।। তরঙ্গ ।।
অরিন্দম নাথ
(১)
একদিন ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম । ‘বনসাই’ ৷ এখানে আবার পোস্ট করছি :
# গতকালের একটি ঘটনা সন্দীপ বাবুকে খুব নাড়া দিয়েছে ৷ সন্দীপ রক্ষিত রাজ্য সরকারের কর্মচারী ৷ ত্রিপুরা সিভিল সার্ভিসের অফিসার ৷ মহাকরণে পোস্টিং ৷ ঠিকঠাক চললে বছর দু`য়েকের মধ্যে তাঁর সর্বভারতীয় সেবায় উত্তরণের আশা ৷ পার্থ প্রতিম মিত্র তাঁর মিত্র ৷ বয়সে ছোট তবে একই সাথে চাকুরীতে প্রবেশ ৷ পার্থ বাবু পুলিশ সেবায় কর্মরত ৷ বছর দু`য়েক হল তিনি রাজ্য পুলিশ সেবা থেকে সর্বভারতীয় সেবায় লিফট পেয়েছেন ৷ বর্তমানে পুলিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সামলাচ্ছেন ৷
গতকাল পার্থ বাবু এসেছিলেন সন্দীপ বাবুর কাছে ৷ অফিসের কাজে ৷ অনেকদিন পর দুই বন্ধুতে একসাথে বসে চা খেলেন ৷ একই শহরে থাকলেও দেখা-সাক্ষাৎ এখন কমই হয় ৷ কথায় কথায় তিনি মোবাইলে তোলা কিছু ছবি বন্ধুকে দেখালেন ৷ একটি ছবি দেখে সন্দীপ বাবুর মন বিষাদে ভরে গেল ৷
কয়েকদিন আগে পার্থ গিয়েছিলেন মফঃস্বলে ৷ পুলিশের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শনে ৷ সাথে একজন উচ্চপদস্থ অফিসারও ছিলেন ৷ গ্রীষ্মের দুপুর ৷ প্রচণ্ড রোদ থেকে বাঁচতে তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন একটি বটগাছের নীচে ৷ সাথে কয়েকজন অফিসার এবং সহকর্মী ৷ পার্থ বাবুর অনুরোধে একজন অধঃস্থন সহকর্মী তাঁর মোবাইলে সবার ছবি তোলে দিল ৷ বটগাছটি নেহাতই ছোট ৷ বড়জোর দুই বা আড়াই মানুষ সমান উঁচু ৷ তবে বেশ ঝাড়িদার ৷ হঠাৎ একজন কলিগ তাঁকে বলল, ‘স্যার, বলুন তো এই বট গাছটির বয়স কত হবে ?’
- বছর পাঁচেক ?
- না, কমপক্ষে পনের বছর !
- কি বলছ !
- বছর দশেক-তো বনসাই অবস্থায় ছিল ৷ তারপর মাটিতে লাগানো হল ৷
- তা-ই বল !
শক্ত কান্ড রয়েছে এমন গাছের খর্বাকৃতি করার শিল্পকে বনসাই বলা হয় ৷ বনসাই অর্থ ট্রের মধ্যে ফলানো গাছ ৷ প্রাচীন চীনা শব্দ ‘পেনজাই’ থেকে জাপানী ‘বনসাই’ শব্দের উৎপত্তি ৷ বনসাইয়ের ট্রেকে সাধারণভাবে ‘বন’ বলা হয় ৷ পশ্চিমে খর্বাকৃতির গাছ বলতে ‘বনসাই’ বোঝায় ৷
পার্থ বাবু চলে গেলে একাকী সন্দীপ বাবুর মনে বিচিত্র ভাবনার উদয় হল ৷ ভারতবর্ষে অধিকাংশ চাকুরীর ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ৷ কিন্তু চাকুরী ক্ষেত্রে সবাই কি সমান সুযোগ পায় ? অনেকেই, ছবির বটগাছটির মত বড় হবার পরিবেশ প্রথম থেকে পায় না ৷ বনসাই হয়ে থকে ৷# (২)
খানিকটা রূপক ধর্মী । কত শিক্ষিত বেকার যুবক সুযোগের অভাবে অকালে ঝরে যাচ্ছে । ঠিক যেন বামন গাছ । একজন মিতা মন্তব্য করলেন, "ঠিক বলেছেন স্যার ৷ কত যে বনসাই শেষ পর্যন্ত মাটি জল না পেয়ে, বনসাই হিসেবেই মরে যায় ৷ আরেকটা ট্রেন্ডও আছে, বড় গাছকে কেটে দিয়ে ছোট গাছকে বড় দেখানো ৷"
ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ৷ আমার এক সময়ের সহকর্মী ৷ অতি সজ্জন ব্যক্তি ৷ আমোদে লোক ৷ সেদিন তাঁর কথাগুলি সারাদিন মনের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রইল ৷ আমি পুলিশে যোগ দিয়েছি সরাসরি ডিএসপি হিসাবে ৷ উন্নিশশো নব্বই সালে ৷ এর আগে চার বছর শিক্ষকতার চাকুরী করেছি ৷ আমাদের বেসিক ট্রেনিং হয়েছিল মেঘালয়ের বরাপাণীতে । উত্তর পূর্বাঞ্চল পুলিশ একাডেমীতে ৷ শিলং শহর থেকে উনিশ কিলোমিটার দূরে বরাপাণী ৷ সুন্দর বনানী ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চল ৷ ঝাউ, পাইন, ওক, বটলব্রাস, দেবদারু এবং অন্যান্য সরলবর্গীয় গাছের সমাহার ৷ একপাশে গৌহাটি-শিলং জাতীয় সড়ক ৷ সাথে বরাপাণী লেক ৷ একবার স্নান করেছিলাম। তখন হোলি । তথাপি যেন বরফ শীতল জল ৷ পাহাড়ের একপাশে আমাদের কলেজ ৷ অপর পাশে ইউনিয়ন ক্রিশ্চান কলেজ ৷ সংক্ষেপে ইউসিসি ৷ আমাদের এক সহকর্মী কেরী মারাক । সে পড়াশুনা করেছে এই কলেজে ৷ সে ক্রিষ্টান ৷ সেই সুবাদে আমরা অ-ক্রিষ্টানরাও এক দু`একবার গিয়েছি কলেজ দেখতে ৷ চার্চে রবিবারের প্রেয়র শোনার চেষ্টা করেছি ৷ এক রবিবার সকালের অভিজ্ঞতা ৷ পাশের পাহাড়ে কয়েকটি পাইন গাছ একসাথে দাঁড়িয়ে ৷ সাধারণত চার-পাঁচটি পাইন গাছ একত্রে থাকে ৷ পাদ্রী আমাদের দৃষ্টি সেদিকে নিয়ে গেলেন : ‘ঈশ্বর, আমাদের শেষ জীবন যেন পাইন গাছের মত কাটে ৷ একাকীত্বে না কাটে ৷ সঙ্গী পাই ৷ পাইন গাছের মত ঋজু থাকি ৷ পাখি এসে বাসা করে ৷ কূজন শুনতে পাই ৷’
(৩)
প্রশিক্ষণ শেষে পুলিশের কাজে যোগ দিলাম ৷ উগ্রপন্থা তখন চরমে ৷ পুলিশ সেবাই তখন আমাদের ধর্ম ৷ ব্যস্ততায় থাকাই সুখের অনুভূতি ৷ মানুষের যখন খেয়াল থাকেনা কিভাবে সময় কেটে যাচ্ছে, তখনই সে প্রকৃত সুখী ৷ সেই বিচারে আমি খুবই সুখী ৷ একজন অগ্রজ অন্যভাবে চিত্র আঁকলেন ৷ বললেন : 'পুলিশে দু`টিই পোস্ট ৷ থানার বড়বাবু । আর জেলার এসপি ৷ দুইজন রাস্তার পাশের বড়ই গাছ ৷ ফলন্ত কুল গাছ ৷ যেতে আসতে সবাই ঢিল ছুঁড়ে যায় ৷ কারণে, অকারণে ৷'
একসময় কুল গাছও হলাম ৷ এখন আইজি । ফল বাড়ন্ত ৷ অবসরের সময় ঘনিয়ে এসেছে । বড়ই গাছ ছেঁটে দিলে নতুন করে ডাল গজায় ৷
(৪)
আরেকদিন এক সহকর্মীর সাথে স্মৃতির রোমন্থনে মগ্ন ছিলাম ৷ সে জনজাতি সম্প্রদায়ের ৷ লালমিঙ্গা ডার্লং । সেও আমার ব্যাচমেট । দু`জনে একসাথে উত্তর পূর্বাঞ্চল পুলিশ একাডেমীতে ট্রেনিং করেছি ৷ কথায় কথায় আমি বললাম, "বেশ আছি ৷ একটা ঝাটকা খেয়েছি । বাইপাস সার্জারি হয়েছে । এখন মোটামুটি রুটিন মাফিক চলি ৷ রোজ যোগ ব্যায়াম করি ৷ পরিমিত আহার করার চেষ্টা করি ৷ শুধু অনেকে মাঝে মধ্যে বেয়ারা প্রশ্ন করে, ‘স্যার, আপনি কী অবসরে চলে এসেছেন?”
ডার্লং হেঁসে বলে, "আমার অবস্থাও তোমার মত ৷ গ্রামের লোকজন বলে, ‘না, না, সামিয়ানা দিতে পারত না!"
গল্পের আভাষ পেয়ে তাকে চেপে ধরি ৷ চা খেতে খেতে গল্প হয় ৷ সে বলে, "তুমি তো জানো, আমার বাড়ি কোথায় ৷ আমাদের অঞ্চলে এক সময় উগ্রপন্থীদের সবসময় আনাগোনা থাকত ৷ এসডিপিও থাকাকালীন সময়ে অনেক সময় বাড়িতে ছুটি কাটাতে যেতাম । জেলার এসপি-রা নিজে থেকে আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতেন । এক্সট্রা গাড়িতে পুলিশ প্রোটেকশন দিয়ে দিতেন ৷ ইমার্জেন্সিতে প্রায়ই কাজে আসত ৷ তারপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হলাম ৷ টিএসআর কমান্ড্যান্ট হলাম ৷ জেলার এসপি হলাম ৷ তখনও আমার সাথে এসকর্ট এবং অস্ত্রধারী দেহরক্ষী থাকত ৷ এখন আইজি ৷ অফিসের কাজ সামলাই ৷ লোকজনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসি না ৷ উগ্রপন্থাও চলে গেছে ৷ ছুটিতে বাড়ি গেলে দেহরক্ষী নিই না ৷ লোকজন প্রশ্ন করে, ‘স্যার, আপনি কবে রিটায়ার করলেন?’
টিএসআর কমান্ড্যান্টের দিনগুলি ছিল খুবই মজাদার ৷ কমান্ড্যান্টের হাতে প্রচুর জনবল ৷ সাথে অপ্রত্যক্ষ ক্ষমতা ৷ আমাদের গ্রামদেশে বিয়ে কিংবা অনুষ্ঠানের জন্য সুসজ্জিত হল পাওয়া যায় না ৷ আমাকে গ্রামের লোকেরা অনুরোধ করত । একটা বা দুইটা সামিয়ানার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য ৷ জন-সংযোগের মাধ্যম হিসাবে আমি রাজি হতাম ৷ টিএসআরের লোকেরাই সুদৃশ্য সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দিত ৷ তারাই আবার গুটিয়ে নিত ৷ অনুষ্ঠানের শেষে অনেক সময়ই মাইকে আমার নামে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন হত ৷
সম্প্রতি আমাদের জুনিয়র ব্যাচের একটি ছেলে টিএসআর কমান্ড্যান্ট হয়েছে ৷ সে-ও আমাদের গ্রামেরই ছেলে ৷"
- আমি চিনি ৷
- বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছি ৷ জুনিয়র ডার্লংও বাড়িতে এসেছে ৷ সে টিএসআর কমান্ড্যান্টের পোশাকে ৷ সাথে এসকর্ট ৷ গ্রামের লোকজন তাকে ঘিরেই ভিড় করে ৷ অনেকে আমাকে দেখিয়ে বলে, ‘তাইনে-তো আরও বড় অফিসার!’
অন্যরা প্রতিবাদ করে ৷ উত্তর দেয়: ‘না, না, তাইনে সামিয়ানা দিতে পারত না! দেখ না হেঁর গাড়িতে ‘কমান্ড্যান্ট’ লেখা ৷ সাথে টিএসআরের এসকর্ট!’
(৫)
আসলে সুখ দুঃখ আপেক্ষিক । ব্যক্তি নির্ভর । সমুদ্রের ঢেউয়ের মত । সবসময় আবর্তিত হয় । এই প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য, "সমুদ্রের জীবনে যেমন জোয়ার-ভাটা আছে, মানুষের জীবনেও আছে। মানুষের সঙ্গে এই জায়গাতেই সমুদ্রের মিল।"
কবির ভাষায়:
" তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ--
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে ॥"
সামুদ্রিক ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় পৃথিবীর ঘুর্ণনের কারণে । বিজ্ঞান এর ব্যাখ্যা দেয় কোরিলিস ফোর্সের মাধ্যমে । মানুষের মননেও ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় । বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের বাহ্যিক জীবনের গতি শ্লথ হয় । কিন্তু মনের গতি রোখ মানে না । মন অনেক সময়ই আগের মত তীব্র গতিতে চলতে চায় । ফলে ঘূর্ণির সৃষ্টি হয় । তরঙ্গ উঠে । এই তরঙ্গের বেগ কারো মধ্যে বেশী । কারো মধ্যে কম । এক সময় মিলিয়ে যায় । পূর্ণতার পায়ে স্থান নেয় ।