পর্যটকের লেখায় ত্রিপুরায় স্বর্ণ খনি
পান্নালাল রায়
মানিক্য যুগেই ত্রিপুরায় খনিজসম্পদ অনুসন্ধানে তৎপরতা শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তা আরও অনেক বৃদ্ধি পায়। ত্রিপুরার খনিজসম্পদ হিসেবে তৈল,গ্যাসের সঙ্গে চূণা পাথর,শক্ত শিলা ইত্যাদির পাশাপাশি কয়লার অস্তিত্বের কথাও জানা গেছে। কিন্তু স্বর্ণখনি? না, এরকম কিছু আছে বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু ফরাসি পর্যটক আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগেই লিখে গেছেন ত্রিপুরায় স্বর্ণ পাওয়ার কথা।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালে ত্রিপুরায় খনিজসম্পদ অনুসন্ধানের কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারও প্রায় আড়াইশো বছর আগে ফরাসি পর্যটক টেবার্ণিয়ার তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে লিখেছেন, ত্রিপুরায় এক ধরণের স্বর্ণ পাওয়া যায়। অবশ্য তা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নয়।টেবার্ণিয়ার এই বিবরণী আজও আমাদের যুগপৎ বিস্ময় ও কৌতূহলের উদ্রেক করে। নানা প্রশ্নও জাগে। ত্রিপুরার রাজাদের অঢেল স্বর্ণ ব্যবহার, বিশেষত রাজমালা অনুসারে ধন্য মানিক্যের একমণ স্বর্ণ দিয়ে ভুবনেশ্বরী বিগ্ৰহ গড়িয়ে পূজা দেয়া, ধনরত্ন লুণ্ঠনে রাজধানী উদয়পুরে বারংবার বহিঃশত্রুর হানা দেয়া ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহ যেন রাজ্যে স্বর্ণের মতো সম্পদের সহজ প্রাপ্তির কথাই মনে করিয়ে দেয়!
১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য। ১৯২৩ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তিনি একদিকে যেমন শিল্প সংস্কৃতির পূজারী ছিলেন, তেমনই অপরদিকে ছিলেন এক দক্ষ প্রশাসক।রাজ্যের উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। বীরেন্দ্র কিশোরের রাজত্বকালে ত্রিপুরায় চা শিল্পের সূচনা ঘটে।রাজ্যে চল্লিশটি চা বাগান গড়ে উঠেছিল তাঁর আমলে। ত্রিপুরার ভূগর্ভস্থ খনিজ পদার্থের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য একজন ভূতাত্ত্বিক নিয়োগ করেছিলেন তিনি। এছাড়া ত্রিপুরায় খনিজ তৈল অনুসন্ধানের জন্য ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে বার্মা ওয়েল কোম্পানীকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে অন্তত শতবর্ষের মধ্যে স্বর্ণ প্রাপ্তির কোনও তথ্য আমাদের জানা নেই।১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত তাঁর 'উদয়পুর-বিবরণ' গ্ৰন্হে ত্রিপুরায় খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান সম্পর্কে লিখেছেন-"...১৩৩৬ত্রিং(১৯১৬খ্রীঃ) সনে বর্মা অয়েল কোম্পানীর মিঃওয়ার্ডস্ওয়ার্থ ও মিঃ লেপার নামক দুইজন ইঞ্জিনীয়ারও এই বিভাগে খনির অনুসন্ধানে আসিয়াছিলেন।স্হানে স্হানে কেরোসিন, কয়লা ও লৌহ খনির সন্ধান পাওয়া গিয়াছে জানা গিয়াছিল, কিন্তু এই তদন্ত গোপনীয় ভাবে হইতেছিল বলিয়া প্রকৃত বিষয় সাধারণের জানিবার সুবিধা হয় নাই।"
কিন্তু ফরাসি পর্যটক টেবার্ণিয়ার তারও প্রায় আড়াইশো বছর আগে ত্রিপুরায় স্বর্ণ প্রাপ্তির কথা কিসের উপর ভিত্তি করে লিখলেন?
কৈলাস চন্দ্র সিংহ তাঁর সুবিখ্যাত 'রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্ৰন্হে লিখেছেন,ছত্র মাণিক্যের রাজত্বকালে (১৯৬১-৬৬) দুইজন বিখ্যাত ফরাসি ভ্রমণকারী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন। তাদের একজন চিকিৎসা ব্যবসায়ী,নাম বর্ণিয়ার। দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্ভ্রান্ত বংশীয় বণিক,নাম জনব্যাপটিষ্টা টেবার্ণিয়ার।টেবার্ণিয়ারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত সংক্রান্ত গ্ৰন্হে ত্রিপুরার রাজা ছত্র মানিক্যের নাম ও ত্রিপুরার বর্ণনা পাওয়া গেছে।টেবার্ণিয়ার বলেছেন, মোগল সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমা আসাম,ত্রিপুরা, আরাকান নামের তিনটি পৃথক পৃথক রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত।টেবার্ণিয়ার আরও বলেছেন যে,ত্রিপুরা থেকে স্বর্ণ ও তসর বাণিজ্যার্থে বিদেশে যায়।অবশ্য ত্রিপুরায় উৎপাদিত স্বর্ণ সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নয়। প্রায় সোয়াশ বছর আগে প্রকাশিত 'রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্ৰন্হে কৈলাস চন্দ্র সিংহ ত্রিপুরার খনিজসম্পদ সম্পর্কে ফরাসি ভ্রমণকারী টেবার্ণিয়ারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন,'ত্রিপুরা রাজ্যে এক প্রকার স্বর্ণ প্রাপ্ত হওয়া যায়, কিন্তু তাহা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নহে। অধুনা সেই স্বর্ণের কোনরূপ নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে না।'
ত্রিপুরায় খনিজ সম্পদ বলতে সর্বাগ্ৰে আমাদের তৈল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের কথাই মনে পড়ে।রাজ্যে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাসকে ভিত্তি করে ইতিমধ্যে বৃহৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রও স্হাপিত হয়েছে। এছাড়াও রাজ্যে খনিজ সম্পদের মধ্যে লাইম স্টোন বা চূণা পাথর,গ্লাস সেন্ডস,প্লাস্টিক ক্লে,হার্ড রক রয়েছে।রাজ্যের শাকান ও জম্পুই রেঞ্জে লাইম স্টোন, জম্পুই ও লংতরাই পাহাড়ে হার্ড রকের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। ২০১০ সালের এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ত্রিপুরায় ভালো পরিমাণে কয়লার ভান্ডারও পাওয়া গেছে। তবে রাজ্যে সেই কয়লা ভান্ডারের পরিমাণ জানা না গেলেও,জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া'র সূত্র উল্লেখ করে ইকনমিক টাইমস (১/১২/২০১০ইং) জানিয়েছে যে উত্তর পূর্বাঞ্চলে ৯০৯ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ আছে।
উল্লেখ করা যায় যে,প্রায় সোয়াশ বছর আগে কৈলাস চন্দ্র সিংহ লিখেছিলেন,'...এই রাজ্যে পূর্ব পার্শ্বে পাথুরিয়া কয়লা আছে বলিয়া শ্রুত হওয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহার বিশ্বস্ত প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই।...' পরবর্তী সময়ে ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে রাজ্যে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে তৎপরতা শুরু হয়।১৯৩০ খ্রীঃ প্রকাশিত পুস্তকে ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত লিখেছেন,'স্হানে স্হানে কেরোসিন, কয়লা ও লৌহ খনির সন্ধান পাওয়া গিয়াছে জানা গিয়াছিল...'।
তাহলে কোথায় গেল টেবার্ণিয়ার বর্ণিত স্বর্ণখনি? 'রাজমালা'ও ত্রিপুরায় স্বর্ণের সহজলভ্যতা নিয়ে ইঙ্গিত দেয়।ধন্য মাণিক্য খন্ডে স্বর্ণ উৎপাদন সম্পর্কে রয়েছে--'আর তত্ত্ব মহারাজা শুনিল তখন।/কুকি রাজ্যে সুবর্ণের হয়েত উৎপন্ন।।...জামাতা হোপকলাউ মনে গর্ব্ব তার।/থাংচাঙ্গ চড়িয়া যায় সোণা আনিবার।।/কিরাত সকলে মিলে যুক্তি করে সার।/সোণা পাইলে থানা এথা থাকিব রাজার।।...'
ধন্য মাণিক্য (১৪৯০-১৫২০খ্রীঃ) ত্রিপুরার একজন বীর ও ধর্মপ্রাণ রাজা ছিলেন। উদয়পুরে মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির তিনিই নির্মাণ করিয়েছিলেন। এছাড়া স্বর্ণ দিয়ে এই রাজা কর্তৃক ভুবনেশ্বরী বিগ্ৰহ নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে 'রাজমালা'তে--'শ্রীধন্য মাণিক্য রাজা ধর্ম্মে চিত্ত দিল।/প্রতিমা ভুবনেশ্বরী সুবর্ণে নির্ম্মাইল।।/এক মণ সুবর্ণের প্রতিমা নির্ম্মাইয়া।/জীবন্যাস করাইল সাধক আনিয়া।।...' এক মণ স্বর্ণ দিয়ে ভুবনেশ্বরী বিগ্ৰহ তৈরির কথা স্বাভাবিক ভাবেই ত্রিপুরায় সেসময়ে স্বর্ণের প্রাচুর্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
'রাজমালা' প্রসঙ্গের পর আবার পর্যটক টেবার্ণিয়ার কথায় আসা যাক। তিনি স্পষ্টই লিখেছেন ত্রিপুরায় উৎপাদিত স্বর্ণ চীন দেশে রপ্তানি হতো এবং এর বিনিময়ে চীন থেকে রূপা সংগ্ৰহ করে এনে ত্রিপুরায় মুদ্রা তৈরি করা হতো। 'শ্রীরাজমালা' সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সেন গ্ৰন্হের ২য় লহরে টেবার্ণিয়ারের ভ্রমণ বিবরণীর ত্রিপুরা সংশ্লিষ্ট কিছু অংশ তুলে ধরেছেন।তাতে রয়েছে--... There is a Mine of Gold,but the Gold is very courfe(coarse)....He fends(sends) his Gold and his Silk into China,for which they bring him back Silver, which he coins into pieces to the value of ten Sous...
টেবার্ণিয়ারের বিবরণী থেকে দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরায় উৎপাদিত স্বর্ণ পরিশুদ্ধ ছিল না। তবে এই স্বর্ণ এবং সিল্ক রাজা চীন দেশে রপ্তানি করতেন। বিনিময়ে আমদানি করতেন রূপা।টেবার্ণিয়ার ত্রিপুরায় স্বর্ণ খনির কথা উল্লেখ করলেও কোথায় ছিল সেই খনি তার উল্লেখ পাওয়া যায় নি। পরবর্তী সময়ের ইতিহাসবিদরাও টেবার্ণিয়ার বর্ণিত স্বর্ণ খনির কথা উল্লেখ করেও তার কোনো নিদর্শন না পাবার কথাই বলে গেছেন। এমনকি অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে খনিজসম্পদ অনুসন্ধানের তৎপরতা শুরু হবার পরও ত্রিপুরায় স্বর্ণ খনির কোনো হদিস পাওয়া গেছে বলে জানা নেই। তাহলে কোথায় গেল টেবার্ণিয়ারের সেই স্বর্ণ খনি? কোথায়ইবা 'রাজমালা' বর্ণিত স্বর্ণ ভান্ডার? কিংবা ভুবনেশ্বরী দেবীর এক মণ ওজনের সুবর্ণ বিগ্ৰহ? সবই কি ইতিহাস পৃষ্ঠার কুহেলিকা? তবে থেমে নেই অনুসন্ধান কিংবা গবেষণা। হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে আগামী দিনে।