স্বভূমির জন্য আন্দামানের আদিবাসীদের লড়াই

পান্নালাল রায়

আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরাও তাদের স্বভূমির জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ইংরেজ সরকারের অনুসৃত নীতির ফলেই তারা মারমুখী হয়ে উঠেছিল বহিরাগতদের বিরুদ্ধে। তাদের সবুজ বাসভূমিতে ধ্বংসাশ্রয়ী তৎপরতা তারা সহ্য করতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে অনিবার্য হয়ে উঠে আদিবাসীদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সংঘাত।

১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের পর যখন ব্রিটিশরা মূল ভূখণ্ড থেকে দণ্ডিতদের আন্দামানে পাঠাতে থাকে তখনই সেখানকার আদিবাসীদের ব্যাপক ভাবে স্বার্থ হানির সূত্রপাত ঘটে। ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিদ্রোহীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দ্বীপান্তরে আন্দামান পাঠায়। এইভাবে দণ্ডপ্রাপ্তদের জন্য আন্দামানে কলোনি গড়ে তুলে তারা,যা পেনেল কলোনি হিসেবে পরিচিত ছিল।এই ধরনের বসতি স্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক ভাবেই আন্দামানের সবুজ বনভূমিতে আঘাত আসে।অথচ এই সব বনাঞ্চলকে কেন্দ্র করেই ছিল আন্দামানের ‌আদিবাসীদের জীবন যাত্রা। সেজন্য বহিরাগত দণ্ডিতদের এখানে বসতির জন্য ১৮৫৭ সালের পর থেকেই আন্দামানীদের সঙ্গে ব্রিটিশদের বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলতে থাকে।বড় সংঘর্ষটি ঘটে ১৮৫৯ সালের মে মাসে পোর্ট ব্লেয়ারের কাছে।

লোক বসতির জন্য বনাঞ্চল ধ্বংস হতে শুরু হয়। কিন্তু আন্দামানের আদিবাসীরা তাদের জীবন জীবিকার স্বার্থে বাঁধা দেয় জঙ্গল পরিষ্কারের কাজে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই যারা এই কাজে যুক্ত ছিল তাদের উপর এই ক্ষোভ বর্ষিত হয়।দণ্ডপ্রাপ্ত বিদ্রোহী যারা আন্দামানে এসেছিল তাদেরকেই ব্রিটিশরা জঙ্গল কাটার কাজে লাগিয়েছিল। একসময় ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটলে আদিবাসীরা প্রথমে তাদেরকেই আক্রমণ করে। ব্রিটিশ বাহিনীকেও আক্রমণ করে তারা।১৮৫৯ সালের এপ্রিলে দুটি বড় ঘটনা ঘটে।প্রায় দুশো আদিবাসী তীর ধনুক নিয়ে আক্রমণ করে। এতে প্রায় আড়াইশ দণ্ডপ্রাপ্ত তীরবিদ্ধ হয়। কয়েক দিন পর আদিবাসীরা আরও বড় ধরনের হামলা চালায়।প্রায় দেড় হাজার আদিবাসী দণ্ডপ্রাপ্তদের কলোনিতে হামলা করে। তখন অনেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। পরবর্তী সময়ে জানা গেছে,যারা শৃঙ্খলিত ছিল তাদের বাদ দিয়ে অন্যরা ছিল আদিবাসীদের আক্রমণের লক্ষ্য। অর্থাৎ যারা শৃঙ্খলিত, তারা যে অসহায় এবং কষ্ট ভোগ করছে এটা আদিবাসীদের বোধগম্য ছিল। সেজন্য তারা আদিবাসীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়নি।

এদিকে দণ্ডিতদের যখন জঙ্গল কাটতে পাঠানো হতো তখন তাদেরই কেউ কেউ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুই ছিল তাদের নিয়তি। পালিয়ে গেলে তারা ধরা পড়তো গভীর জঙ্গলের আদিবাসীদের হাতে। তখন তাদের মৃত্যু ঘটতো। কিন্তু এরকম এক পলাতক দুধনাথ তিওয়ারিকে আদিবাসীরা শেষপর্যন্ত না মেরে তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়। সেখানে সেবা শুশ্রূষা করে আদিবাসীরা তাকে সুস্থ করে তুলে। একদিন আদিবাসীরা তাদের ঘরের মেয়ের সঙ্গে দুধনাথের বিয়েও দেয়। কিন্তু দুধনাথ একদিন সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে যে, আদিবাসীরা সবাই মিলিত হয়ে সভা করছে।সে বুঝে যায়, এবার একটা বড় ধরনের আক্রমণ সংঘটিত করবে তারা।দুধনাথের তখন অন্য চিন্তা।যদি এই খবরটি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় তবে হয়তো পুরস্কার স্বরূপ তার আন্দামানের নির্বাসিত জীবনের অবসান হবে। আবার পরিবার পরিজনদের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পাবে সে।যেমন ভাবা তেমন কাজ।দুধনাথ আদিবাসী মহল্লা থেকে পালিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে খবরটি দেয়।এই ভাবে তার বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশরা আগেই তাদের উপর আক্রমণের আভাস পেয়ে গিয়েছিল।

যাইহোক,মে মাসে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে আদিবাসীদের বড় সংঘর্ষ ঘটে। আদিবাসীরা আটলান্টা পয়েন্ট থেকে আবেরডিনে হামলা চালায়। ব্রিটিশ বাহিনী জাহাজ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে তাদের প্রতিরোধ করে। আদিবাসীরা তীর, ধনুক, বর্শা ব্যবহার করে তাদের আক্রমণে। পক্ষান্তরে ব্রিটিশদের ছিল বন্দুক,গোলা-বারুদ। এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ব্রিটিশদের অনুসৃত নীতির ফলেই আন্দামানের আদিবাসীদের স্বার্থ বিপন্ন হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সহ বহিরাগতদের সঙ্গে তাদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।১৮৫৯ সালে আন্দামানের আবেরডিনে আদিবাসীদের লড়াই আবেরডিন যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্ণিত হয়ে আছে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনায় আন্দামান এবং সেখানকার সেলুলার জেলের প্রসঙ্গ নিশ্চিত আসবে।১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের পর বন্দী ও দণ্ডপ্রাপ্ত বিদ্রোহীদের ব্যাপক হারে আন্দামানে পাঠায় ব্রিটিশরা। সেখানে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে উঠতে থাকে। পরবর্তী সময়ে গঠিত আন্দামানের সেলুলার জেলে স্হান হয় স্বাধীনতার বিপ্লবীদের। ব্রিটিশ সরকার আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ভূখন্ড 'পেনেল কলোনি' হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। শুধু ভারত নয়, আফ্রিকার রাজনৈতিক বন্দীদেরও আন্দামানে নির্বাসনে পাঠায় ব্রিটিশরা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালে জাপানিরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে আন্দামান অধিকার করে।১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্দামান সফর করেন এবং তিনি পোর্ট ব্লেয়ারে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন। জাপানের সঙ্গে সমঝোতা মূলে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজনৈতিক ক্ষমতা আজাদ হিন্দ সরকারের উপর ন্যস্ত হয়। নেতাজি সুভাষ আন্দামানের নাম রাখেন শহিদ দ্বীপ এবং নিকোবরের স্বরাজ দ্বীপ।

কিন্তু জাপানিরা আন্দামান অধিকার করার পর স্হানীয় মানুষের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল।১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ তারা পোর্ট ব্লেয়ার অধিকার করে। ব্রিটিশ গ্যারিসন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি।গ্যারিসনে কয়েকশো ভারতীয় সিপাহির সঙ্গে ২৩ জন ব্রিটিশ আধিকারিক ছিলেন।বলা‌ যায়, বিনা বাধায় জাপানিরা আন্দামান অধিকার করে নিয়েছিল। জাপানিরা ব্রিটিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তারা জেলের কয়েদিদের ছেড়ে দেয়।জাপান কর্তৃক অধিকারের পর শুরুর দিকে আন্দামানের বুদ্ধিজীবীরা রাসবিহারী বসুর ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লীগে যোগদানে উৎসাহী হয়েছিল।এর সদস্যদের নিয়ে শান্তি কমিটিও গঠিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জাপানিদের হাতে স্হানীয় মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে এই কমিটি চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। জাপানিরা স্হানীয় মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকে। মহিলাদের উপর যৌন নিপীড়ন সহ নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে মানুষকে হত্যাও করে তারা। কোরিয়ান ও মালয়া মহিলাদের ভোগের জন্য জাপানি গ্যারিসনে নিয়ে যাওয়া হতো। বিমান বন্দর নির্মাণে স্হানীয় মানুষের থেকে বলপূর্বক শ্রমিক নিয়োগ করা হতো। আন্দামান অধিকারের কয়েক মাস পর জাপানিরা সেখানে কয়েকশো লোককে গ্ৰেপ্তার করে এবং তাদের মধ্যে অনেককে সেলুলার জেলে নিপীড়ন করা হয়। গুপ্তচর অভিযোগে অনেকের উপর অত্যাচার চলে। জাপানিদের লক্ষ্য ছিল স্হানীয় প্রভাবশালী অংশ।ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লীগের সদস্যরা এসবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

১৯৪৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজনৈতিক ক্ষমতা নেতাজির আজাদ হিন্দ সরকারকে দেয়া হলেও তা ছিল মূলত কাগজপত্রে,বাহ্যিক। কার্যত সব ক্ষমতা ছিল জাপানিদের হাতেই। নেতাজি যখন পোর্ট ব্লেয়ার সফর করেন তখন স্হানীয় মানুষকে তাঁর কাছে ভিড়তে দেয়নি জাপানিরা।স্হানীয় মানুষ তাদের উপর নির্যাতনের কথা নেতাজির কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয় জাপানিদের বাঁধায়। এমনকি সে সময়েও সেলুলার জেলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরাও নিপীড়িত হচ্ছিলেন। পোর্ট ব্লেয়ার সফর শেষে নেতাজি ফিরে আসার পর দ্বীপপুঞ্জে জাপানিরা তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করে এবং তাদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।১৯৪৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৪ জন ভারতীয় অসামরিক ব্যক্তিকে জাপানিরা গুপ্তচর অভিযোগে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ইন্ডয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লীগের সদস্য ছিলেন।

জাপানিদের অত্যাচার থেকে আন্দামানের আদিবাসীরাও রেহাই পায়নি। দ্বীপপুঞ্জে লোকবসতি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে স্হানীয় আদিবাসীরা বনাঞ্চলের আরও ভেতরে চলে যায়। কিন্তু অরণ্যে আদিবাসীদের নিরাপদ আশ্রয় স্হলও জাপানিদের গোলাবারুদ থেকে রক্ষা পায়নি। তখন বিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ। তথাকথিত সভ্য মানুষ অস্ত্রশস্ত্রে আরও বলীয়ান। ঊনবিংশ শতকের তীর ধনুকের আবেরডিন যুদ্ধের স্মৃতিও তখন ম্লান।সব মিলিয়ে আন্দামানের আদিবাসীরা যেন তখন আরও অসহায়।

১৯৪৫ সালে জাপানিদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তারা তখন যেন আরও বেপরোয়া। আন্দামানে তখন দেখা দিয়েছিল তীব্র খাদ্য সংকট।খাদ্যশষ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে স্হানীয় কয়েকশো লোককে জাপানিরা লোক বসতি হীন দ্বীপে পাঠায়। অন্ধকারের মধ্যে গাদাগাদি করে নৌকা দিয়ে তাদের পাঠাবার সময় পথের মধ্যেই অর্ধেক লোকের মৃত্যু ঘটে। এদের কিছু সংখ্যক জলে ডুবে মারা যায়, কিছু আবার হাঙ্গরের খাদ্য হয়। তারপরও যারা বেঁচে গিয়ে জনমানবহীন দ্বীপে পৌঁছেছিল তাদেরও বেশিরভাগই অনাহারে মারা যায়। পরবর্তী সময়ে জাপানিদের কবলমুক্ত হবার পর সেই দ্বীপে মাত্র কয়েকজন জীবিত লোককে পাওয়া গিয়েছিল।আর পাওয়া গিয়েছিল শতাধিক কঙ্কাল।এই ভাবে ১৯৪২-৪৫ সালে জাপানি অধিকারের ফলশ্রুতিতে আন্দামানে দুই সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে।যাই হোক, শেষপর্যন্ত জাপানিদের কবল থেকে ব্রিটিশ সরকার আন্দামান উদ্ধার করে।১৯৪৫ সালের ১৫ আগষ্ট ভারতীয় বাহিনীর কাছে জাপানিরা আত্মসমর্পণ করে।আবেরডিন যুদ্ধে স্বভূমির জন্য আদিবাসীদের বলিদান, ভারতীয় বিদ্রোহীদের নির্বাসন,জাপানি অধিকার ও অত্যাচার, ঐতিহাসিক সেলুলার জেল- সব মিলিয়ে যেন দেশের স্বাধীনতা লড়াইর ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে আন্দামান।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.