।। টাকার গাছ ।।

অরিন্দম নাথ

(১)

মেঘনাদবাবুর বাসায় বেশ কয়েকটি টাকা গাছ আছে । এপিপ্রিমনাম আওরিয়াম । আদিবাড়ি ফ্রান্সের পলিনেশিয়ায় । সোসাইটি দ্বীপপুঞ্জে । প্রচলিত নাম মানিপ্ল্যান্ট । গাছটির বেশ কয়েকটি ভ্যারাইটি আছে । নামেও বৈচিত্র্য । সোনালি পোথো । সিলোন লতা । শিকারির পোশাক । আইভি আর্ম । সিলভার লতা । মার্বেল কুইন । শয়তানের লতা । কারণ এটি হত্যা প্রায় অসম্ভব । অন্ধকারে থাকলেও সবুজ থাকে । আরও নাম থাকবে । খুবই সুন্দর ইনডোর প্ল্যান্ট । বেশি যত্নও নিতে হয় না । যদিও তাঁর স্ত্রীই গাছগুলির পরিচর্যা করেন । মানি-প্ল্যান্ট ঘরে রাখলে টাকা আসে ! এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই । মেঘনাদবাবুরা সচ্ছল ছিলেন । এখনও সচ্ছল আছেন । তবে গাছগুলো তাঁর মনের খোঁড়াক বাড়িয়ে দিয়েছে ।

(২)

গাছগুলির বেশ ক'বছর বয়স হয়েছে । তখন সর্বত্র আড়িআড়ি ভাব । সেদিন তাঁর অফিস ছুটি ছিল । মেঘনাদবাবু বাড়িতেই ছিলেন । তখন বিকেল । সুকুমার রায়ের একটি ছড়া আত্মস্থ করছিলেন ।

"কিসে কিসে ভাব নেই ? ভক্ষক ও ভক্ষ্যে-

বাঘে ছাগে মিল হলে আর নেই রক্ষে ।

শেয়ালের সাড়া পেলে কুকুরেরা তৈরি,

সাপে আর নেউলে ত চিরকাল বৈরী !"

ছড়াটির মাধুর্যে খুশিখুশি ভাব । এমনি সময় তাঁর স্ত্রী ঘরে ঢুকলেন । হাতে একটি লতা । ভীষণই রুগ্ন । দেখে চিনতে পারলেন । বললেন, "মানিপ্ল্যান্ট কোথায় পেলে ?"

- প্যালেস কম্পাউন্ডের পাশ দিয়ে আসছিলাম । দেখলাম রাস্তায় পড়ে আছে । কোথাও হয়তো কোনও ভাঙচুর হয়েছে । প্রদীপকে বললাম নিয়ে নিতে ।

প্রদীপ ওদের ড্রাইভার । ভদ্রমহিলা সেদিনই লতাটিকে একটি টবে প্ল্যান্ট করলেন । সিঁড়িতে ওঠার মুখে একটি জানালার পাশে রেখে দিলেন । ওঠানামার পথে রোজ একবার দাঁড়িয়ে দেখতেন । সতেজ হয়ে বেশ তরতরিয়ে বাড়ছিল গাছটি ।

(৩)

কিছুদিন পর থেকে তিনি আর গাছটির পাশে দাঁড়ান না । তখন গাছটি অনেকটা বড় হয়েছে । জানালার গ্রিল গলিয়ে বাহির পানেও উকি দিয়েছে । এমনি সময়ে একদিন আবার নজর গেল । সেদিন বোধকরি রবিবার । দুজনেরই ছুটি । তাঁর স্ত্রী টবের গাছের পরিচর্যায় মন দিয়েছেন । পাশে বসে তিনি একটি বই পড়ছেন । বিষয় নীরদচন্দ্র চৌধুরীর 'আত্মবিস্মৃত বাঙালী' । স্ত্রী মানিপ্ল্যান্টের লতা কেটে নতুন টবে লাগাচ্ছিলেন । দুটো গাছ কোল্ড ড্রিংকের খালি বোতলেও স্থান পেল । তিনি মজা করে বললেন, "টাকা গাছ মনে হয় টাকা আনছে! নতুন একাউন্টস খোলা হচ্ছে । বোতলের দুটো তো মনে হচ্ছে মিউচুয়াল ফান্ড । প্রথমটি কারেন্ট একাউন্ট । এফডি একাউন্ট । এসবি একাউন্ট । ডিম্যাট একাউন্ট । আমি এইগুলির নাম দেব ।"

"বশ তো!", তাঁর স্ত্রী সাগ্রহে বলেন ।

(৪)

তিনি মত পাল্টান । স্থির করেন গাছগুলির নাম রাখবেন মানব-মানবীর সঙ্গে মিল রেখে । প্রথম গাছটি মেয়ে । নাম রাখেন দেবপর্ণা । বোতলের দুইটি যেন যমজ । নির্ঝর আর সুবিনয় । এরপর পরপর বিভোর, অধিপ আর যশস্বী । মানুষ যখন কোনও কিছুর নামকরণ করে এর মধ্যে ভাবনা জড়িয়ে থাকে । এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিল না । তখন বেশ রাজনৈতিক ডামাডোল চলছিল । তাঁর কলিগ, বন্ধু-বান্ধব অনেকের আচরণেই তিনি ব্যথিত হয়েছেন । তাঁর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়নি । তবে মনুষ্যত্বের বিকার লক্ষ্য করেছেন ৷ মুকেশের একটি গান তাঁর মনে আসতো ৷

“দোস্ত দোস্ত না রহা

প্যাঁর প্যাঁর না রহা

জিন্দেগী হমেঁ তেরা

এতবার না রহা, এতবার না রহা ...৷”

বন্ধু আর বন্ধু থাকে না ৷ আমার প্রেম আমার থাকে না ৷ হে আমার জীবন ! তোমার উপর আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি ! বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি !

(৫)

এই চরিত্রগুলির মধ্যে তিনি প্রতীক খুঁজতেন ৷ তাঁর পরিচিত জন ৷ পাশাপাশি যেন মহাভারতের চরিত্র ৷ দ্রৌপদী, সহদেব, নকুল, অর্জুন, ভীম এবং যুধিষ্ঠির ৷ যেন মহাপ্রস্থান চলছে ৷ বাড়িতে মেরামতির কাজ শুরু হবে ৷ যদিও টবের গাছ ৷ তথাপি ওদের অনেকেরই ডানা ছাঁটা হবে ৷ আসল দেবপর্ণা সরকারী চাকুরীজীবী ৷ সে দেখতে রমণীয় ৷ আগে সবার সহানুভূতি ছিল ৷ কলিগরা ভালোবাসতো ৷ এখন তার পদোন্নতি হয়েছে ৷ পাশাপাশি আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে ৷ নৈতিক স্খলনের কথাও কানে আসে । নির্ঝর দেখতে খুবই সুন্দর ৷ কিন্তু ভীষণই পরশ্রীকাতর ৷ অন্য কেউ ভালো পোশাক পড়লেও হিংসা হয় ৷ সামাজিক মাধ্যমে অনেক একাউন্ট রাখে ৷ অধিকাংশই বেনামে ৷ এখন নিজেই জানেনা এগোবে না, পিছোবে ৷ সুবিনয় ভীষণই বিনয়ী ৷ খুবই বিজ্ঞ ৷ তবে অনেক সময়ই ভীমরতি ধরে ৷ বিভোর খুবই স্বাস্থ্য সচেতন ৷ নিজের কাজে মগ্ন থাকতে ভালোবাসে ৷ এখন ফিফ্টি-ফিফ্টি অবস্থা ৷ অভিলাষ এমনিতে স্থিতধী ৷ তার আকাঙ্ক্ষা সীমাহীন ৷ নৈতিকতার স্খলনও ওর মধ্যে সর্বাধিক ৷ দুর্নীতিগ্রস্থ ৷ যশস্বী এখনও নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা ধরে রাখতে পেরেছে ৷ মেঘনাদবাবু টাকা গাছের মধ্যে বন্ধুদের খুঁজেন ৷ মনে মনে অনেককিছু কল্পনা করেন ৷ পৃথিবীটা কার বশ ? প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর ৷ পৃথিবী টাকার বশ ! অভিলাষের মত কিছু টাকা গাছ হয়তো শয়তানের লতা ৷


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.