পূর্বোত্তরে স্বাধীনতার লড়াই
পান্নালাল রায়
স্বভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়াইর ক্ষেত্রে উত্তর পূর্বাঞ্চলের এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। দেশের অন্যান্য অংশের মতো এই অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষও তাদের স্বভূমিতে ব্রিটিশদের অধিকার কায়েমের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়াই করে গেছেন।যদিও শেষপর্যন্ত আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে বলিয়ান ব্রিটিশদেরই জয় হয়েছে, তবু আদিবাসীদের আত্মবলিদানের ঘটনা দেশের স্বাধীনতা লড়াইর ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
উত্তর পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা চাকমা,মিজো,নাগা,খাসি, খামতি -এইসব জনজাতিদের কাছ থেকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের বিভিন্ন সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের যেসব লড়াই ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৭৭৬-৮৭ সালে চাকমা বিদ্রোহ। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত অংশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আদিবাসী বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল ১৭৭৬ সালে।পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন চাকমা আদিবাসীদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মূলত কার্পাস কর সংগ্ৰহের বিষয় নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয় চাকমাদের।
অষ্টাদশ শতকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের যে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন অংশেও তখন ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র আকার ধারণ করে।খাসিদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সংঘাতের সূচনা হয় মূলত অর্থনৈতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে তখন খাসিদের নগদ অর্থে কর প্রদানে চাপ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসময়ে খাসি আদিবাসীদের মধ্যে নগদ অর্থের প্রচলন কম ছিল। সংঘাত শুরু হয় এ নিয়ে।নঙ্গ্খলাও'র সিয়েম বা রাজা তীরূত সিং ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।১৮৩২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তীরূত সিং ও তাঁর অনুগামীরা যুদ্ধ চালিয়ে যান।জয়ন্তিয়া পাহাড়ের আদিবাসীরাও ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়ে যায।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের লুসাই পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা লুসাই অর্থাৎ মিজোদের কাছ থেকেও প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। স্বাধীনচেতা মিজোদের সঙ্গে তাদের বারংবার সংঘর্ষ ঘটেছে।বহু রক্ত ঝরেছে পাহাড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে মিজোদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সংঘাত শুরু হয়।প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন লালচোকলা নামে এক মিজো চীফ। তারপর রুখে দাঁড়ান চীফ মোরা।১৮৫০ সালে কর্ণেল লিস্টারের নেতৃত্বে কোম্পানির ফৌজ বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল মোরার গ্ৰাম।১৮৭১-৭২ সালে ব্রিটিশ বাহিনী আবার মিজোদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালায়।১৮৯০-৯১ সালেও লুসাই পাহাড়ে মিজোদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা সশস্ত্র তৎপরতা চালায়।
ব্রিটিশ কর্তৃক আসাম অধিকারের পর থেকেই নাগাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের যোগাযোগ ঘটে।তারপরই শুরু হয় সম্পর্ক আর সংঘাতের অধ্যায়। আসামের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন সীমান্ত এলাকায় নাগাদের সশস্ত্র হামলা ঘটতে থাকে।এই হামলা কার্যকরী ভাবে রুখতে ব্রিটিশদের বারংবার সামরিক অভিযান করতে হয়েছিল নাগাদের বিরুদ্ধে। এসবের ফলশ্রুতিতে একসময় নাগা অধ্যুষিত পার্বত্য এলাকা ব্রিটিশরা নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসে। কিন্তু তা খুব সহজে হয়নি।নাগারা তাদের স্বাধিকার আর স্বভূমি রক্ষার জন্য মরণপণ লড়াই করেছে। পরবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীতে স্বভূমিকে ব্রিটিশ কবল মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলনে সামিল হয়েছে নাগা জনগোষ্ঠীর মানুষ। আর এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়ে আছে রানি গাইদিন লিউ,জাদোনাঙ্গ এবং ধর্মীয় হেরাকা আন্দোলনের কথা। মণিপুরের রঙ্গমেই ধর্মীয় নেতা হাইপৌ জাদোনাঙ্গ নাগা পুরুষানুক্রমিক ধর্ম ভিত্তিক এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এক স্বাধীন নাগা রাজ্যের ভাবনা ছিল তাঁর। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনও তাকে আকৃষ্ট করেছিল। শেষপর্যন্ত অবশ্য তাঁকে ব্রিটিশরা ধরে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি দেয়। তারপর রানি গাইদিন লিউ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।এই হেরাকা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল নাগাদের মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি সহ এক নাগা রাজ্য গঠন। কিন্তু ব্রিটিশরা মাত্র ষোলো বছর বয়সে রানি গাইদিনলিউকে গ্ৰেপ্তার করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
উত্তর পূর্বাঞ্চলে স্হানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে যেমন প্রবল বাঁধা পেয়েছে ব্রিটিশরা, তেমনই কোনো কোনো রাজ্যে রাজন্যবর্গের কাছ থেকেও বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে তারা।১৭৬১ সালে ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণ মানিক্য ইংরেজদের বাঁধা দিলেও সেদিন তারা ছলচাতুরি করে জয় করে নিয়েছিল সমতল ত্রিপুরা।১৮৯১ সালে মণিপুর রাজকুমার টিকেন্দ্রজিতের নেতৃত্বে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল মণিপুরে।রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অবশ্য শেষপর্যন্ত মণিপুরকে করদ রাজ্যে পরিণত করেছিল ব্রিটিশরা। তারও আগে ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের প্রভাব পড়েছিল ত্রিপুরা,কাছাড়,মণিপুর ও আসামে। স্বাধীনচেতা মণিপুরী রাজকুমার নরেন্দ্রজিৎ কাছাড়ে যোগ দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের বিদ্রোহী ভারতীয় সিপাহিদের সঙ্গে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের সঙ্গে ইন্ডয়ান ন্যাশনেল আর্মি যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মণিপুরে প্রবেশ ও অবস্হান করে তখন স্হানীয় আদিবাসীদের সাহায্য সহযোগিতার কথা জানা যায়। সেদিন মোইরাঙ-এর দখল নিয়েছিল নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ। বিংশ শতাব্দীতে অসম সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা স্বাধীনতা আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে আছে।