খার্চ্চিঃ সুখ, সমৃদ্ধির প্রতীক

পান্নালাল রায়

ত্রিপুরার অন্যতম প্রধান উৎসব হচ্ছে খার্চ্চি।পুরান আগরতলার চতুর্দ্দশ দেবতা বাড়ি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব।খার্চ্চি পূজাকে কেন্দ্র করে বসে সপ্তাহ ব্যাপী মেলার আসর। ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চল তো বটেই,বহিঃরাজ্যের পুণ্যার্থীরাও এই মেলা ও পূজা দর্শনে আসেন।

অন্যান্য পীঠস্থানের মতো চতুর্দ্দশ দেবতাদেরও ঘিরে আছে ইতিহাস কিংবদন্তির যুগলবন্দী। অনেক অনেক কাল আগে মহারাজা ত্রিলোচন এই পূজার প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু কে এই ত্রিলোচন? 'রাজমালা'তে উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন কালে ত্রিপুর নামে ছিলেন এক অত্যচারী নৃপতি।ত্রিপুরের অত্যাচারে অতিষ্ট প্রজাগণ এ থেকে পরিত্রাণের জন্য শুরু করেন মহাদেবের আরাধনা। এবার মহাদেব ত্রিশূল দিয়ে বধ করলেন অত্যাচারী ত্রিপুরকে।এরপর ত্রিপুরের মহারানি হীরাবতী সিংহাসনে বসে রাজ্য শাসন করতে থাকেন। কিন্তু হীরাবতীর পর কে?কি ভাবে রাজ্য চলবে?প্রজাবর্গ অধীর হয়ে উঠলেন। আবার দেবাদিদেবের স্মরণ। মহাদেবের আশীর্বাদে এবার হীরাবতী সন্তানবতী হলেন। সেই সময়ে রানি পুত্র‌ সন্তান কামনায় চতুর্দ্দশ দেবতার পূজা করেছিলেন। এই পূজা নিয়েও রয়েছে লোকশ্রুতি।হীরাবতী একদিন স্নান করতে গিয়েছেন নদীতে। নদী পাড়ের এক শিমুল গাছ থেকে ভেসে এল আর্তনাদ।চোদ্দজন দেবতা আশ্রয় নিয়েছেন গাছে। তাদের তাড়া করছে এক ভয়ঙ্কর মোষ। দেবতাগণ প্রাণভিক্ষা চাইলেন রানির কাছে। কিন্তু স্নানরতা এক অবলা নারী কীভাবে রক্ষা করবেন দেবতাদের?দেবতাগণই এবার পরামর্শ দিলেন রানিকে।হীরাবতী তাঁর বক্ষাবরণী 'রিয়া' ছুড়ে দিলেন সেই দুর্দান্ত মহিষের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে মহিষটি স্তব্ধ হয়ে পড়ল। শিমুল গাছ থেকে নেমে এলেন চোদ্দজন দেবতা।তারপর বলি দেওয়া হল মহিষটিকে।হীরাবতী দেবতাদের নিয়ে গেলেন রাজবাড়িতে।যথাসময়ে রানির কোল আলো করে আসে পুত্র সন্তান।জন্মের সময় সন্তানের কপালে দেখা গিয়েছিল একটি চোখ।তাই তাঁর নাম হয় ত্রিলোচন।১০ বছর বয়সে ত্রিলোচন বসেন সিংহাসনে।জন্মের আগে মা হীরাবতী যেমন চতুর্দ্দশ দেবতার পূজা করেছিলেন, তেমনই ত্রিলোচনও রাজা হয়ে চতুর্দ্দশ দেবতা প্রতিষ্ঠা করে পূজার প্রচলন করেন। সেজন্যই বলা হয় চতুর্দ্দশ দেবতা ত্রিপুরার রাজবংশের আদি কুলদেবতা। পুরোহিত হলেন চন্তাই।

মহাভারতের সময়কার রাজা হলেন ত্রিলোচন।লোকশ্রুতি, সেই সুদূর অতীত থেকেই ত্রিপুরায় চতুর্দ্দশ দেবতার পূজা চলে আসছে।নানা সময়ে রাজধানীর স্হানান্তর ঘটেছে। ত্রিপুরার রাজাগণ ক্রমেই উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সরে এসেছেন। কিন্তু রাজারা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন চতুর্দ্দশ দেবতাদের‌‌‌।১৭৬০ সালে কৃষ্ণমাণিক্য উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন বর্তমান পুরান আগরতলায়। তারপর থেকে সেখানেই চতুর্দ্দশ দেবতাদের‌‌‌ পূজা হচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বর্তমান আগরতলায় রাজধানী সরিয়ে আনলেও চতুর্দ্দশ দেবতারা কিন্তু পুরান আগরতলাতেই রয়ে যান। সেখানে এবার ২৬২ বছরে পড়ল এই পূজা।

আজও পরম নিষ্ঠা আর ভক্তিভরে পূজিত হন চতুর্দ্দশ দেবতা। উল্লেখ্য, এই দেবতাদের কোনো পূর্ণাবয়ব বিগ্ৰহ নেই।পূজিত হন চতুর্দ্দশ দেবতার চতুর্দ্দশ মুন্ড। দেবতাদের মধ্যে হর বা মহাদেব হলেন প্রথম ও‌ প্রধান। বাকি দেবতারা হলেন উমা,হরি,লক্ষ্ণী,সরস্বতী, কার্তিকেয়,গণেশ,ব্রক্ষ্মা,পৃথিবী,সমুদ্র,গঙ্গা,

অগ্নি,কামদেব ও হিমাদ্রী।হর,উমা ও হরি-এই তিন দেবদেবীর মুন্ড নিত্য পূজিত হন। কিন্তু আষাঢ় মাসের শুক্লাষ্টমীতে একত্রে চতুর্দ্দশ দেবতার মুন্ড পূজিত হন।চতুর্দ্দশ দেবতার পূজা খার্চ্চি পূজা নামে পরিচিত। আষাঢ়ের শুক্লাষ্টমীতে এই পূজা শুরু হয়ে চলে সাতদিন। পূজা উপলক্ষে দেবতাবাড়ি প্রাঙ্গণে বিরাট মেলা বসে।খার্চ্চি আজ ত্রিপুরার নিজস্ব প্রধান এক উৎসবে পর্যবসিত হয়েছে। এটা মনে করা হয় যে, এই পূজাতে সংমিশ্রণ ঘটেছে বৈদিক,তান্ত্রিক এবং আরও নানা ধরণের পূজার্চনা রীতির।পূজায় মোষ, পাঁঠা,হাঁস, কবুতর ইত্যাদি বলির রীতি রয়েছে।

রাজ্যের সুখ, সমৃদ্ধি,ফসল উৎপাদন,রোগশোক থেকে মুক্তি -সব মিলিয়ে সামগ্ৰিক ভাবে দেশ ও দশের মঙ্গল কামনাতেই পূজিত হন চতুর্দ্দশ দেবতা। পূজার প্রচলনের কাহিনির মধ্যেই নিহিত আছে এর তাৎপর্য।অত্যাচারী নৃপতি ত্রিপুর নিধন ও ত্রিলোচনের জন্মের সূত্রেই প্রচলন হয়েছে এই পূজার। বস্তুতঃ এ যেন শুভ এবং অশুভের মধ্যে এক সংঘাত। লড়াই সুর ও অসুরে।খার্চ্চি শুভ শক্তির প্রতীক।সুখ ও সমৃদ্ধির ব্যঞ্জনা।বহু যুগের ওপার হতে এখনও যেন ভেসে আসে সেই আহ্বান। সকলের মঙ্গলের জন্য দেবতার আরাধনা।ত্রিলোচনের কাল থেকে একাল-একই কামনা। সকলের কল্যাণ,সুখ ও সমৃদ্ধি।আর এই কামনায় প্রতি বছর ত্রিপুরার উপজাতি,অনুপজাতি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ সমবেত হন খার্চ্চি প্রাঙ্গণে।ভক্তির সঙ্গে মিশ্রণ ঘটে মানুষে মানুষে ভালোবাসার চিরন্তনী ঐতিহ্যের।এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

সাত জুলাই বৃহস্পতিবার পুরান আগরতলায় শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী ঐতিহ্যবাহী খার্চ্চি উৎসব। রাজকীয় এই পূজায় আজও রাজকীয় আয়োজন। হাওড়া নদীর পুণ্যস্নানঘাটে দেবতাদের অবগাহনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী ঐতিহ্যবাহী খার্চ্চি উৎসব। বুধবার উৎসবের প্রাক সন্ধ্যায় মন্দির প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনারের মধ্য দিয়ে অধিবাস যাত্রা শুরু করেন চন্তাই। উল্লেখ করা যায় যে, ত্রিপুরার ভারতভুক্তির চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এই পূজার দায়িত্ব বর্তায় সরকারের উপর।

রাজধানী আগরতলার কয়েক কিলোমিটার দূরে পুরান আগরতলা এখন খার্চ্চি উৎসবে কলরব মুখর। সপ্তাহব্যাপী পূজাকে ঘিরে বসেছে মেলার আসর। আবার আয়োজন হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।উৎসব ঘিরে যেমন নানা ধর্ম বর্ণ আর ভাষাভাষী মানুষের মেলবন্ধন, তেমনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মালাতেও ত্রিপুরার মিশ্র সংস্কৃতির প্রবাহ।সব মিলিয়ে ত্রিপুরার খার্চ্চি উৎসব আজ সুখ, সমৃদ্ধি আর মানুষে মানুষে সম্প্রীতির প্রতীক।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.