১০৩২৩ শিক্ষক ও ত্রিপুরার বেকারদের নিয়ে আন্তরিকভাবে ভাবুন

জয়ন্ত দেবনাথ

দেশজুড়েই আজকাল সরকারী চাকুরীর বাজারে মন্দা। তাই স্থানীয় বেকারদের স্থানীয় প্রশাসনে চাকুরী পাইয়ে দিতে আসাম, সিকিম, বিহার, মধ্য প্রদেশ থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্র সরকার একের পর এক নানা রকম কঠোর আইন নিয়ে আসছেন। কিন্তু এরাজ্যের চাকুরী বাগিয়ে নিতে ভিন রাজ্যের বেকারদের সুযোগ করে দিচ্ছেন এরাজ্যের ‘জনপ্রিয় জনতার সবকা সাথ সবকা বিকাশের সরকার’। কেননা, ২ জানুয়ারি ২০২১ রাজ্য সরকারের সাধারণ প্রশাসন দপ্তর থেকে ২০১৮ সালের ৫ জুনের নিয়োগ নীতিতে সংশোধনী এনে বাংলা এবং ককবরককে ঢোকানো হলেও রাজ্য সরকারের চাকুরীতে বাংলা জানাটা পুরুপুরি বাধ্যতামূলক করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে ইন্টারভিউতে বাংলা ও ককবরক জানার জন্য কিছু অতিরিক্ত নম্বর যোগ্যতা বাছাই-এর ক্ষেত্রে প্রদান করা হবে এবং তা শুধু সরকারি দপ্তরে ডাইরেক্ট রিক্রুটমেন্ট-এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে আবার টেকনিক্যাল/হাইলি স্কিলড বিভিন্ন পদে স্থানীয় ভাবে যোগ্য প্রার্থী যেসব ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে না সেই সব পদ গুলিতে এই শর্তটি প্রযোজ্য হবে না বলেই সংশোধনিতে উল্লেখ করে রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য টেকনিক্যাল/হাইলি স্কিলড মেন পাওয়ার কোন গুলি তা স্পষ্ট করে সংশোধনিতে বলা না থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই সেসব পদে যে বহিঃরাজ্যের তথাকথিত কৃতিদেরই সুযোগ করে দেওয়ার ফন্দি এটে রাখা হয়েছে তা বলাই-বাহুল্য।



শুধু তাই নয়, এক্ষনে ত্রিপুরায় যেসব আউট সোর্সিং কোম্পানি মারফৎ স্থানীয় যুবকদের চাকুরী হচ্ছে তা টিআরএলএম, জাইকা প্রজেক্টই হোক কিংবা টি এস ই সি এল বা স্কিল মিশন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়োগকর্তা এসব কোম্পানী গুলিও বহিঃরাজ্য থেকে আমদানী করা হচ্ছে। অথচ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব নিজেও মুখে লগাতার ‘ভোকাল ফর লোকাল’ এর কথা বলে গেছেন। অথচ তার সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর গুলিতে পুননিযুক্তি পেয়েছেন বুড়ো ও অবসরপ্রাপ্তরা। এক্ষেত্রে ত্রিপুরা বিদ্যুৎ নিগমের ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগের কথা নিয়ে ইতিমধ্যেই বহু চর্চা, আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। গেইট (GATE) পাশের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট না থাকলে বিদ্যুৎ নিগমে জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ বাছাই-র পরীক্ষাতেই বসা যাবেনা গুছের শর্ত আরোপ করে বিজ্ঞাপন প্রচারের কারনে স্থানীয় বেকার ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকেই ইন্টারভিউতে বসতে পারেনি। রাজ্য বিদ্যুৎ নিগমের তৎকালীন এমডি এম এস কেলের কারসাজিতে বহিঃরাজ্যের বেকার যুবকরা চাকুরী বাগিয়ে নিয়েছে ত্রিপুরা বিদ্যুৎ নিগমে। মোট ২৩ জন জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ারকে গত ২০২০ সালে বিদ্যুৎ নিগমে নিয়োগ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯ জনই নিযুক্তি পেয়েছেন বহিঃরাজ্য থেকে। আর রাজ্য বিদ্যুৎ নিগম যখন এই কান্ডটি সংঘটিত করছিলেন তখন বিজেপি-র অন্য বড় রাজ্য মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ শিং চৌহান সে-সময় সে রাজ্যের বিধানসভায় আইন পাশ করিয়ে স্থানীয় সরকারী দপ্তরে বহিঃ রাজ্যের লোক নিয়োগে আইন করে বন্ধ করে দেন। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী আসাম রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল তাঁদের নিয়োগ বিধিতে একথাটি পাকাপাকি ভাবে ঢুকিয়ে দেন যে, আসাম সরকারের চাকুরী পেতে হলে আসামীজ জানাটা বাধ্যতামূলক। একই রকমভাবে সিকিমের রাজ্য সরকার একধাপ এগিয়ে তাঁদের নিয়োগ পলিসিতে বলে দেন যে বাইরের রাজ্যের বেকাররা সিকিমে চাকুরী পেতে হলে সিকিম -এর ভাষা ও সংস্কৃতি দুই বিষয়েই সম্যক ধারনা থাকতে হবে, তা প্রশাসনিক দপ্তরেই হোক কিংবা স্কুল কলেজের শিক্ষক অশিক্ষক নিয়োগ কিংবা অধ্যাপকের চাকুরী। অর্থাৎ নিজের রাজ্যের ব্যবসা বানিজ্য, চাকুরীর সুবিধা যাতে অন্য রাজ্যের বেকারদের কাছে চলে না যায় সে লক্ষ্যে যখন দেশের বড় বড় রাজ্য গুলি আইনী ফাঁকফোকর খুঁজছেন তখন ত্রিপুরার সবকা সাথ, সবকা বিকাশের সরকার নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশের রাস্তা প্রশস্থ করে চলেছেন লাগাতর। অথচ, বড় বড় শিল্প সংস্থাকে ডেকে আনার ব্যাপারে মন্ত্রী শীর্ষ আমলা অফিসারদের কারোরই কোন তৎপরতা নেই। কিন্তু যে কাজটি স্থানীয় লোকরা ভাল ভাবেই করতে পারদর্শী সেসব ক্ষেত্রে বাইরের লোকদের পুনর্বাসন দিতে তৎপর একাংশ মন্ত্রী আমলা অফিসার।

২০১৮-এর ৯ মার্চে ত্রিপুরায় নতুন সরকার গঠন হলে ৫ জুন ২০১৮ বিপ্লব দেব- এর নেতৃত্বাধীন নয়া মন্ত্রিসভা রাজ্যের আপামর বেকারদের কথা মাথায় রেখে তাদের ভাষায় বাম আমলের ভুলে ভরা নিয়োগ নীতি সংশোধন করে স্থানীয় বেকারদের স্থানীয় ভাবে বেশী করে সরকারী দপ্তরে নিয়োগের লক্ষ্যে একটা নয়া নিয়োগ পলিসি তৈরি করেছিলেন। ইতিপূর্বে ২০১৮ সালের ভোটের আগে বিপ্লব দেব ও তৎকালীন বিজেপি-র প্রচারের অন্যতম বড় মুখ সুনীল দেওধর একটি ফোন নম্বর প্রচার করে বলেছিলেন, “যে আগে মিস কল দেবে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাকে আগে চাকুরী দেওয়া হবে”। তাছাড়া, বিজেপি-র নেতারা তখন সবচেয়ে বেশী সোচ্চার ছিলেন সরকারী দপ্তরে বুড়োদের পুনঃ নিয়োগ বন্ধ নিয়ে। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে সরকারী দপ্তরে লোক নিয়োগ খুব একটা না হলেও বুড়দের পুনর্বাসন বন্ধ নেই। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর যে জয়ধ্বনি দিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সেই ইচ্ছাকেও বহু ক্ষেত্রে এরাজ্যের সরকারী দপ্তর গুলি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখাচ্ছেন ক্রমাগত, তা কৃষি দপ্তরে লোক নিয়োগ বা কৃষি কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ কিংবা অডিট দপ্তরের অধিকর্তা বাছাই, সব ক্ষেত্রেই খোঁজ চলছে পার্টটাইমার বুড়দের ও বহিঃরাজ্যের-কোম্পানীর।



কিছু কিছু দপ্তর আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে ভিন রাজ্যের কিছু কোম্পানী মারফৎ কিছু কিছু ক্ষেত্রে লোক নিচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল যেসব কোম্পানি গুলি আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে লোক সরবরাহ করছে এরা খুব কম টাকা দিয়ে বেকারদের সরকারী দপ্তর গুলিতে সরবরাহ করছে। গত ২০২১ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাজ্য সরকারের কর্ম বিনিয়োগ দপ্তর রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ৪০০০ বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগের জন্যে পাঁচটি বেসরকারী কোম্পানীকে আউট সোর্সিং এজেন্সী হিসাবে ‘এমপেনেল্ড’ করেছিল। রাজ্য কর্ম বিনিয়োগ দপ্তরের অধিকর্তা নরেশ বাবু-র স্বাক্ষরিত ওই সরকারী মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী আউট সোর্সিং কোম্পানী গুলির মাধ্যমে যেসব বেকাররা নিযুক্তি দেওয়ার কথা তাদের গ্রুপ ডি বা সাপোর্ট স্টাফ ওয়ান ও সাপোর্ট স্টাফ টু-র (নন মেট্রিক) বিভিন্ন পদে কাজের জন্যে সর্বোচ্চ ৭২৮০ টাকা এবং বিভিন্ন টেকনিক্যাল পদে যেখানে পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নুন্যতম স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা এম বি এসেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৭০৬৮ টাকা। এবং চাকুরী প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০ বছর। অর্থাৎ রাজ্য কর্ম বিনিয়োগ দপ্তরের মেমোরেন্ডামেই বলে দেওয়া হয়েছিল একজন এমবিএ কিংবা মাস্টার ডিগ্রির বেকারের সর্বোচ্চ বেতন হবে ১৭০৬৮ টাকা। অথচ যেসব পদগুলিতে এসব বেকারদের নিযুক্তির কথা বলা হয়েছিল, দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সব পদ গুলি কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য প্রযোজ্য। এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ওই প্রজেক্টে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন অনেক বেশি টাকা ধরা রয়েছে। যেমন রাজ্য সরকারের এন এইচ এম কিংবা এম জে এন রেগা কিংবা পঞ্চায়েতের একজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের বেতন যেখানে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ১০ হাজারেরও বেশী সেক্ষেত্রে কর্ম বিনিয়োগ দপ্তরের নির্ধারণ করে দেওয়া আউটসোর্স এজেন্সি গুলির মাধ্যমে প্রদেয় বেতন ছিল অনেক কম। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট যেখানে সম্প্রতি একাধিক রায়-এ সম কাজে সম বেতনের সুপারিশ করেছে সেক্ষেত্রে এরাজ্যে একই কাজের জন্যে একেকটি দপ্তরের স্থায়ী ও অস্থায়ী কাজের জন্যে একেক রকম বেতন নির্ধারণ করে দেওয়া হলো সরকারী ভাবেই। একজন এমবিএ কিংবা মাস্টার ডিগ্রীর স্কিলড ম্যান-পাওয়ার এত কম টাকায় পাওয়া যাবে কিনা তা যাচাই না করে আউট সোর্সিং কিছু কোম্পানীকে ম্যান-পাওয়ার সরবরাহের বরাত দেওয়া হলেও পরবর্তীকালে কোন এক অজ্ঞাত কারনে সেই প্রক্রিয়াটিও বাতিল হয়ে যায় এবং সফেদ নামে রাজ্য সরকারের একটি সংস্থাকে সরকারী দপ্তরে ঠিকা লোক নিয়োগ বা সরবরাহের দায়িত্ত দেওয়া হয়। কিন্তু সফেদ এর বিরুদ্ধে ঠিকা ম্যান-পাওয়ার সরবরাহের ক্ষেত্রেও অনিয়মের ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে।

অথচ, বিজেপি আইপিএফটি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন বাদেই পুলিশের টি এস আর (আই আর)-এর দুটি নয়া ব্যাটেলিয়ানের জন্যে দুই হাজার লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারী হয়েছিল। ৮২ হাজারের মতো বেকার আবেদন করেছিল। কিন্তু তিন বছরেরও বেশী সময় পরে এক হাজারের মতো লোক টি এস আর-এ নিয়োগ করা হলেও এক্ষেত্রেও অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ডিজি-র ফোন থেকে টাকা চেয়ে বেকারদের কাছে ফোন গেছে এমন অভিযোগ গেছে খোদ ত্রিপুরার উচ্চ আদালতে।

এছাড়া, পুলিশের পাঁচ শতাধিক কনস্টেবল পদে, মাল্টি টাস্কিং, এল ডি সি, পাম্প অপারেটর, এগ্রি এসিস্টেন্ট ইত্যাদি পাঁচ হাজারেরও বেশী পদে লোক নিয়োগে জয়েন্ট রিক্রুটমেন্ট বোর্ড (জে আর বি টি)-এর মাধ্যমে ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল। ত্রিপুরা সরকারের গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি-র বিভিন্ন পদে ভিন রাজ্যের বেকারদেরও ইন্টার্ভিউতে বসতে কোন বাধা ছিলনা। এর ফলে দেখা গেছে এক্ষেত্রেও কম করে দশ সহস্রাধিক ভিন রাজ্যের বেকার আবেদন জানায় ত্রিপুরাতে গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি-র বিভিন্ন পদে চাকুরি পেতে। অবশ্য আজ এক বছরেরও বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী লোক নিয়োগ করা হয়নি। পাঁচ হাজার শূন্য পদে লোক নিয়োগের নামে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারী করে বেকারদের কাছ থেকে পরীক্ষা ফি-র নামে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হলেও জয়েন্ট রিক্রুটমেন্ট বোর্ড এখন পর্যন্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পরীক্ষার ফলাফলও ঘোষণা করেনি। পুরানো প্রতিশ্রুতি পূরণ না করেই ২৮ জুন ২০২২ আবার প্রচার করা হয়েছে যে আরো ৫০০ কনস্টেবল, ১০০ পি আই ও ৬০ জন এগ্রি অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রাজ্য মন্ত্রিসভায়। মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তের কথা ২৮ জুন সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক সন্মেলনে জানিয়েছেন তথ্য মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী। এর আগেও পুর ও নগর ভোটের আগে বেশ কিছু দপ্তরে লোক নিয়োগ হচ্ছে বলে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের কথা প্রচার করা হয়। কিন্তু একটি ক্ষেত্রেও লোক নিয়োগ করা হয়নি। আর কিছু দিন বাদে বাদেই তথ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী পরস্পর বিরোধী নানা রকম সংখ্যা দিচ্ছেন প্রচুর পরিমাণে বেকারদের চাকুরী এবং কর্মসংস্থান হচ্ছে বলে। কেননা, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০ রাজধানীর শকুন্তলা রোডে আয়োজিত এক সভায় তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব দাবি করেছিলেন, ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪,৭৯৮ জনের নিয়মিত বেতনক্রমে চাকরি হয়েছে। এ সময়ে ডাই-ইন-হারনেসে চাকরি হয়েছে ৭৬৭ জনের। আউট সোর্সিংয়ে চাকরি পেয়েছেন ৪৫৮৭ জন, চুক্তি ভিত্তিক চাকরি হয়েছে ২৮৪৯ জনের। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব -এর দাবি ছিল ৩৩ মাসে সব মিলিয়ে তেইশ হাজার চাকরি হয়েছে। বিপ্লব দেব -এর দাবি অনুসারে ওই সময়ের মধ্যে স্বরোজগার, স্কিল ডেভেলাপমেন্ট সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে গেছে। তাছাড়া, সাব্রুমে স্পেশাল ইকোনমিক জোন (SEZ) চালু হয়ে গেলে নাকি আগামী দুই বছরে কম করেও আড়াই লাখের বেশী বেকারের কর্মসংস্থান হবে।

পক্ষান্তরে, গত ১৪ জানুয়ারি ২০২১ মহাকরণে সাংবাদিকদের শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ বর্তমান সরকারের সময়ে ১৫১০২ জনের চাকরি প্রদানের তথ্য তুলে ধরেছিলেন। সেদিনের শিক্ষামন্ত্রী-র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী গত ৩৩ মাসে রেগুলার পদে চাকরি হয়েছে ২৯৪৪ জনের, ২২৫০ জন চুক্তিবদ্ধ, আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে ১৯৫৬ জন, ৪০১ ডাই-ইন হার্নেসে চাকরি পেয়েছেন। সরকারী চাকরির প্রক্রিয়ায় শিক্ষামন্ত্রী সেদিন আরও ১১ হাজার ৮০০ এবং ৩ হাজার ৩৭৩টি পদে শীঘ্রই অফার ছাড়ার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন । কিন্তু সেই চাকুরী আজও হয়নি। এক দুজন ছাড়া বিজেপি-র নেতা মন্ত্রীদেরও অনেকেই চাকুরি ইস্যুতে এধরনের তুগলকি প্রচারে খুব্ধ। একই রকমভাবে তারা ১০৩২৩ ছাঁটাই শিক্ষকদের পুনর্বহাল নিয়ে বিজেপি-র প্রতিশ্রুতি খেলাপেও ক্ষুব্দ। কেননা, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের অর্ডারে ১০৩২৩ শিক্ষকদের সবার চাকুরী যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের তরফে আর টি আই-এর মাধ্যমে চাওয়া জবাবেও একথা বহু ছাঁটাই শিক্ষকদের লিখিত ভাবেই জানানো হয়েছে। তার পরও এদেরকে নিয়ে ত্রিপুরা সরকারের শিক্ষা দপ্তরের নির্মম রসিকথার কোন মানে নেই। তাছাড়া বিজেপি-র ভিসন ডকুমেন্টেও ২০১৮ সালের ভোটের আগে তাদেরকে চাকুরী ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল।

২০১৮ সালে ভোটের আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ও অন্যান্য বিজেপি নেতাদের মুখে এটাও শোনা যেতো যে রাজ্যে সাড়ে সাত লাখ বেকার রয়েছে। সিপিএম ২৫ বছর রাজ্যে বেকারদের নিয়ে শুধু রাজনিতি করেছে। সরকারি চাকরি দেওয়া হয়নি, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হয়নি। কিন্তু বিজেপি দল ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরেই প্রচার শুরু হয়ে যায় রাজ্যে চাকুরী দেওয়ার মতো যোগ্য বেকার নেই। এবং ন্যাশানেল কেরিয়ার সেন্টারের ডাটাবেসে বেকারের সংখ্যা কমিয়ে সাড়ে সাত লাখের জায়গায় তা ২ লাখে নামিয়ে আনা হয়। আর প্রচার শুরু হয়ে যায় রাজ্যে নাকি গত চার বছরে সাড়ে পাঁচ লাখ বেকার মুদ্রা যোজনা, স্কিল ইন্ডিয়া, প্রধানমন্ত্রী স্বরোজগার যোজনা, স্বাবলম্বন, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া ইত্যাদি নানা সরকারী প্রকল্পে ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে গেছেন। কিন্তু বাস্তবে এখনু এরাজ্যের বেকার যুবক যুবতিরা কতটা সরকারি চাকরি-মুখি তা দু’একটি ক্ষেত্রে সরকারী চাকুরীর বিজ্ঞাপনের পর চাকুরি প্রার্থীদের আবেদনের সংখ্যা থেকেই তার একটা অনুমান করা যায়।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাজ্য গ্রামোন্নয়ন দপ্তর ষোলশ’র মতো গ্রাম রোজগার সেবক (জি আর এস) –এর অস্থায়ী পদে লোক নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারী করেছিল ২০২০ সালে। ওই বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর এই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। দেখা গেছে, প্রায় ৪০ হাজারের মতো বেকার এই পরীক্ষায় বসেছিল। যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল মাধ্যমিক পাশ। কিন্তু এম এ, এম কম এমনকি পি এইচ ডি করছেন এমন বেকারাও এই চাকুরী পরীক্ষায় বসেছিল। অবশ্য সেই চাকুরীর অফার এখন পর্যন্ত কোন বেকার পায়নি। একই রকম ভাবে গত ২৩ মার্চ রাজ্য বিধানসভায় অর্থ মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন খুব শীগ্রি পূর্ত ও গ্রাম উন্নয়ন দপ্তরে ৭১০ জন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করা হবে। কিন্তু তিন মাস চলেগেছে এখন পর্যন্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারী হয়নি।

এর আগে, গত বছর পুলিশের পাঁচ শতাধিক কনস্টেবল, মাল্টি টাস্কিং, এল ডি সি, পাম্প অপারেটর, এগ্রি এসিস্টেন্ট ইত্যাদি পাঁচ হাজারের মতো শুন্য পদে লোক নিয়োগে যখন ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল তাতে এক লাখ ৪২ হাজারের মতো বেকার যুবক যুবতী আবেদন করেছিল। নানা কারনে অনেকের নাম বাদ গেছে। এবং শেষ পর্যন্ত ৪২ হাজারের মতো বেকার পরীক্ষায় বসেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও চাকুরি কারোরই হয়নি। সর্বশেষ গত ৩ জুলাই ২০২২ মহাকরণে এল ডি ক্লার্ক নিয়োগ পরীক্ষায়ও ৩৫ হাজার বেকার পরীক্ষায় বসেছে। শুন্যপদ মাত্র ৬০ টি। অথচ, ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটের আগে ভিশন ডকুমেন্টে বিজেপি ঘরে ঘরে কম করেও একটি করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। প্রতিশ্রুতি ছিলো বিজেপি ক্ষমতায় এলে প্রথম এক বছরে ৫০ হাজার বেকারের চাকরি প্রদান করা হবে। সেই ক্ষেত্রে অফার ছাড়া, নিয়োগ এবং শীঘ্রই নিয়োগপত্র ছাড়া সবকটি বিষয় যোগ করেও গত এক বছরে তা হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী-র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ১৫১০২ জনের বিভিন্ন পদে চাকরি হয়েছে। আর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী-র দাবী, ২৩ হাজার চাকুরি প্রদান করা হয়েছে এবং স্বরোজগার, স্কিল ডেভেলাপমেন্ট সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ইতিমধ্যেই বিজেপি সরকারের চার বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান, ৫০ হাজার বেকারকে প্রথম বছরেই চাকুরির প্রতিশ্রুতি পুরনে যে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি এটা বিভিন্ন সময় মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর প্রদত্ত তথ্যেই স্পষ্ট। অথচ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর গুলিতে পঞ্চায়েত এক্সটেনশন অফিসার, ফুড ইন্সপেক্টর, এক্সাইজ ইন্সপেক্টর, আই সি ডি এস সুপারভাইসর, স্টেনোগ্রাফার, পিএ, লেবার অফিসার, এক্সাইজ অফিসারের মতো পদে অন্তত ২০ হাজারের মতো পদ শুন্য রয়েছে। সব গুলি দপ্তরের শুন্য পদের সংখ্যা হিসাব করলে শুন্য পদের সংখ্যাটা এই মুহূর্তে কম করেও ৩৪ থেকে ৩৫ হাজারের মতো হবে। এর মধ্যে শুধু শিক্ষা দপ্তরেই ২৫ হাজারেরও বেশি পদ শুন্য। খাদ্য দপ্তরে ২৪৮, ৪৩ টি বেসরকারি স্কুল গুলিতে ৬৪২, মৎস দপ্তরে ৪৪৭, আরবানে ৪১, বন দপ্তরে ৮৬৩, তথ্য দপ্তরে ৩৯৬, বিদ্যুৎ দপ্তরে ২০০০, পঞ্চায়েতে ১৮৭৯ টি-র মতো পদ শূন্য। শুন্যপদের উল্লেখিত তথ্য রাজ্য সরকারের তরফে গত মার্চ মাসে রাজ্য বিধানসভায় প্রদত্ত তথ্য অনুসারে উল্লেখ করা হয়েছে। সব দপ্তরের শূন্য পদের হিসাব করলে এই সংখ্যাটা আরও বেশী হবে। এছাড়া, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে শুন্যপদ সংক্রান্ত ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ-এর ত্রিপুরা এসসি ওয়েলফেয়ার দপ্তরের এক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ১৫৯২০ টি ও এস সি-দের জন্য সংরক্ষিত ৮৭৪৩ টি পদ এখনো শূন্য। কিন্তু রাজ্য প্রশাসন বিভিন্ন দপ্তরে রেগুলার শুন্যপদেও লোক নিয়োগে দ্রুত কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। কদিন বাদে বাদে শুন্যপদ সৃষ্টির নামে শুধু রাজ্য মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত প্রচার করা হচ্ছে। চাকুরী আর হচ্ছেনা। চাকুরী প্রদানের নামে রাজ্য সরকারের এই লোকুচুরি খেলায় রাজ্যের বেকারদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পরিশেষে তাই আমি বিনীত ভাবে ত্রিপুরার জোট সরকারের প্রতি অনুরোধ রাখতে চাই ত্রিপুরার ছাঁটাই ১০৩২৩ শিক্ষক ও বেকারদের কথা একটু আন্তরিক ভাবে ভাবুন। তা না হলে ২০২৩-এ এরাই আপনাদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যথেষ্ট হবে। ৮ জুলাই ২০২২ । ( লেখক একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদক)


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.