিত্য। পৃথিবীর বিভিন্ন নামজাদা আন্তর্জাতিক পুরস্কারের কিছু কিছু বাংলা সাহিত্যে এসেছে যার বেশিরভাগ অনুবাদ সাহিত্যের জন্যই। তাই অনুবাদ সাহিত্য ও সমালোচনা সাহিত্য ভাষা-অঞ্চলভেদে তাৎপর্যপূর্ণ।
অশেষ : আপনার অসংখ্য প্রবন্ধ ও পুস্তক পর্যালোচনা বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিদগ্ধ আলোচকদের কেউ কেউ বলেন লেখকের নিজস্ব ভাষার কথা। আপনার লেখার একটা স্বতন্ত্র শৈলী আছে৷ নিজস্ব নির্মিতির ভাষা আমরা লক্ষ করেছি। ভাষারীতি লেখকের একটা সিগনেচার। কী বলবেন? কীভাবে এই একান্ত নিজস্ব ভাষা রীতি তৈরি হল?
সৌম্য : হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো তিনশোর অধিক বইয়ের রিভিউ করেছি। ভাষা বললে আমার মনে হয় লেঙ্গুয়েজ পলিটিক্সের কথা। সাহিত্যে ভাষার নিরীক্ষা সহজ নয়। প্রত্যেক লেখকের একটা নিজস্ব ভাষা-গঠন শৈলী থাকে। থাকা প্রয়োজনও। অবশ্যই সিগনেচার বলা যেতে পারে। তুমি কার্তিক লাহিড়ী, দুলাল ঘোষ, কিশোর রঞ্জন দে, সুতপা দাস, পল্লব ভট্টাচার্যের কথাসাহিত্য দেখলে বুঝতে পারবে, তেমনি পারবে শ্যামল বৈদ্য, শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ, প্রবুদ্ধ সুন্দর কর, অলক দাশগুপ্ত বা শ্যামল ভট্টাচার্য প্রমুখের লেখা থেকে। চেষ্টা করি নিজস্ব রীতিতে বলতে। তবে আরও অনেকেই এটা আমায় বলেছেন। তোমার এই পর্যবেক্ষণকে ধন্যবাদ।
অশেষ : শেষ প্রশ্ন, নিজের লেখার পাশাপাশি যেহেতু সমালোচনা সাহিত্যে কাজ করেন ফলত প্রচুর পড়তে হয়। সময় বড়ো ফ্যাক্টর। কীভাবে সবটা ম্যানেজ করেন ?
সৌম্য : পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে যেতে হয়। সব লেখকই প্রথমে একজন পাঠক, পরে লেখক। গল্প-উপন্যাস বেশি পড়ি। তবে আমি খুব সিলেক্টিভ। যা পাই তা-ই পড়ি এমনটা নয়, পছন্দ না হলে পড়ি না। সময়ের টানাপোড়েন থাকলেও ম্যানেজ হয়ে যায়। মন থেকে কিছু করতে চাইলে তার জন্য সময়ের অভাব হয় না — এটা বিশ্বাস করি।