মহারাজা বীরবিক্রম ও একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর আখ্যান
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
আজ ১৯শে আগস্ট ত্রিপুরা সর্বশেষ সিংহাসনাসীন মহারাজা বীরবিক্রম' এর ১১৪তম জন্মদিবস। আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার বীর বিক্রম অল্প বয়সেই প্রয়াত হন। ত্রিপুরার এই ১৭৮তম রাজার জন্মদিবস এখন সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষিত। রাজ্য সরকারের এই বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশংসনীয়। গত শতকের সত্তর দশকের সময় থেকেই ত্রিপুরার রাজ পরিবার সম্পর্কে একটা সিস্টেম্যাটিক নেগেটিভ ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিল। আর প্রাসঙ্গিক ভাবেই এই নেতিবাচক অভিযানের অংশ হিসেবে ফেনিয়ে তোলা হয়েছিল ত্রিপুরি জনজাতির প্রাচীনত্ব নিয়েও ঘোর সংশয়। ত্রিপুরার ডান এবং বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ ত্রিপুরি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার শুরু করে। এই বিষোদ্গার চলছে আজও এবং মাঝে মধ্যে তা অশ্লীলতার সীমাও ছাড়িয়ে যায় ! ত্রিপুরি রাজ পরিবারের যাবতীয় কৃতিত্বকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা এবং নস্যাৎ করাই যেন এদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।
তবে এক সময় চেপে চুপে রাখা হলেও আজ বিশ্বব্যাপী এই আন্তর্জালের সময়ে ত্রিপুরি রাজবংশ কিম্বা এই জন গোষ্ঠীর প্রাচীনত্ব বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যাদি এবং সম্বাদ এখন নথীবদ্ধ আকারে সহজলভ্য। প্রাচীন ত্রিপুরা বিষয়ক বিভিন্ন মূল্যবান গবেষণা ধর্মী কাজগুলি করে গিয়েছেন অল্প কয়েকজন ব্রিটিশ, মোঘল সহ সুপন্ডিত বাঙালি লেখক এবং গবেষক। ত্রিপুরিদের সম্পর্কে ব্রিটিশদের ধারণা স্পষ্ট হয় এই লেখায়, "The physiognomy of some of the Tripuris is like that of the Manipuris. But the greater part bears more resemblance to the Khasias (now called Khasis), having strongly marked Mongolian features with flat faces. and thick lips. They are not shorter in stature than Bengalis and far more muscular and strongly made. Many of them have fair complexion slightly darker than a swarthy European." (Observation of Dalton : quoting Major Fisher from his Memoirs of Sylhet)।আকবরের সভাসদ এবং পন্ডিত আবুলফজল 'আইনি-ই- আকবরী'তে উল্লেখ করেছেন সামরিক শক্তি হিসেবে অমিত পরাক্রমশালী ত্রিপুরার কথা। (সূত্র : Raatan, T. (2008). Encyclopaedia of North-East India. Gyan Publishing House) ।
তবে প্রাচীন ত্রিপুরার ইতিহাস নথীবদ্ধকরণে বাঙালি লেখক এবং গবেষকদেরই অবদান বেশি বলে এঁদের প্রতি ত্রিপুরি জন গোষ্ঠীর কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। শুক্রেশ্বর, বাণেশ্বর, কালী প্রসন্ন সেন, কৈলাশ চন্দ্র সিংহ, ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, শ্রী দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, শ্রী সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় , কুমুদ কুণ্ডু চৌধুরী, ডাঃ জগদীশ গণচৌধুরী প্রমুখ পন্ডিত ব্যক্তিরা প্রাচীন ত্রিপুরার বহু ঐতিহাসিক তথ্য নথীবদ্ধ করে গিয়েছেন এবং এইসময়েও বহু গবেষক কাজ করে চলেছেন। প্রাচীন ত্রিপুরার ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণে এঁদের অবদান সবসময়ই স্মর্তব্য। তারপরেও কিন্তু ত্রিপুরার রাজপরিবার এবং এই জনগোষ্ঠীর প্রাচীনত্ব নিয়ে ত্রিপুরার কতিপয় ডান এবং বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার বন্ধ হয়নি। বিভীষণের মতো মুষ্টিমেয় কয়েকজন ত্রিপুরির উস্কানিতে এরা আরও উৎসাহিত হয়েছে।
ত্রিপুরা প্রসঙ্গে বর্ণিত ভারতীয় শাস্ত্রগুলির কথা বলার আগে এটুকু বলিমিং রাজত্বের সময় লিখিত চাই নিজ রাজবংশের ইতিহাস 'মিংশিলু 'তে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে ত্রিপুরার নাম। ত্রিপুরিদের উল্লেখ করা হয়েছে "দি-উ-লা" নামে। মিংশিলু'তে উল্লিখিত এই তথ্য নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই। পরবর্তীকালে ভারতীয় শাস্ত্রে ত্রিপুরিদের 'কিরাত' বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ত্রিপুর –ভূমিকে বলা হয়েছে 'কিরাতদেশ'। মহাভারতের বিভিন্ন পর্বে উল্লিখিত হয়েছে ত্রিপুরা। ত্রিপুরা রাজ্যের উল্লেখ পাই মহাভারতে (১১.২৮.৩৮), (ষষ্ঠ .৮৩.৯)। " সভাপর্ব, মহাভারত/ দ্বিতীয় অধ্যায় ২৮ –এ সহ দেবের অগ্রযাত্রার উল্লেখ রয়েছে: তাঁর এই অভিযানে সম্মুখস্থ ত্রিপুরার রাজা এবং প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলির পরাজয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে। দীর্ঘ সশস্ত্র বীর অপরিমেয় শক্তির অধিকারী সহ দেবতার পর ত্রিপুরার রাজা এবং কিরাত রাজ্যকে তাঁর অধীনস্থ করেন। আবার ভীষ্ম পর্ব, মহাভারত/পুস্তক ষষ্ঠ অধ্যায় ৮৩'তে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে কৌরবদের সেনাবাহিনীর বিন্যাসেও উল্লেখিত হয়েছে ত্রিপুরার কথা (ষষ্ঠ.৮৩.৯)। উল্লেখ করা হয়েছে। [৯].... দ্রোণের পাশে ছিলেন বীর অহম রাজ ভগদত্ত। ভগদত্তের পিছনে ছিলেন মেকল, ত্রিপুরা এবং চিচিলাদের সাথে কোশলের রাজা বৃহদ্বলা।"
ত্রিপুরার মহারাজা ত্রিলোচন যে যুধিষ্ঠিরের রাজ সূয়যজ্ঞে অংশ নিয়েছিলেন - তার একটি সুন্দর বর্ণনা পাই ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী লিখিত রাজমালা (প্রথম পরিচ্ছেদ/৯) গ্রন্থে। তিনি বর্ণনা করেছেন এইভাবে, ‘সেই সময় যুধিষ্ঠিরের রাজ সূয়যজ্ঞ হইতেছিল।তাহাতে যে কত রাজার নিমন্ত্রণ হইয়াছিল তাহার সঠিক নির্ণয় নাই। পূর্ব্বে সহদেবের দিগ্বিজয়ের কথা বলা হইয়াছে। সহদেব ত্রৈপুর নরপতিকে বশে আনিয়া ছিলেন একথা মহাভারতে আছে, এই ত্রৈপুর নৃপতিই ত্রিলোচন। পাণ্ডব বীর সহদেবের সৌজন্যে, ত্রিলোচন যুধিষ্ঠিরের রাজ সূয়যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হইয়া হস্তিনাপুর গমন করেন। ত্রিলোচন মহাসমারোহে সসৈন্যে ভারতের রাজধানীতে আসিয়া উপস্থিত হন। তাঁহার সঙ্গে মণিপুরের রাজাও আসেন। ইহা ত্রিপুরার ইতিহাসে এক অভূত পূর্ব্ব ঘটনা। বিধির বিচিত্র বিধানে আজ পর্য্যন্ত ভারতের রাজধানী প্রায় সেইখানেই রহিয়া গিয়াছে।
মহারাজ ত্রিলোচন হস্তিনাপুর পৌঁছিয়া দেখিলেন তাঁহার জন্য সুন্দরপর্ণা বাসরচিত হইয়াছে। বহু রাজার আবাসে সে স্থান শোভিত ছিল। পরম আদরে সেইখানে তিনি অভ্যর্থিত হইলেন। শুভদিনে রাজ সূয়যজ্ঞ আরম্ভ হইল। যথা সময়ে ভীমসেন ত্রিলোচনকে সঙ্গে লইয়া মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সহিত সাক্ষাৎ করাইলেন। এই শুভ সম্মিলন ত্রিপুরার ইতিহাসকে অমর করিয়া রাখিবে। ত্রিলোচনের প্রতি রাজ সম্মানে ত্রিপুরার আসন ভারতের দিকে দিকে প্রতিষ্ঠা লাভ করিল। নির্দ্দিষ্ট দিনে ত্রিলোচন গৌরব মুকুট পরিয়া দেশে ফিরিলেন।‘’ ( পৃষ্ঠা২৭-৩০)
রামায়ণ এবং মহাভারত বিশ্বখ্যাত মহাকাব্য। প্রাচীন ভারতের বহু ঐতিহাসিক উপাদান আজও নিরন্তর এই দুই মহাকাব্য থেকেই আহৃত হচ্ছে। সেতু বন্ধরা মশ্বরম' কে এক সময় নিছকই কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভারত আর শ্রীলঙ্কার মধ্যে যে পায়ে হেঁটে যাওয়ার রাস্তা ছিল – তা পুনরাবিষ্কৃত হয় ! তিন বা আড়াই হাজার বছর আগে রচিত মহাভারতে যখন কিরাত ভূমির কথা উল্লিখিত হয় – তখন বুঝতে হবে প্রাচীন ভারতের পূর্ব পুরুষেরা জানতেন এই অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর কথা। ভারত নামে দেশ এবং ভারতীয় সত্তা আসলে এই সাংস্কৃতিক বোধেরও পরই গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, ভাষা, ধর্ম, এবং সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ভারত। পৃথিবীর বাকি দেশগুলির সঙ্গে তাই এখানেই আমাদের তফাৎ। সময়ের নিয়মেই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে গেছে বহু প্রাচীন জনগোষ্ঠী। কাল প্রবাহের অভিঘাত সইয়ে ত্রিপুরিরা কিন্তু আজও রয়ে গিয়েছে এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রিয় ভারত ভূমির বৈচিত্র্যকে করে তুলেছে আরও বর্ণাঢ্য। এটাই হয়তো ত্রিপুরিদের মতো যে কোনও প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় শ্লাঘার বিষয়। সরকারিভাবে স্বীকৃত মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের জন্মদিবস আসলে প্রাচীন ভারতের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসেরইজয় গান !