খুনিরা যখন খুনের মামলার তদন্ত করেন তখন তার সুফলাফলের আশা বৃথা
পুরুষোত্তম রায় বর্মন
জামাল হোসেন। বাড়ি সোনামুড়া। দুবাইয়ে কর্মরত। ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। ঘরে স্ত্রী, তিন নাবালক সন্তান, মা ও ভাই বোন রয়েছে। ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১, দুবাই ফিরে যাওয়ার ইন্ডিগো টিকিট কাটা ছিল। ১৪ ই সেপ্টেম্বর, রাত্রি ১১ টা নাগাদ জামালের বাড়িতে চড়াও হয় সোনামুড়া থানার দারোগা বাবু। জামালের খোঁজ করে। জামাল বেরিয়ে আসতেই শুরু হয় জামালের উপর লাথি ঘুষির বৃষ্টি। কিছু বোঝার আগেই জামালকে টেনে হিচড়ে তোলা হয় পুলিশের গাড়িতে। জামালের মাকে ওসি জানায়, খুব শীঘ্রই জামালের মৃতদেহ তারা পাবে। পরের দিন সকালে আনুমানিক ১০ টা নাগাদ জামালের ভাইকে থানা থেকে জানানো হয় লকআপে জামাল মারা গেছে। সুস্থ সবল জামালকে থানা হাজতে পিটিয়ে খুন করা হয়। হাজত হত্যা ও হাজত হিংসার ক্রমবর্ধমান তালিকায় আরেকটি নাম যুক্ত হয়। জামালের স্ত্রী, মা ও তিন নাবালক সন্তান উচ্চ আদালতে হাজত হত্যার দায়ে রাজ্য সরকারকে অভিযুক্ত করে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করে। এর আগে জামালের স্ত্রী দুই পুলিশ অফিসার ও অন্যদের বিরুদ্ধে সোনামুড়া থানায় খুনের মামলা দায়ের করে। উচ্চ আদালতে রাজ্য সরকার হলফনামা দিয়ে জানায় , জামালকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ২০০৯ সনের একটি পুরনো মামলার সূত্রে এবং গ্রেফতারের সময় জামাল পালানোর চেষ্টা করে এবং পালাতে গিয়ে পড়ে যায়। পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। থানায় আনার পর রাত্রিবেলা জামাল বুকের ব্যথার কথা জানায়। তাকে সোনামুড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বাবু ইসিজি করার কথা বলেন। তারপর মেলাঘর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু ইসিজি করা হয়নি। সকাল ৪টার সময় জামালকে থানা হাজতে ফিরিয়ে আনা হয়। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ হাজতের প্রহরী জামালকে ডাকতে গিয়ে দেখে জামালের কোন সাড়াশব্দ নেই । জামাল শুয়ে আছে নিথর হয়ে। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হয়। ডাক্তারবাবু এসে জামালকে দেখেশুনে জানিয়ে দেয় জামাল মৃত। ২৭ বছরের যুবক একটি শবদেহ। সরকারের বক্তব্য জামালের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে।
মৃত্যুর পর শবদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছিল। ময়না তদন্তের রিপোর্টে জামালের শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পিঠে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ডাক্তারী পরিভাষায় ট্রাম লাইন ইঞ্জুরি । ট্রাম লাইন ইনজুরিতে মৃত্যু হতে পারে। হাজতে মৃত্যু হলে রুটিন মাফিক কিছু অনুষ্ঠান করা হয়। উদ্দেশ্য অবশ্যই লোক দেখানো। সবাইকে দেখানো তদন্ত হবে। অপরাধ করলে কাউকে ছাড়া হবে না। ভড়ং এর সীমা পরিসীমা নেই। জামালের মৃত্যুর পরও সহকারী জেলাশাসক প্রশাসনিক তদন্ত করেছিলেন। তদন্তের রিপোর্ট যা হয় তাই হয়েছিল। হৃদরোগে মৃত্যু।
লক্ষিন্দরের বাসর ঘরেও ছিদ্র থাকে। জামালের সাথে থানা হাজতে ওই অভিশপ্ত রাত্রিতে ছিলেন আরেক আসামি । নাম তার রঞ্জিত দেবনাথ । প্রশাসনিক তদন্তে রঞ্জিত দেবনাথের বয়ান নথিভুক্ত করা হয়েছিল। রঞ্জিত দেবনাথ বলেছে, যখন জামালকে রাত্রিবেলায় লকআপে আনা হয় তখন সে যন্ত্রনায় উচ্চস্বরে চিৎকার করছিল। সারা রাত্রি যন্ত্রণায় সে ছটফট করেছে। জামালের মা, স্ত্রী ও বোন প্রশাসনিক তদন্তে তাদের বয়ানে স্পষ্ট ভাবে বলেছেন , জামালকে বাড়ি থেকে আটক করার সময় তার বুকে ও পিঠে প্রচন্ডভাবে আঘাত করা হয় রাইফেলের বাট দিয়ে। জামালের স্ত্রী পুলিশ অফিসারের পায়ে পড়ে কাকুতি মিনতি করেছিল তার স্বামীকে না মারার জন্য। কে শোনে কার কথা । গ্রেফতারের সময় ও লকআপে নিয়ে জামালের উপর অত্যাচারের ফলে জামালের বুকে প্রচণ্ড চাপ পড়েছিল। তাই সে চিৎকার করছিল বুক ব্যথায়। দুটো হাসপাতালে নিয়ে গেলে ও কোথাও তার ইসিজি করা হয়নি । সামান্য চিকিৎসাও করা হয়নি। শুধু ডাইজিন ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছিল। হাজত হত্যা ও বিনা চিকিৎসায় জামালের মৃত্যু হয়েছিল। জামালের মা প্রশাসনিক তদন্তে স্পষ্টভাবে তার বয়ানে বলেছিল, গ্রেফতার করার সময় পুলিশ বন্দুকের বাট দিয়ে জামালের বুকে আঘাত করে এবং মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর পিঠে আঘাত করা হয়। জামালের স্ত্রী ও একই কথা বলেছিল। তারপরেও সিপাহী জেলার সহকারী জেলাশাসকের তদন্তে জামালের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু। হৃদরোগে মৃত্যু। বিবেকহীন প্রশাসনিক কর্তারা চোখ থাকতেও অন্ধ। মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ। সরকারকে খুশি করার জন্য তারা যা খুশি করতে পারে। দিনকে রাত বানাতে পারে। গৃহস্থকে চোর বানাতে পারে। লম্পটকে সাধু বানাতে পারে।
উচ্চ আদালত সরকারের বক্তব্য খন্ডন করেছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট, প্রশাসনিক তদন্তে নথিভুক্ত রঞ্জিত দেবনাথ ও জামালের স্ত্রী ও মায়ের বয়ান ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করে। উচ্চ আদালত দ্বিধাহীন ভাবে বলেছে , জামালের মৃত্যু হাজত হত্যা। তার জন্য জামালের স্ত্রী, মা ও সন্তানদের ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাজ্য সরকারকে এক মাসের মধ্যে। এই রায় উচ্চ আদালত দিয়েছে বিগত ২২.০৬.২০২২ ।
একটি জীবনের মূল্য কি নিছক ১০ লক্ষ টাকা। যারা জামালকে খুন করল তাদের বিচার কি হবে। উল্লেখ্য পুলিশ অফিসার তপন দত্ত ও অন্যদের বিরুদ্ধে জামালের স্ত্রী সোনামুড়া থানায় খুনের মামলা করেছিল। সেই মামলায় করিত কর্মা পুলিশ ইতিমধ্যে তদন্ত সমাধা করে ফেলেছে। পুলিশের বক্তব্য তদন্তে প্রমাণিত জামাল হৃদরোগে মারা গেছে। অর্থাৎ জামালকে যারা পিটিয়ে খুন করল তাদের কোন বিচার হবে না কারণ পুলিশের তদন্তে জামাল মারা গেছে হৃদয় ঘটিত অসুখে। খুনিরা যখন খুনের তদন্ত করে তখন যা হয় তাই হয়েছে। জামালের স্ত্রী ও তার নাবালক সন্তানদের এখন লড়তে হবে খুনের সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আরেক প্রস্থ আইনি লড়াই। অসম লড়াই , কঠিন লড়াই। পাথরে মাথা ঠেকিয়ে পাথরটাকে নড়ানো কঠিন। এই লড়াইয়ে আমরা অবশ্যই তাদের পাশে থাকব। রিট মামলায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও রায় ফৌজদারি তদন্তে কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না উচ্চ আদালত স্পষ্ট করে বলেছে। তাই খুনিদের চিহ্নিত করে সাজা দিতে হলে তদন্তের মাধ্যমেই সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে সাজা দিতে হবে। ব্যবস্থাটা যখন অপরাধীর পক্ষে থাকে, রাষ্ট্র যখন তার সমস্ত ছলাকলা, অনুষ্ঠান , ভড়ং , ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি নিয়ে অপরাধ ও অপরাধীদের পক্ষে দাঁড়ায় তখন এর বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকের লড়াইটা বড় যন্ত্রণাদায়, বড়ই কঠিন। তারপরও লড়তে হবে। জামালের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত নাগরিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করেছে। তার জন্য নিশ্চয়ই আমরা উচ্চ আদালতের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য , বিচার ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাগরিকদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ায় না। সংবেদনশীলতার পরিচয় দেয় না। হাজত হিংসা ও হাজত হত্যা প্রতিরোধে বিচার বিভাগের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগ অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্ব পালন করে না। অনেক ক্ষেত্রেই নিম্ন আদালতগুলো পুলিশের কাজে চোখ বুজে সিলমোহর দিয়ে দেয়। পুলিশের কথায় বিনা কারণে আসামিকে সাত দিন/ দশ দিনের পুলিশ হাজত দেওয়া হয় এটা জেনেশুনে যে পুলিশ হাজত দেওয়ার অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসামিকে নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেওয়া। থার্ড ডিগ্রি মেথড আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। জেরার জন্য বল প্রয়োগের দরকার পড়ে না। এখনতো এনকাউন্টারের নাম করে ঠান্ডা মাথায় খুন সারা দেশে জল ভাত। বছর দুয়েক পূর্বে হায়েদ্রাবাদে একজন দন্ত চিকিৎসককে ধর্ষণ ও পুড়িয়ে মারার অভিযোগে চারজন যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জানানো হয় গ্রেফতারের পর তারা পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিতে যায়। তখন পুলিশ আত্মরক্ষায় গুলি করে। চারজনের মৃত্যু হয় । এই ঘটনা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই তদন্তের রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টের জমা পড়েছে। তদন্তের রিপোর্ট দেশবাসী জেনেছে। যদিও তেলেঙ্গানা সরকার অনুরোধ করেছিল রিপোর্ট জনপরিসরে প্রকাশিত না করার জন্য। সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দেয়। রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে ওই চার যুবককে ঠান্ডা মাথায় তেলেঙ্গানার পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে।
ত্রিপুরাতে হাজত হিংসা ও হাজত হত্যার অনেক ঘটনা ঘটে। আমরা মানবাধিকার কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচার দিতে পারি না। কারণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াইটা খুব কঠিন । সমস্ত স্তরে এমনভাবে সত্যকে মাটি চাপা দেওয়া হয় সেখান থেকে সত্যকে টেনে বের করে আনা বাস্তবিকই প্রায় দুঃসাধ্য কাজ। আমাদেরও দক্ষতার অভাব আছে। জামালের মা, স্ত্রী ও সন্তানদের আংশিক বিচার দিতে পেরে আমরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি। বামফ্রন্ট আমলেও হাজত হত্যার কোন বিচার হয়নি। হাজত হত্যার সব ঘটনাগুলোকে আত্মহত্যার গল্প বলে ফেরি করা হয়েছে। আর গত চার বছরে হাজত হত্যা প্রচন্ড ভাবে ঊর্ধ্বমুখী ত্রিপুরাতে। জেলখানাগুলোতে কয়েদিদের উপর হিংসার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। হিংসায় মৃত্যু হয়েছে। গত চার বছরে থানা হাজতে হিংসায় অনেকগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রেই আমরা আংশিক বিচার পেয়েছে।
বর্তমানে আমরা এক নৃশংস চরম হিংস্র এবং বিষাক্ত ব্যবস্থার মধ্যে আছি। রাষ্ট্রের চেহারা হিংসায় ভরপুর। এই সময়ে দাঁড়িয়ে মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই খুবই কঠিন। তারপরও হাল ছাড়লে চলবে না। ত্রিপুরা হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন হাল ছাড়বে না। অন্যায় যতই পরাক্রমশালী হোক না আপাতত, অন্যায় কিন্তু ভীতু ও কাপুরুষ। আমাদের পৌরূষাকার, দৃঢ়তা ও উন্নত চেতনার কাছে সমস্ত অন্যায়কে একদিন হার মানতেই হবে।
পুনশ্চঃ - রাজ্য সরকার উচ্চ আদালতের রায় মানতে প্রস্তুত নয়। জামালের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে না। কৌশিক নাথ জামালের পরিবারের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, এক মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিতে। কৌশিককে চিঠি দিয়ে রাজ্য সরকার জানিয়েছে , উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে যাবে। সরকারি টাকার আদ্য শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছু হবে না। গাধা জল খায় , জল ঘোলা করে খায়। সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারের আপিল ডাস্টবিনের ছুড়ে ফেলে দেবে । এইটুকু ভরসা রাখা যায়। আমরাও সুপ্রিম কোর্টে যাব ক্ষতিপূরণের টাকা ১০ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৫০ লক্ষ করার জন্য।