ত্রিপুরায় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব

পান্নালাল রায়

দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরাতেও বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের ছোঁয়া লেগেছিল। প্রভাব পড়েছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের।গড়ে উঠেছিল অনুশীলন সমিতির শাখা। একসময় বিপ্লবীদের আশ্রয়স্হল হয়ে উঠেছিল এই দেশীয় রাজ্যটি। বিপ্লবীদের অস্ত্রের মহড়াও চলতো ত্রিপুরার পাহাড়ে। কালক্রমে স্বদেশী তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যটিতে। বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত হয় অসহযোগ আন্দোলন। ত্রিপুরায়ও ভ্রাতৃসংঘ গড়ে উঠেছিল যুগান্তর পার্টির ভাবাদর্শে। তাদের বিপ্লবী তৎপরতা চলতো গোপনে গোপনে। এইভাবে দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরা সেদিন কিছুটা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। এদিকে সামন্ততান্ত্রিক শাসন-শোসনের বিরুদ্ধে ১৯৪২-৪৩ সালে ত্রিপুরায় রতনমণির নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া আদিবাসী রিয়াং বিদ্রোহকেও পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। রতনমণির শিষ্য বিদ্রোহীদের সেসময়েও স্বদেশী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল।১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহেরও ছোঁয়া লেগেছিল দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরায়। চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহিরা সেদিন ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলের ভেতর দিয়ে সিলেট হয়ে কাছাড়ের দিকে ধাবিত হয়েছিল। পার্বত্য অঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাবার পথে বিদ্রোহী সিপাহিরা সেদিন ত্রিপুরার আদিবাসীদের সাহায্য সহায়তা পেয়েছিল।

ত্রিপুরার রাজাদেরও কেউ কেউ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নীরব সমর্থক ছিলেন বলেও মনে করা হয়। সেদিন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রাখী বন্ধন উৎসবের প্রভাব পড়েছিল আগরতলায়। ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির সংবাদে রাজপরিবারের অনেকেই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে তদানীন্তন রাজা রাধাকিশোর মাণিক্যও এর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। চারণ কবি মুকুন্দ দাস আগরতলায় এসে গান গেয়ে দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত করেছিলেন সবাইকে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঢাকায় জন্ম নিয়েছিল অনুশীলন সমিতি।সেই সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সেদিন পার্বত্য ত্রিপুরার উদয়পুর ও বিলোনিয়ায় দুটি কেন্দ্র স্হাপিত হয়েছিল। বাইরে থেকে দেখতে এগুলো খামার বাড়ির মতো মনে হলেও তা ছিল বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। দিনে ছিল চাষবাস আর রাতে নিকটবর্তী জঙ্গলে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো তাদের। পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ এলাকার বিপ্লবীরা অনেক সময় পালিয়ে এসে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতেন। তখন স্হানীয় আদিবাসীরাও এদের সাহায্য করত।আর এভাবে ব্রিটিশ বিরোধী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল ত্রিপুরাও। বিপ্লবীদের প্রতি রাজার গোপন সহানুভূতি ছিল বলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রায়ই ত্রিপুরার রাজ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করত। কালক্রমে পার্বত্য ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বদেশীদের তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ে।প্রভাব পড়ে অসহযোগ আন্দোলনের।

চাঁদপুরে করিমগঞ্জের চরগোলার অসহায় চা শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশ পুলিশের হামলার প্রতিবাদে যে রেল ধর্মঘট হয়েছিল তাকে কেন্দ্র করে আখাউড়ায় হরতাল পালিত হয়।আগরতলায় বাজার বয়কটের ডাক দেয়া হয়। এদিকে বিলোনিয়া, ধর্মনগর,কৈলাসহরে অসহযোগ আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে। বিভিন্ন অঞ্চলে সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার সীমান্তে যাতে এ ধরনের তৎপরতা,সভা-সমাবেশ না হতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ত্রিপুরার রাজপ্রশাসনকে নির্দেশ দেয় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। সরকারি বিচার ব্যবস্থাকে বয়কট করার উদ্দেশ্যে কৈলাসহরে একটি ধর্ম সভা স্হাপিত হলে ত্রিপুরা সরকার তা বন্ধ করে দেয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোগী অনন্ত সিংহ সম্ভবত ১৯২২ সালে আগরতলায় রাজপ্রাসাদের অস্ত্রাগার থেকে উমেশলাল সিংহ সহ কয়েকজন স্হানীয় ব্যক্তির সহযোগিতায় প্রচুর পরিমাণে পিস্তলের গুলি সংগ্ৰহ করেন।আগরতলায় অনুশীলন সমিতির যে শাখা স্হাপিত হয় তার প্রধান কাজ ছিল ব্রিটিশ এলাকা থেকে পুলিশের তাড়া খেয়ে আসা বিপ্লবীদের ত্রিপুরায় আশ্রয় দান সহ গোপন যোগাযোগে সহায়তা করা। অনুশীলন সমিতির তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে সদস্যদের কয়েকজনকে বন্দি করা হয়।১৯২৮ সালে ত্রিপুরায় শরীর চর্চা ও সংস্কৃতি চর্চার নামে ভ্রাতৃসংঘ গঠিত হলেও মূলত এটি ছিল ত্রিপুরায় বিপ্লবীদের প্রধান আখড়া। যুগান্তর পার্টির ভাবাদর্শে গঠিত এই সংঘের শাখা ছড়িয়ে পড়েছিল রাজ্যের সর্বত্র।প্রকাশ্যে সমাজসেবা মূলক কাজ করলেও গোপনে ছিল তাদের বিপ্লবী তৎপরতা। দূরবর্তী স্হানে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্হাও ছিল। ত্রিপুরার বিপ্লবীদের অনেকে গ্ৰেপ্তার হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন আন্দামানের সেলুলার জেলেও বন্দি ছিলেন।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.