কাশ্মীর ও কাশ্মীরি
ড. হৈমন্তী ভট্টাচার্জি
May 2, 2025
কাশ্মীর, হিমালয় পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত একটি মনোরম অঞ্চল। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জগৎবিখ্যাত। পূর্বে কাশ্মীর বলতে মূলত কাশ্মীর উপত্যকাকেই বোঝানো হতো, কিন্তু বর্তমানে এর মধ্যে জম্মু, লাদাখ, আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তানও অন্তর্ভুক্ত। এই অঞ্চলটি ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বিতর্কিত।
ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। পরবর্তীতে এখানে মুসলিম শাসনের বিস্তার ঘটে। মুঘল ও আফগানদের পর উনিশ শতকে শিখ এবং তারপর ডোগরা রাজারা কাশ্মীর শাসন করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর কাশ্মীর একটি বিতর্কিত অঞ্চলে পরিণত হয়। এখানকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে চাইলেও, হিন্দু রাজা হরি সিং ভারতের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ হয়। বর্তমানে কাশ্মীর অঞ্চলের প্রায় ৫৫% ভারতের অধীনে (জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল), ৩০% পাকিস্তানের অধীনে (আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান) এবং ১৫% চীনের অধীনে (আকসাই চীন ও ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট)।
কাশ্মীরের প্রাকৃতিক শোভা অতুলনীয়। এখানে রয়েছে উঁচু পর্বতমালা, গভীর উপত্যকা, স্বচ্ছ হ্রদ এবং সবুজ বনানী। শ্রীনগরের ডাল লেক, গুলমার্গ ও সোনমার্গের মতো সুন্দর স্থান পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এখানকার হস্তশিল্প, বিশেষ করে কাশ্মীরি শাল, বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত।
তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সীমান্ত সমস্যা কাশ্মীরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control) প্রায়শই উত্তপ্ত থাকে।
কাশ্মীর সমস্যা একটি দীর্ঘস্থায়ী আঞ্চলিক সংঘাত যা মূলত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। এছাড়াও, এই অঞ্চলের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যেও বিরোধ রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তির পর এই সংঘাতের সূত্রপাত হয়, যখন ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই প্রাক্তন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সম্পূর্ণ অংশের মালিকানা দাবি করে। এই বিরোধের জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ এবং বেশ কয়েকটি ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
* ১৮৪৬: দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর, ব্রিটিশরা কাশ্মীর উপত্যকা রাজা গুলাব সিংকে বিক্রি করে দেয়, যিনি জম্মু ও লাদাখেরও শাসক ছিলেন।
* ১৯৪৭: ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হওয়ার সময়, কাশ্মীর রাজ্যের হিন্দু মহারাজা হরি সিং সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন যে তিনি ভারত না পাকিস্তানে যোগদান করবেন নাকি স্বাধীন থাকবেন।
* অক্টোবর ১৯৪৭: পাকিস্তানের দিক থেকে উপজাতীয় মিলিশিয়া কাশ্মীরে আক্রমণ করলে, মহারাজা হরি সিং ভারতের সামরিক সহায়তার বিনিময়ে বিতর্কিত 'ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেসন'-এ স্বাক্ষর করেন এবং কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
* ১৯৪৭-৪৮: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধ শুরু হয়।
* ১৯৪৮: ভারত কাশ্মীর সমস্যাটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে।
* জানুয়ারি ১৯৪৯: জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় এবং একটি নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) তৈরি হয় যা কাশ্মীরকে দুটি অংশে বিভক্ত করে - ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর।
* পরবর্তী দশক: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত থাকে এবং কাশ্মীর নিয়ে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়।
* ১৯৮৯: ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরে পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির উত্থান ঘটে, যা সহিংসতা আরও বাড়িয়ে তোলে।
* ১৯৯৯: কার্গিল যুদ্ধ হয়, যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে।
* পরবর্তী বছর: নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সংঘর্ষ এবং উত্তেজনা লেগেই থাকে।
* ৫ আগস্ট ২০১৯: ভারত সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে এবং রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে - জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। এই পদক্ষেপের ফলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
* বর্তমান পরিস্থিতি (মে ২০২৫): কাশ্মীর অঞ্চলে এখনও উত্তেজনা বিরাজ করছে। সম্প্রতি, এপ্রিল ২০২৫ সালে পর্যটকদের উপর একটি মারাত্মক হামলা হয়, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ককে আরও কঠিন করে তুলেছে।
কাশ্মীর সমস্যা একটি জটিল এবং সংবেদনশীল বিষয়, যার দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত ইতিহাস রয়েছে। এর সমাধান এখনও অধরা রয়ে গেছে এবং এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এটি একটি বড় হুমকি।
কাশ্মীরে বসবাসকারী লোকেদের কাশ্মীরি বলা হয়।
কাশ্মীরি একটি জাতিগোষ্ঠী এবং সেই অঞ্চলের প্রধান ভাষা। তারা মূলত কাশ্মীর উপত্যকায় এবং সংলগ্ন অঞ্চলে বাস করে।
কাশ্মীরে বসবাসকারী মানুষদের মানসিকতা একটি জটিল বিষয়, যা ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণগুলির দ্বারা প্রভাবিত। সেখানকার মানুষের মানসিকতাকে কয়েকটি প্রধান দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে:
সংঘাত ও অনিশ্চয়তা: দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ও রাজনৈতিক অস্থিরতা কাশ্মীরীদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বহু বছর ধরে চলা সহিংসতা, নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সেখানকার মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই প্রিয়জন হারিয়েছেন বা traumatic অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন।
সহানুভূতি ও আতিথেয়তা: এত প্রতিকূলতার পরেও কাশ্মীরীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তা এবং সহানুভূতির জন্য পরিচিত। তারা অতিথিদের উষ্ণভাবে স্বাগত জানায় এবং সাহায্য করতে দ্বিধা করে না। এই বৈশিষ্ট্যটি তাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সহনশীলতা): কাশ্মীরীরা বহু বছর ধরে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে আসছে। তারা তাদের সাহস, ধৈর্য এবং স্থিতিশীল থাকার ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। প্রতিকূলতাকে জয় করার এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করার আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে প্রবল।
পরিচয় ও সংস্কৃতি: কাশ্মীরীদের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয় রয়েছে। "কাশ্মীরিয়াত" নামক একটি বিশেষ ঐতিহ্য তাদের মধ্যে প্রচলিত, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহাবস্থান এবং ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের উপর জোর দেয়। তারা তাদের ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং রীতিনীতির প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী।
আশা ও আকাঙ্ক্ষা: যদিও কাশ্মীরীরা অনেক কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে, তবুও তাদের মধ্যে উন্নত ভবিষ্যতের আশা বিদ্যমান। তারা শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা রাখে। বিশেষ করে যুব সমাজ শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং একটি স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন দেখে।
ক্ষোভ ও হতাশা: দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং উন্নয়নের অভাবের কারণে কিছু কাশ্মীরীর মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার অনুভূতিও দেখা যায়। তারা মনে করতে পারে যে তাদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস: কাশ্মীরীদের অধিকাংশই মুসলিম এবং ধর্ম তাদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রদান করতে পারে।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে কাশ্মীরে বসবাসকারী সকল মানুষের মানসিকতা একরকম নয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে তাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা থাকতে পারে। তবে, উপরে উল্লেখ করা দিকগুলি সাধারণভাবে কাশ্মীরীদের মানসিকতার একটি চিত্র তুলে ধরতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন...