।। দ্বৈত ভারত ।।

অরিন্দম নাথ

(এক)

আমার ককবরক জ্ঞান খুবই সীমিত ৷ জ্ঞাত ককবরক শব্দ-সংখ্যা মনে হয় না দুই অংক পেরুবে বলে ৷ ককবরক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আমাকে ভুগিয়েছে । বিশেষত আমাদের রাজ্যের চরম উগ্রপন্থার দিনগুলোতে ৷ তখন একটি দৃশ্য প্রায়ই নজরে আসত ৷ হয়তো কোথাও বৈঠক চলছে ৷ মধ্যে সাময়িক বিরতি ৷ হঠাৎ নজর গেল জনজাতি সম্প্রদায়ের অফিসারদের দিকে ৷ তাঁরা এক জায়গায় জটলা করে মাতৃ-ভাষায় কথা বলছে ৷ হাসি-ঠাট্টা করছে ৷ যদিও এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই ৷ তবু আমার কাছে একটু বিসদৃশ লাগত ৷ এই ধরনের জটলা বাইরেও নজরে আসত ৷ স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সর্বত্র ৷ আমি যেন এই আলোচনায় অপাংক্তেয় ৷ ককবরক জ্ঞানে নিজের অজ্ঞতাকে ধিক্কার দিতাম ৷ আমার বন্ধু হয়েও অফিসাররা তাদের আলোচনায় আমাকে নিচ্ছে না ৷ ব্যথা অনুভব করতাম ৷

(দুই)

এখন আমার এই উপলব্ধি হয় না ৷ সৌজন্যে এক বাঙ্গালী সহকর্মী । শান্তনু ভট্টাচার্য ৷ তার একমাত্র ছেলে পড়াশুনায় ভীষণ ভাল ৷ মাধ্যমিকে এবং উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করেছে ৷ গত বছর জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে বাইরে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছে ৷ ছেলের গৌরবে শান্তনু গর্বিত ৷ একদিন তাকে প্রশংসা করায় সে বলল, "একটি কথা বলব স্যার । আমার ছেলের ভালো রেজাল্টের জন্য আমি গোপালদার কাছে ঋণী ৷ কনস্টেবল গোপাল দেববর্মাকে আপনি হয়তো চেনেন ৷ মফঃস্বলে দীর্ঘদিন খেটেছেন ৷ এখন রিটায়ারমেন্টে যাবার সময় হয়েছে ৷ তার এক ছেলে আজ ডাক্তার ৷ মেয়ে বিআইটি মেশ্রাতে এমটেক করছে ৷ আমার ছেলে তখন ক্লাস এইট পাশ করে নাইনে উঠেছে ৷ পরীক্ষার ফল আশানুরূপ নয় ৷ গোপালদার ছেলে তখন ডাক্তারি পড়ছে ৷ উপজাতিদের মধ্যে জয়েন্টে প্রথম দিকে স্থান ৷ আমি গোপালদাকে জিজ্ঞাসা করলাম । সারা জীবন বাইরে থেকেও কি করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করছেন ৷ তিনি হাসলেন । তারপর আমাকে তাঁর ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে দেওয়া একটি উপদেশের কথা শুনালেন, "বাড়িতে যতই ককবরকে কথাবার্তা বল, বাইরে ইংরেজি বাংলা সব ভাষাতেই কথা বলবে ৷ বন্ধুত্ব পাতবে বাঙ্গালী, অবাঙ্গালী সবধরনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ৷ আর বাকিটা তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ ৷"

গোপালদার কথায় আমার চোখ-কান খুলে গেল ৷ আমাদের এখানে পড়াশুনা প্রাইভেট টিউশনি ভিত্তিক ৷ আমার ছেলে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র ৷ আমি ছেলেকে প্রাইভেট টিউটরের কাছে নিয়ে যেতাম ৷ সেখানে রামকৃষ্ণ মিশন, হলিক্রস, ডন-বসকো, ভারতীয় বিদ‍্যাভবন, প্রণবানন্দ, হিন্দি স্কুল, শ্রীকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও আসত ৷ অভিভাবকরাও আসতেন ৷ ছেলে-মেয়েদের ড্রপ করতে কিংবা নিয়ে যেতে ৷ আমাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হত ৷ খুব সহসাই পড়াশুনায় বিভিন্ন স্কুলের ভাল ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের সনাক্ত করতে সক্ষম হলাম ৷ প্রথম আমি এইসব অভিভাবকদের কাছাকাছি গিয়ে তাঁদের আলোচনা শুনতাম ৷ সুযোগ পেলে চা-বিস্কিট খাওয়াতাম ৷ ক্রমে আমি তাঁদের গ্রুপের সদস্য হয়ে গেলাম ৷ এর সুফল পেল আমার ছেলে ৷ পড়াশুনায় কৃতি ছেলে-মেয়েদের সাথে আমার ছেলেরও সখ্যতা হল ৷ তারা অনেক সময় নোটস্ বিনিময় করত ৷ এরপর আর ছেলের জন্য আমাকে ভাবতে হয় নি ৷ সে বরাবরের জন্যই ভাল রেজাল্ট করতে থাকে ৷"

(তিন)

শান্তনুর কথিত গোপালদাকে আমি চিনতাম ৷ আমি তখন জেলা-পুলিশে কর্মরত ৷ অবিভক্ত দক্ষিণ জেলায় পোস্টেড । আমার এক সহকর্মী ডিএসপি-র দেহরক্ষী ছিল ৷ তিনিও ছিলেন ককবরক-ভাষী ৷ প্রসঙ্গক্রমে তাঁরও ছিল মাতৃভাষী অফিসারদের নিয়ে জটলা করে গল্প করার ব্যামো ৷ কয়েক বছর হল তিনি এসপি হিসাবে অবসরে এসেছেন ৷ জীবনে অনেক উন্নতি করেছেন ৷ সম্পত্তি করেছেন ৷ শতশত কানি রবার বাগানের মালিক হয়েছেন ৷ তাঁর দেহরক্ষীর মত উনারও এক ছেলে । এক মেয়ে ৷ মেয়েটি কলেজে পড়ার সময় পালিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দের একটি উপজাতি ছেলেকে বিয়ে করে ৷ মেয়ে-জামাইয়ের গাড়ির ব্যবসা ৷ ছেলেটি ডিপ্লোমা পাশ করে পৈতৃক সম্পত্তি দেখভাল করছে ৷

(চার)

উপরে উল্লেখিত ভারত, সনাতন ভারত । শ্বাশত ভারত । এই ভারতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে । সংগ্রাম আছে । সততা আছে । ভাল খারাপ আছে । সব কিছু নিয়েই এই ভারত । এর বাইরে আরেক ভারত আমার মননে ধরা দিয়েছে । ইংরেজরা এই দেশে শাসন করতে এসে আমাদের ইংরেজি শিখিয়েছে ৷ আইন-কানুন আদব-কায়দা শিখিয়েছে ৷ আইন প্রণয়ন করেছে । এইসব আইনের অধিকাংশই এই উপ-মহাদেশে কমবেশি লাগু রয়েছে । ‘ভারতীয় দণ্ডবিধি’ বা আই পি সি লাগু হয় ১৮৩৫ সালে । এই আইনের প্রণেতা ছিলেন টমাস বানিংটন মেকলে । তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে । অনেকটা সংবিধানের প্রস্তাবনার মত । কিংবা বিবেকের দংশন থেকে আত্ম-উপলব্ধি ।

“আমি ভারতের প্রান্তে ও উপান্তে ঘুরে বেরিয়েছি ৷ একজন মানুষকেও দেখলাম না যে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় মেলে দিয়েছে তার ভিখিরি হাত । অথবা বেছে নিয়েছে চৌর্যবৃত্তি ৷ এমনই সম্পদের স্বত্বধারী এই ভূমি ৷ এমনই নৈতিকতা । তার বুদ্ধিবত্তা । এই দেশকে পরাহত করা, একটি অলীক কল্পনা রয়ে যাবে ৷ যদি জয় করতে হয়, তবে ভাঙতে হবে তার মেরুদণ্ড । তার অধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পদ ৷ তাই তার পরম্পরাগত শিক্ষা প্রণালীকে বিধ্বস্ত করতে হবে ৷ ধ্বংস করতে হবে পরম্পরাগত সংস্কৃতিকে ৷ তাকে বুঝাতে হবে ইংরেজি ভাষা এবং সভ্যতা অতুলনীয় উৎকর্ষের । এই ধারণা যদি শিক্ষা প্রণালীর মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের রক্তে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তবে তাদের নিজের সংস্কৃতির সম্বন্ধে গৌরববোধ ধ্বসে পড়বে । তারা পরিণত হবে এক হীণমন্যজাতিতে ৷ আর তখনই তাদের দাসে পরিণত করা যাবে ৷”

(পাঁচ )

একটি ইংরেজি কবিতা পড়েছিলাম । স‍্যোসাল মিডিয়ায় । 'আমার মৃতপ্রায় বিবেক' । ইন্টারনেট ঘেঁটে জানত পারি কবিতাটি লিখেছেন রশমী ত্রিবেদী । দিল্লীর এক লেখিকা । অপূর্ব কবিতাটির বয়ান । এর কিছু অংশের ভাবার্থ এখানে উল্লেখ করছি ।

মাঝে মাঝে রাত গভীরে আমার বিবেক জেগে ওঠে । আমি বুঝার চেষ্টা করি বেচে আছি কি না । কারণ দিনানুদিন মৃত্যু তিলে তিলে আমাকে গ্রাস করছে ।

সুসজ্জিত রেস্তোরাঁ থেকে দামি খাবার খেয়ে বেরিয়ে আসি । দারোয়ান হাসিমুখে গেট খুলে দাঁড়ায় । তার মাসিক বেতন হয়তো আমার একটি মিলের চেয়েও কম । আমি দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যাই । বুঝতে পারি আমার বিবেক আমাকে মৃত্যুর দিকে এক কদম নিয়ে যাচ্ছে ।

আমি সবজিওয়ালার কাছ থেকে সবজি কিনি । তার ছেলে 'ছোটু' ওজন করে দেয় । ছোটুর এখন স্কুলে পড়ার বয়স । আমি অন‍্যদিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাই । বুঝতে পারি আমার বিবেক আমাকে মৃত্যুর দিকে এক কদম এগিয়ে নিয়ে গেছে ।

বুটিক থেকে দামি পোশাক কিনে বেরিয়ে আসি । পথে চৌমাথায় দাঁড়িয়ে থাকা কোনও এক নারী নজরে আসে । অতিকষ্টে সে দেহের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছে । আমি গাড়ির কাচ তুলে দিই । বুঝতে পারি আমার বিবেক আমাকে মৃত্যুর দিকে আরও এক কদম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।

আমার সন্তানের জন্য দামি খেলনা কিনে দোকান থেকে বেরিয়ে আসি । পথে অভুক্ত পথশিশুকে ট্রাফিক আলোর পাশে দেখি । খেলনা বিক্রি করছে । আমি কিছু খেলনা কিনে নিজের বিবেককে রক্ষা করার চেষ্টা করি । তথাপি বুঝতে পারি আমার বিবেক আমাকে মৃত্যুর দিকে আরও এক কদম কাছে নিয়ে গেল ।

অনেক সময় আমার গৃহপরিচারিকা অসুস্থতার জন‍্য কাজে আসতে পারে না । সে তার স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে কাজের জন্য পাঠিয়ে দেয় । আমি দেখেও না দেখার ভান করি । আরও দুটো এটো বাসন সিঙ্কে ছুঁড়ে দিই । বুঝতে পারি আমার বিবেক আমাকে মৃত্যুর দিকে এক কদম এগিয়ে নিয়ে গেল ।

কোনও শিশুর ধর্ষণ কিংবা খুনের খবর শুনে আমি উৎকণ্ঠায় থাকি । যখন জানতে পারি ধর্ষিতা কিংবা খুন হওয়া বাচ্চাটি আমার কেউ নয়, সুস্থির নিশ্বাস ফেলি । আমি আয়নায় নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি আমার বিবেক আমাকে মৃত্যুর দিকে আরও এক কদম এগিয়ে নিয়ে গেল ।

যখন মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে ঝগড়া করে আমি ব‍্যথীত হই । অসহায় বোধ করি । দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক নেতাদের গালি দিই । তাঁদের জন্য দেশ জাহান্নামে যাচ্ছে । আমি হয়তো কিছুটা দায়িত্ব পালন করি । তথাপি বুঝতে পারি আমার বিবেক আমাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।

(ছয়)

নিম্নবিত্ত কিংবা মধ‍্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে রূপান্তরিত হওয়া যেকোনও বিবেকবান ব‍্যক্তির মধ্যেই হয়তো এই অনুভূতি আসে । কিন্তু আমরা ব‍্যক্ত করি না । আজাদী কা অমৃত মহোৎসব আমরা পালন করছি । অনেকদিন হতে চলেছে ব্রিটিশরা আমাদের দেশ ছেড়ে গিয়েছে । সত‍্যিই কি তাই ! তারা আমাদের জিনে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে । যার স্বপ্ন দেখেছিলেন আইপিসি আইনের প্রণেতা টমাস বানিংটন মেকলে সাহেব । আজ আমাদের দেশের আদালতে প্রায় তিন কোটি মামলা বিচারাধীন । এর সাথে যুক্ত হচ্ছে আরও কত শত মামলা । মেকলের স্বপ্নের ফসল । জাস্টিস ডিলেড ইজ জাস্টিস ডিনাইড । আরও কত বছর লাগবে এইসব মামলার নিষ্পত্তি হতে আমরা জানি না । আইনের চোখে সবাই সমান । তাহলে বড় উকিলেরা গরীবদের মামলা লড়েন না কেন ?

(সাত)

আমরা আমাদের পুরাতন ভারতীয় ঐতিহ্যকে ভালোবাসি ৷ জাতি হিসেবে ইংরেজদের ছেড়ে যাওয়া ভাল দিকগুলি অধিকাংশ জনগোষ্ঠী মেনে নিয়েছে । বিশেষত আইনের প্রতি দায়বদ্ধতা মেনে নিয়েছে ৷ পাশাপাশি একটি গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে । তারা ইংরেজদের খারাপ গুণগুলো করায়ত্ত করেছে । দেশকে লুণ্ঠন করে বিদেশের ব‍্যাংকে টাকা জমাচ্ছে । দেশের অর্থনীতি দুর্বল করছে । এদের একটা বড় অংশ বিত্তবান । টাকার বিনিময়ে আইনকে প্রভাবিত করতে পারে । প্রথিতযশা বিত্তবান উকিলেরা যখন ড্রাগসের মামলার আসামী, কিংবা খুন-ধর্ষণের মামলায় আবদ্ধ মক্কেলকে রক্ষা করেন তখন আইনের বিচারে কোনও পাপ হয় না । কারণ এই আইন টমাস বানিংটন মেকলে সাহেবেরা রচনা করেছেন । আমাদের পরম্পরাগত ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী । যেখানে আমরা কামনা করি, সত‍্যের জয়, অসত‍্যের পরাজয় । ধর্মের জয়, অধর্মের পরাজয় । এই অসত্য ভারতের চালিকা শক্তি দুর্নীতিগ্রস্থ লোকেরা । ধোকাবাজ, দাঙ্গাবাজ, নেশাকারবারী, অপরাধী এবং এদের রক্ষাকর্তারা । অধিকাংশ সময়ই এরা মুখোশ পরে থাকে । দুইটি ভারত সংস্কৃতিগত ভাবে আলাদা । এই দ্বৈত সত্তার বিবেকের দংশনে আমরা আজ প্রতিনিয়ত জর্জরিত ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.