সুদূর অতীতে প্রান্তীয় রাজ্য সমূহে দুর্গা পূজা
পান্নালাল রায়
দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা।তাই দুর্গা পূজার সঙ্গে যেন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ তৈরি হয়ে আছে সূচনা লগ্ন থেকেই। ইতিহাস, কিংবদন্তি কিংবা পুরাণও তার স্বাক্ষ্য দেয়।রাজ্যভ্রষ্ট রাজা সুরথ দেবীর পূজা করেছিলেন তাঁর রাজ্য উদ্ধারের জন্য। আবার সীতাকে ফিরে পাবার জন্য রামচন্দ্র করেছিলেন দেবীর অকাল বোধন।
সুদূর অতীতে রাজা -মহারাজা আর সম্পন্ন জমিদাররাই দুর্গা পূজা করতেন।কখনও যুদ্ধ জয়ের জন্য, কখনও রাজ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য কিংবা জমিদারী পরিচালনা নিষ্কন্টক রাখার জন্য দুর্গার আরাধনা হতো। কোচবিহার, অসম, ত্রিপুরা,কাছাড়, জয়ন্তিয়া - বাংলার এই সব প্রান্তীয় রাজ্যগুলোতেও দুর্গা পূজার ইতিহাস অনেক পুরনো। এমনকি,একদা রাজন্য যুগে এই সব প্রাচীন রাজ্যে দুর্গা পূজায় নরবলির ঘটনাও ঘটতো!
কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ সিংহ দুর্গা পূজার নবমী তিথিতে নরবলি দিতেন।বলির উদ্দেশ্যে নির্বাচিত মানুষটিকে কয়েক মাস আগেই রাজবাড়ীতে নিয়ে আসা হতো। তখন রাজা তাকে অবাধ ক্ষমতা দিতেন।বলির পূর্বে কয়মাস সে যা খুশি তা,যে কোনো নারীকে ধর্ষণ পর্যন্ত করতে পারতো। এজন্য তার কোনো শাস্তি হতো না।অসমেও রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতায় সুদূর অতীত থেকে দুর্গা পূজা চলে আসছে। অসমের ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ষোড়শ শতকে মূলত কোচদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণেই অসমে দুর্গা পূজার প্রচলন হয়। দুর্গা দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ার প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আহোম রাজা তাঁর রাজ্যের শিল্পীদের কোচ রাজ্যে পাঠিয়েছিলেন বলে অসম ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। অষ্টাদশ শতকে অসমে দুর্গা পূজার বর্ণনা রয়েছে 'ত্রিপুরা দেশের কথা'য়। আহোম রাজা স্বর্গদেব রুদ্র সিংহ'র দূত হিসেবে রত্নকন্দলী শর্মা ও অর্জুন দাস বৈরাগী ১৭০৯ থেকে ১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তিনবার ত্রিপুরা রাজ্য সফর করেছিলেন। তাদের সফরের ভিত্তিতেই রচিত হয় 'ত্রিপুরা দেশের কথা'।আহোম দূতদের সফর বিবরণী সূত্রে জানা যায়, আহোম রাজার দুর্গা পূজায় গান,পন্ডিতদের মধ্যে তর্কযুদ্ধ ইত্যাদির আয়োজন হতো।
পঞ্চদশ শতকে ত্রিপুরার রাজা ছিলেন রত্ন মানিক্য।এ যাবৎ আবিষ্কৃত মুদ্রা অনুসারে বলা যায় ত্রিপুরার রাজা রত্ন মানিক্যই প্রথম মুদ্রা প্রস্তুত ও প্রচার করেছিলেন। সেই মুদ্রায় শ্রীদুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রিপুরায় ষোড়শ শতকে রাজত্ব করেছিলেন বিজয় মানিক্য।মধ্যযুগের ইতিহাসের এই বীর নৃপতির যুদ্ধ বিজয়ের স্মারক মুদ্রায় শিব দুর্গার ছবি যেন দুর্গা পূজার রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার কথাই মনে করিয়ে দেয়।মধ্য যুগের অপর বীর নৃপতি অমর মানিক্যের আমলেও সাড়ম্বরে দুর্গোৎসব হতো এবং এ উপলক্ষে যে নরবলিরও প্রচলন ছিল তার তথ্য পাওয়া যায়'রাজমালা'তে। ত্রিপুরার অতীত ইতিহাস এবং প্রত্নসম্পদে মহিষাসুর মর্দ্দিনী, সিংহবাহিনী দেবীর আরাধনার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। ঊনকোটি পাহাড়ের গায়ে খোদিত আছেন সিংহ বাহিনী দেবী দুর্গা।দেবতামুড়া পাহাড়ের গায়ে খোদিত আছেন মহিষাসুর মর্দ্দিনী।
ডিমাছা রাজ্য কাছাড়েও একদা দুর্গা পূজার মহাষ্টমী তিথিতে নরবলির প্রচলন ছিল। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে রাজা সুরদর্প নারায়ণ নরবলি বন্ধ করে দেন। কথিত আছে একবার বলি সংগ্ৰহ করতে না পেরে রাজার অনুচররা এক অচেনা ব্রাক্ষ্মণকে ধরে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু রাজার কাছে এই কান্ড ধরা পড়ে যায়।ব্রাক্ষ্মণ বলির মতো দুর্ঘটনা এড়াতেই রাজা নরবলি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যাইহোক, বলির জন্য ধরে আনা এই ব্রাক্ষ্মণই পরবর্তী সময়ে ডিমাছা রাজসভার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।কবির নাম ভুবনেশ্বর বাচস্পতি। তাঁর অমর সাহিত্য কীর্তি হচ্ছে 'শ্রীনারদি রসামৃত'।
অতীতের জয়ন্তিয়া রাজ্যে দুর্গা পূজার সময় নরবলি হতো। সেখানে নাকি স্বেচ্ছায় বলি এসে হাজির হতো।এসে বলতো, দেবতার কাছে উৎসর্গ হতে সে এসেছে।বলি উপযুক্ত মনে হলে রাজা স্বর্ণ নূপুর দিয়ে তাকে গ্ৰহণ করতেন। দুর্গা পূজার নবমী তিথিতে এই নরবলি হতো। রাজপরিবারের সদস্যরা বলির রক্ত মেশানো অন্নভোগ মহা প্রসাদ রূপে গ্ৰহণ করতেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় বলি এসে হাজির না হলে কি দুর্গা পূজায় নরবলি বন্ধ থাকতো? না,সে ক্ষেত্রে রাজার চরগণ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গোপনে মানুষ ধরে নিয়ে আসতো বলির জন্য।আর এ ভাবেই ব্রিটিশ এলাকা থেকে মানুষ ধরে এনে বলি দেয়ার অভিযোগে ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে রাজ্যচ্যুত হয়েছিলেন জয়ন্তিয়ার রাজা রাজেন্দ্র সিংহ।
দুর্গা পূজা নিয়ে এরকম নানা তথ্য ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। রাজা মহারাজা থেকে জমিদারীর যুগেও বীরত্ব আর বৈভবের কাহিনি।রাজপ্রাসাদ কিংবা জমিদার বাড়ির আঙিনা থেকে দেবী দুর্গা অবশ্য এখন নেমে এসেছেন সাধারণের মাঝে। পূজা এখন সার্বজনীন।তাই দুর্গ কিংবা যুদ্ধের আবহ নেই।সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি আর আনন্দের জন্য পূজা আজ উৎসবে রূপান্তরিত। তবে বৈভবের প্রদর্শন আছে।ক্লাবে ক্লাবে থিম পূজা যেন এক বর্ণাঢ্য প্রদর্শনী,যা কিনা আজকের দিনের উৎসবের অঙ্গ।আর এই বৈভব প্রদর্শনের ভিত্তি হচ্ছে জনগণের চাঁদা।