মিজো স্বাধীনতা যোদ্ধা ও একটি বটবৃক্ষ

পান্নালাল রায়

মিজোরামের এক প্রাচীন বটবৃক্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিজোদের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য।সেতক গ্ৰামের সেই বটবৃক্ষ যেন আজও অতীতের গৌরবোজ্জ্বল দিনের স্বাক্ষ্য বহন করছে।

উত্তর পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা মিজোদের কাছ থেকেও প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। স্বাধীনচেতা মিজোদের সঙ্গে ব্রিটিশদের বারংবার সংঘাত হয়েছে।বহু রক্ত ঝরেছে পাহাড়ে। তবু মিজো আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের স্বভূমি রক্ষা করতে মরণপণ লড়াই চালিয়ে গেছে। ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই'র ক্ষেত্রে মিজো চীফ মোরা,সুকপিলাল,লেঙ্গপুঙ্গা,খোলগাম-এই নামগুলো আজ ইতিহাস হয়ে আছে।

এবার আসছি স্বাধীনতা যোদ্ধা লেঙ্গপুঙ্গা আর সেই বটবৃক্ষ প্রসঙ্গে। মিজোরাম রাজধানী আইজল থেকে প্রায় ৪৫ কিঃমিঃ দূরে সেতক গ্ৰাম।এই গ্ৰামেই রয়েছে সেই প্রাচীন বৃক্ষ। এর পাশ দিয়ে গেছে পথ। রোজ বহু মানুষ হেঁটে যায় এই পথ দিয়ে।পথশ্রান্ত মানুষ কখনও দুদন্ড জীরিয়ে নেয় গাছের শীতল ছায়ায়।কেউ কেউ জুমের আদা বাছাই করে এর নিচে বসে। ইতিহাস আর স্মৃতি বিজড়িত প্রাচীন বৃক্ষটি দেখতেও আসেন অনেকে।বৃক্ষটিকে জড়িয়ে আছে সেতক গ্ৰামের গর্বের ইতিহাস। সেই গর্ব ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যোদ্ধা লেঙ্গপুঙ্গাকে নিয়ে।

মিজো পাহাড়ে ব্রিটিশদের অভিযানের বিরুদ্ধে স্বাধীনচেতা মিজোরা বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রথম রুখে দাঁড়ান চীফ মোরা।কর্ণেল লিস্টারের নেতৃত্বে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সহ অভিযান চালিয়ে মোরের গ্ৰাম বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল কোম্পানির ফৌজ।মিজোরা তবু বশ্যতা স্বীকার করেনি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও সফল প্রত্যাঘাত এনেছিলেন মোরা।যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ ছিল তাঁর আদর্শ।মিজোদের কাছে তিনি যেন ছিলেন বীরত্বের প্রতিমূর্তি।১৮৭১-৭২ সালে আবার ব্রিটিশদের মিজো বিরোধী ব্যাপক অভিযান সংঘটিত হয়। সেসময় সেনা এবং সহযোগী লোকজন মিলিয়ে ব্রিটিশদের পক্ষে প্রায় ৮ হাজার মানুষ সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। প্রচুর পরিমাণে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াও হাতি,খচ্চর, নৌকা ইত্যাদিও প্রচুর সংখ্যায় ছিল তাদের বাহিনীতে। ব্রিটিশদের দুইজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বাউরচিয়ের ও ব্রাউনলো'র নেতৃত্বে দুদিক থেকে এই অভিযান সংঘটিত হয়েছিল মিজোভূমিতে। সেসময় উত্তর পূর্বাঞ্চলে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে এটি ছিল ব্রিটিশদের সর্ববৃহৎ অভিযান।চীফ সুকপিলাল সেসময় স্বভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি যথোপযুক্ত ভাবে ব্রিটিশদের মোকাবেলা করেছিলেন। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশরা তাঁর সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়।১৮৯০-৯১ সালে মিজো ভূমিতে ব্রিটিশদের সশস্ত্র তৎপরতার লক্ষ্য শুধু বিজয় লাভই ছিল না, ছিল মিজোদের বশীভূত করা। কিন্তু সেবারও মিজো জনগোষ্ঠীর স্বাধীনচেতা মনোভাব ও তাদের স্বভূমির প্রতি দুর্বার আকর্ষণ সম্পর্কে ধারণা করতে ব্যর্থ হয় ব্রিটিশরা।লেঙ্গপুঙ্গা ও খোলগাম নামে দুই ভাইয়ের মধ্যে সেদিন স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছিল মিজোদের স্বাধীনচেতা এক দৃঢ় মানসিকতা। তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সময় তখন বদলে গেছে অনেক। গোটা দেশেই ইংরেজ আধিপত্য অনেক সুদৃঢ়। এদিকে চার দশকের যুদ্ধ বিগ্ৰহে ক্লান্ত মিজোরাও তখন শান্তি চাইছে। কয়েকজন চীফের সঙ্গে ইংরেজদের শান্তিচুক্তিও হয়েছে। কিন্তু লেঙ্গপুঙ্গা ও খোলগাম ভ্রাতৃদ্বয়ের সশস্ত্র তৎপরতা তখনও অব্যাহত ছিল। তারা সর্বশক্তি দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনচেতা মিজোদের ঐক্যবদ্ধ করে লড়ে গেছেন।ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের চীফ উপাধি তুলে দিয়ে তাদেরকে নতুন গ্ৰামের পত্তন করতেও নিষেধ করে।এই চীফদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, বলপূর্বক শ্রমিক সংগ্ৰহ,গৃহকর আরোপ ইত্যাদি ইস্যু মিজোদের প্রচন্ড ভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এসবের পরিণতিতে ফৌজ সহ ব্রিটিশ আধিকারিক নিহত হয়েছেন। ব্রিটিশদের দুর্গ আক্রান্ত হয়েছে।মিজো পাহাড়ের সমস্ত উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী মিজো বিদ্রোহ। কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে নিতে সক্ষম হয়।গ্ৰামগুলো ধ্বংস করে বিদ্রোহী চীফদের গ্ৰেপ্তার করা হয়। কিন্তু আটক অবস্থায়ও লেঙ্গপুঙ্গা ও খোলগাম ব্রিটিশদের কাছে নতি স্বীকার করেননি। যেখানে ব্রিটিশরা নতুন গ্ৰাম গড়ে তুলতে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করেছিল সেখানে লেঙ্গপুঙ্গা তাঁর অনুগামীদের ঘরবাড়ি নির্মাণ চালিয়ে যেতে নির্দেশ পাঠান।তাই তাদেরকে বন্দি করেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ স্বস্তিতে ছিল না।মিজোভূমিতে তাদের উপস্হিতিকেই বিপজ্জনক মনে করেছিল তারা।তাই এই দুই ভাইকে দশ বছরের জন্য বিহারের হাজারিবাগ জেলে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল।

স্বদেশ থেকে অনেক দূরে জেলে বসেও তারা সর্বদাই স্বভূমি সবুজ পাহাড়ের কথাই ভাবতেন।ভাবতেন স্বাধীন ভাবে দেশবাসীর জীবন নির্বাহ অর্থাৎ দিন যাপনের কথা। কিন্তু তখন তারা অসহায়। ব্রিটিশদের হেফাজতে কাটছে তাদের বন্দি জীবন।স্বদেশকে রক্ষা করতে পারছেন না কোনো ভাবেই।তাই এই জীবন রাখার মানে কি! এক হতাশা যেন গ্ৰাস করে নিয়েছিল তাদের। শেষপর্যন্ত একদিন হাজারিবাগ জেলের শৌচাগারে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেন লেঙ্গপুঙ্গা ও খোলগাম দুই ভাই।১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি।

ইংরেজ অধিকারের আগে সেদিন মিজোরাম ছিল চীফ শাসিত।চীফ মানে মুখিয়া অর্থাৎ গ্ৰামের মুখ্য মানুষ। পাহাড়ে পাহাড়ে চীফের বাসস্হানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতো বসতি।এই চীফদের নেতৃত্বেই সেদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মিজো পাহাড়ে জ্বলে উঠেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের আগুন।লেঙ্গপুঙ্গা ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্ৰণী নেতা। ব্রিটিশ বাহিনী নানা ভাবে তৎপরতা চালিয়ে, চাপ সৃষ্টি করেও তাঁকে জব্দ করতে পারে নি। নিজের জীবদ্দশাতেই যেন কিংবদন্তি এই স্বাধীনতা যোদ্ধা আজও মিজোরামের প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ। প্রায় দুই দশক আগে মিজোরাম সফরে গিয়ে দেখে এসেছিলাম সেতক গ্ৰামের সেই বটবৃক্ষটি।তার নাম হয়ে গেছে লেঙ্গপুঙ্গা ট্রী।স্হানীয়রা বলছিলেন, মিজোরামের একটি প্রাচীন গাছ এই লেঙ্গপুঙ্গা ট্রী। সেদিন সেতকের গ্ৰামবাসীরা কৃতজ্ঞ চিত্তে বলছিলেন প্রবাদপুরুষের সঙ্গে বটবৃক্ষটির সম্পর্কের কথা।লেঙ্গপুঙ্গা যত্ন করে বড় করে তুলেছিলেন এই গাছটি।একদা স্হানীয় মানুষ এই বৃক্ষের সামনে প্রার্থনা করতেন।পবিত্র বৃক্ষ হিসেবে তার মান্যতা ছিল। এখন প্রার্থনা না হলেও বৃক্ষকে শ্রদ্ধা করে সবাই।পথচলতি মানুষ লেঙ্গপুঙ্গা ট্রীর সামনে এসে দাঁড়ায়।সশ্রদ্ধ চোখে দেখে যায় বৃক্ষকে।

নদীর সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে নাগরিক সভ্যতার ইতিহাস, তেমনই কোনো জনপদের পত্তনের সঙ্গেও যেন জড়িয়ে থাকে বটবৃক্ষ।বটবৃক্ষ ছাড়া কোনো গ্ৰামীন হাটের দেখা মেলাই ভার। গ্ৰামের বটগাছের ছায়ায় শ্রান্ত রাখাল বালকেরা জীরিয়ে নিত অলস মধ্যাহ্ণে। ফেরিওয়ালাও এখানে বসতো। ধীরে ধীরে হাটের চেহারা নিল তা। গড়ে উঠলো সংশ্লিষ্ট জনপদ। কিন্তু শুধু জনপদের পত্তন নয়, মিজোরামের সেতক গ্ৰামের লেঙ্গপুঙ্গা ট্রী যেন সাক্ষ্য দেয় স্বাধীনতা যুদ্ধের।স্হানীয় মানুষের‌ মতে আপসহীন স্বাধীনতা যোদ্ধা লেঙ্গপুঙ্গা বড় করে তুলেছিলেন এই গাছটি। হয়তো এই অঞ্চলেই ছিল লেঙ্গপুঙ্গার ব্রিটিশবিরোধী তৎপরতার কেন্দ্র।সব মিলিয়ে এই বটবৃক্ষের সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছে স্বাধীনচেতা মিজোদের ব্রিটিশ বিরোধী তৎপরতার লিখিত অলিখিত ইতিহাস।লেঙ্গপুঙ্গা নেই। কিন্তু আছে তার দেশাত্মবোধের আদর্শ। আছে স্বভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গের উজ্জ্বীবনী মন্ত্র।এই ইতিহাস আর ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে প্রাচীন বটবৃক্ষের সেতক গ্ৰাম!


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.