করোগে ইয়াদ তো : ভূপিন্দর সিংহ
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
হিন্দি ছবির গানের ভুবন তখন ভাস্বর করে তুলেছিলেন মহম্মদ রফি, মুকেশ, মান্না দে, কিশোর কুমারের মতো গায়করা। এমন সব কিম্বদন্তিদের মাঝে তবু নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন “এক অকেলা ইস শহর মে”র গায়ক ভূপিন্দর সিংহ। ঘরোন্দা ছবিতে গাওয়া এই গানটিই হয়ে উঠেছিল তাঁর গায়ক সত্তার যথার্থ প্রতীক। ভারী এবং ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বরের জন্য গায়ক হিসেবে হয়ে উঠেছিলেন তিনি স্বতন্ত্র। বেদনা বিধুর হৃদয়ের ভাষ্য হয়ে উঠেছিল তাঁর ভরাট কণ্ঠে গাওয়া গানগুলি। মৌসমের সেই ‘‘দিল ঢুন্দতা হ্যায় ফির ওহি ফুরসত কে রাত দিন’’এর মতো গান আমাদের অস্থির বেদনাহত হৃদয়কে প্রশান্ত করে তুলে। গূঢ় অর্থ বোধক গজল ‘‘কভি কিসি কো মুকম্মল জহাঁ না মিলতা’’ (আহিস্তা আহিস্তা) যেন জীবনের যাবতীয় অসম্পূর্ণতার স্তোত্র। তিনি শুধু বহুমুখী গায়কই ছিলেন না, গ্যিটার বাদক হিসেবেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘‘কাদম্বরী’’তে ওস্তাদ বিলায়ত খানের সঙ্গতকারী হিসেবে বাজিয়েছেন গ্যিটার। আবার এম.বি. শ্রীনিবাসন’এর ‘‘মঞ্জু’’তে ‘‘রসিয়া মন বেখায়ে’’র মতো বিমোহিত গানে তিনি গড়ে তোলেন অসামান্য ধ্রুপদী পরিবেশ !
অমৃতসরে জন্ম হলেও ভূপিন্দর সিংহের ছেলেবেলা কেটেছিল দিল্লিতে। দিল্লির পশ্চিম প্যাটেল নগরে ছিল তাঁদের পারিবারিক আবাস। পিতা অধ্যাপক নাথা সিং’ও একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। পিতার সূত্রেই শৈশবকালে সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ জন্মে ভূপিন্দর সিংহের। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন যন্ত্র বাজানোর প্রতি ছিল অসীম আগ্রহ। এমন ছেলে যে বড় হয়ে সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন - এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না !
গ্যিটার শেখার পর তিনি সুরকার সতীশ ভাটিয়ার নির্দেশনায় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নিয়মিত বাদক শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে সঙ্গীতানুষ্ঠানে গাইতেনও। সতীশ ভাটিয়া তখনই লক্ষ্য করেছিলেন ভূপিন্দর সিংহের ভরাট কন্ঠস্বরের মধ্যেও একটা অদ্ভুত মাদকতা রয়েছে। তিনিই সেই সময় ভূপিন্দর সিংহ’কে চলচ্চিত্রে গাইবার জন্য সুরকার মদন মোহনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ভূপিন্দর সিং তখন মদন মোহন’কে বাহাদুর শাহ জাফর’এর ‘’লগতা না হ্যায় দিল মেরা উজাড়ে দয়ার ম্যায়’’ গেয়ে শুনিয়েছিলেন। মুগ্ধ মদন মোহন তারপর ভূপিন্দর সিংহ’কে মুম্বাইয়ে আসতে বলেন। সে ১৯৬৪ সালের কথা। মুম্বাইয়ে আসার পর ভূপিন্দর সিং সংগীতকার মদন মোহন সুরারোপিত ‘‘হকিকত’’ এ গেয়েছিলেন, ‘’হোকে মজবুর মুঝে উসনে ভুলায়া হোগা’’ !
কিন্তু এই গান রিহার্সাল করার সময়ই বুঝে গিয়েছিলেন পুরো গান তিনি গাইছেন না। ব্যাপার কী - সুরকারকে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার মতো সাহস কুলোয় নি তখন তরুণ গায়কের। পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মদন মোহন জেনেবুঝেই এই গানটির বিষয়ে সব কথা তাঁকে খুলে বলেন নি। আসলে মদন মোহন চাননি ফিল্মে সদ্য প্লে ব্যাক গাইতে আসা তরুণ গায়ক এই কথা জানুক যে, একই ট্র্যাকে তাঁর গানের রেকর্ডিং হচ্ছে মহম্মদ রফি, মান্না দে এবং তালাত মাহমুদ’এর মতো কিম্বদন্তিদের সঙ্গে ! জানলে অবশ্যই ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যেতো। গান গাওয়া আর সম্ভব হতো না। যাইহোক, আজ কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে হকিকত’ ছবির এই গান।
২
‘’হকিকত’’এর দু বছর বাদে এককভাবে গাইবার প্রথম সুযোগ পান। খৈয়াম সুরারোপিত ‘’আখরি খত’’ ছবিতে গেয়েছিলেন ‘’রুত জবাঁ জবাঁ রাত মেহেরবাঁ’’ ! পরবর্তী পাঁচ দশক তিনি মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত মদন মোহন সহ মহম্মদ রফি, শচিন দেববর্মণ, রাহুল দেববর্মণ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, গুলজার, বাপ্পি লাহিড়ীর মতো কিম্বদন্তিদের সঙ্গে কাজ করেছেন।
মুম্বাইয়ে প্লে ব্যাক গাইবার পাশাপাশি অর্কেস্ট্রায় গ্যিটারও বাজাতেন। তাঁর গ্যিটার বাজানোর দক্ষতার কথা মায়া নগরীতে ছড়িয়ে পড়েছিল । হাওয়াইয়ান, স্প্যানিশ এবং ইলেকট্রিক গিটারের তাঁর দক্ষতার কথা পৌঁছে গিয়েছিল রাহুল দেববর্মণের কানে। রাতারাতি তিনি রাহুল দেববর্মণের দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। দেবানন্দ পরিচালিত এবং অভিনীত ‘’হরে রাম হরে কৃষ্ণ’’ ছবির আইকনিক গান ‘’দম মারো দম’’এর সুর কিন্তু উদ্ভূত হয়েছিল ভূপিন্দর সিংহের গ্যিটারেই। দেব সাহেব নাকি রাহুল দেববর্মণ আর ভূপিন্দরকে এই কথাই বলেছিলেন যে, ছবিতে ওই বিশেষ মুহূর্তের জন্য এমন একটি যুতসই গান দরকার যা হিমালয়ের হিমেল আবহাওয়া, পাহাড় ছোঁয়া মেঘরাজি এবং হেরোইনের ধোঁয়া - এমন আবহকে সুরের মাধুর্যে চিত্রায়িত করা সম্ভব হবে । দেব সাহেবের সেই অননুকরণীয় বর্ণনার পর ভূপিন্দর সিং সেই দৃশ্যচিত্র কল্পনা করেই গ্যিটারে ধুন তুলেছিলেন। রাহুল দেববর্মণ তখন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেছিলেন, ‘’হ্যাঁ আমি আমার সুর পেয়ে গেছি!’’
ভূপিন্দর সিং’এর আঙুলে তারপর বিভিন্ন গানে সুমুধুর ছন্দে বেজে উঠেছিল গ্যিটারের তন্ত্রী। অভিভাবক সম মদন মোহনের সুরারোপিত ‘’হসতে জখম’’ ছবির গান ‘’তুম জো মিল গেয়ে হো’’ তে ঝংকৃত হয়েছিল তাঁরই বাজানো গ্যিটার। রাহুল দেববর্মণ সুরারোপিত ‘’অমর প্রেম’’এর গান ‘’ চিঙ্গারি কোই ভড়কে’’ কিম্বা ‘’ইয়াদোঁ কি বারাত’’ ছবিতে ‘’চুরা লিয়া হ্যায় তুম নে’’র মতো গান ভুপিন্দর সিং’এর বাজানো গ্যিটারের সঙ্গতে নিঃসন্দেহে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। আইকনিক ছবি ‘’শোলে’’র সেই বিখ্যাত “মেহবুবা ও মেহবুবা” সহ রাহুল দেববর্মণের অন্যান্য সুরারোপিত গানেও শুনতে পাওয়া যায় ভূপিন্দর সিং’এর বাজানো গ্যিটারের অনবদ্য ধুন !
এ ছিল সেই সময় যখন হিন্দি ছবির গান এবং গায়ন রীতি একটি অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। নতুন প্রজন্মের কাছে গায়ন রীতির চাইতে বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল তাঁর গ্যিটার বাদন ! তাই গুলজার সাহেব পরিচালিত ‘’পরিচয়’’ ছবিতে ‘‘বিতি না বিতাই রায়না’’ র মতো ক্লাসিক গান গাইতে গিয়েও তিনি গ্যিটারিস্ট হিসেবে বেশি নজর কেড়েছিলেন তখন। ফিল্মি সংগীতের বাইরে সেই সময় ব্যক্তিগত গানের অ্যালবামের ওপর বেশি মনোনিবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাই। গজলের সঙ্গে তখন জুড়ে নিয়েছিলেন গ্যিটারের সঙ্গত !
গত শতকের সত্তর দশকের টালমাটাল সময়ে দেশের অবহেলিত আর বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভের কথা রূপালি পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন রাগী যুবক অমিতাভ বচ্চন। এর পাশাপাশি গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসিত অতি সাধারণ মানুষের বিষাদ সংগীতের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন যেন ভূপিন্দর সিং। উল্লেখ্য, এ দেশে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন শুরু হয়েছিল সেই সত্তর দশকেই। নগরায়নের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল তখন। “থোড়ি সি জমিন থোড়া আসমান” গানটি যেন শহরে অভিবাসিতদের অন্তর্ভাষ্য হয়ে উঠে। ঘরোন্দা ছবিতে গাওয়া সেই ‘‘দো দিওয়ানে শহর মে’’ কিম্বা দুরিয়াঁ’’ ছবির ‘‘জিন্দেগি জিন্দেগি মেরে ঘর আনা ’’ অথবা “দুনিয়া ছুটে ইয়ার না ছুটে” গানগুলি জীবনবোধে দীপ্ত হয়ে উঠে; জোরদার করে তুলে বেঁচে থাকার আর্তিকে। সত্তর দশকে গাওয়া তাঁর সেইসব গান আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক এবং আজও সমান ভাবে আমাদের আবেশ মুগ্ধ করে তুলে। এর বাইরে অন্যান্য গানও তাঁর গলায় হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। মদন মোহন তাঁকে ‘‘মৌসম’’ ছবিতে সঞ্জীব কুমারের লিপে গান গাওয়ার
জন্য পুনর্বার ডেকেছিলেন। ‘‘দিল ঢুন্দতা হ্যায়’’ গানটি ভুপিন্দর সিং তখন হর্ষ আর বিষাদ - দু’ভাবেই গেয়েছিলেন অতি দক্ষতার সঙ্গে।
৩
খৈয়াম এবং জয়দেব’এর মতো বরিষ্ঠ প্রজন্মের সুরারোপিত গজলও অনায়সে গেয়েছেন তিনি। এর পাশাপাশি পরবর্তীকালে বাপ্পি লাহিড়ী’র সুরারোপিত ‘’এইতবার’’ ছবিতে সেই ‘‘কিসি কো তেরা ইন্তেজার আজ ভি হ্যায়’’ গজলটি কী অসাধারণই না গেয়েছিলেন ! ১৯৮০’র প্রথম দিকে গজল গায়িকা মিতালি মুখার্জীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর ছবিতে গান গাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন। ওই সময় সহধর্মিণী মিতালীর সঙ্গে জুটি বেঁধে বের করেছিলেন বেশ কিছু গজলের অ্যালবাম। মিতালীর উৎসাহেই স্টেজ পারফর্মেন্স’ও শুরু করেছিলেন। প্রতিবার নতুন বছর উপলক্ষ্যে দূরদর্শন আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভুপিন্দর সিং আর মিতালি ছিলেন নিয়মিত অংশগ্রহণকারী শিল্পী। ওদের পারফর্মেন্স দেখে তখন মুগ্ধ হতো অগণিত দর্শক শ্রোতা।
ভূপিন্দর সিং জীবন ভর বহু পুরষ্কার আর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু সঙ্গীত নাটক একাডেমি কর্তৃক 'সুগম সঙ্গীত' বিভাগে পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। এহেন গায়ক হাল আমলে প্রচলিত কম্পিউটারাইজড মিউজিকের জনপ্রিয়তা এবং তার গভীরতার অভাবের জন্য দুঃখ করবেন - এতো স্বাভাবিক !
প্লেব্যাক গানের জন্য তার কণ্ঠ হয়তো যথোপযুক্ত ছিল না এবং সম্ভবত সে কারণেই নায়কের কণ্ঠস্বর হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পেতে সময় লেগেছিল তাঁর। যাইহোক, তিনি এও জানতেন ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বরের জন্যই তিনি গায়ক হিসেবে স্বতন্ত্র এবং এই স্বাতন্ত্র্যই তাঁকে মহম্মদ রফি, মান্না দে, কিশোর কুমার এবং মুকেশের রাজকীয় বৃত্তের বাইরেও উজ্জ্বল করে তুলেছিল। আজ মনে পড়ে রাহুল দেববর্মণ সুরারোপিত ‘’কিনারা’’ ছবির সেই গান! লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তিনি গেয়েছিলেন, ‘‘নাম গুম যায়েগা চেহেরা ইয়ে বদল যায়েগা/ মেরি আওয়াজ হি পেহচান হ্যায়’’ ... ! হ্যাঁ, তাঁর আওয়াজ বা কণ্ঠস্বরই তো তাঁর পরিচয় ! আর তাই মহাপ্রয়াণের পরও সেই ১৯৮২ সালের ছবি ‘’বাজার’’ ছবিতে গাওয়া তাঁর গান গুঞ্জরিত হয় আমাদের কানে ‘’করোগে ইয়াদ তো’’ । ... এর চাইতে সত্য কথন আর কী হতে পারে ! জীবনের উষ্ণতায় সুরভিত তাঁর মধুক্ষরা গানগুলি চিরন্তন হয়ে রইল আমাদের হৃদয়ে।