পঞ্চম পর্ব : এক বিষাদিত উপসংহার

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

অনেক সংগীতজ্ঞের অভিমত, গত শতকের ষাট এবং সত্তর দশক হল হিন্দি চলচ্চিত্র-সংগীতের সুবর্ণ যুগ। কিন্তু আশির দশকে সেই অবস্থার অবনতি ঘটে। রুপোলী পর্দার রাগী যুবক অমিতাভ বচ্চনের প্রচ্ছায়ায় প্রায় অন্তর্হিত হয়েছিলেন দেশের প্রথম স্যুপার স্টার রাজেশ খান্না। অমিতাভ বচ্চনের সিনেমায় গানের গুরুত্ব তেমন ছিল না। এর প্রভাব পড়েছিল পঞ্চম অর্থাৎ গায়ক এবং সুরকার রাহুল দেববর্মণের ক্যারিয়ারেও। রাজেশ খান্না, শক্তি সামন্ত আর রাহুল দেববর্মণের বিপ্রতীপে তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল প্রকাশ মেহেরা, মনমোহন দেশাই সহ অমিতাভ বচ্চন’এর সঙ্গত। এর পাশাপাশি ছিল আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আশির দশকে দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের হিন্দি রি-মেক প্রভুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এইসব রি-মেক চলচ্চিত্রের কতগুলি বৈশিষ্ট ছিল। জিতেন্দ্র, শ্রীদেবী, জয়াপ্রদার সঙ্গে সঙ্গতকারী হিসেবে থাকতেন কাদের খান এবং শক্তি কাপুর। ভাঁড়ামো পূর্ণ এই সব চলচ্চিত্রে সংগীতের ভূমিকা হয়ে উঠেছিল গৌণ। নৃত্যশৈলীর নামে যা পরিবেশিত হতো তা আসলে প্রাথমিক স্কুলে বাচ্চাদের শেখানো কসরত ! কিন্তু এমন সব নৃত্যশৈলী বহুল চলচ্চিত্রই দর্শক মহলে হয়ে উঠেছিল তুমুল জনপ্রিয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দেশব্যাপী ডিসকো ম্যানিয়া। বাপ্পি লাহিড়ীর ডিসকো সংগীত আর মিঠুন চক্রবর্তীর নাচে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দর্শক । ১৯৮৭’তে কিশোর কুমারের মৃত্যু ছিল রাহুল দেববর্মণের পতনোন্মুখ ক্যারিয়ারের শেষ চূড়ান্ত বজ্রাঘাত। এমন সব বিপর্যয়ের মাঝেও রাহুল দেববর্মণ বেশ কিছু ছবির সংগীতে মন মাতানো সুর দিয়েছিলেন। গানগুলি শুধু তৎকালীন সময়ে নিরিখে নয় – আজও কিন্তু সমান জনপ্রিয় এবং হৃদয় স্পর্শী।

আশির দশকের প্রথমার্ধে তিন অভিনেতার তিন পুত্রকে তারকা বানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন রাহুল দেববর্মণ। তাঁর সুরারোপিত রাজেন্দ্র কুমারের পুত্র কুমার গৌরবের ‘লভ স্টোরি’ , সুনীল দত্তের পুত্র সঞ্জয় দত্তের ‘রকি’ এবং ধর্মেন্দ্র পুত্র সানি দেউলের ‘বেতাব’ বক্স অফিসে চূড়ান্ত সফল হয়েছিল। এমন সফলতা সত্বেও আশির দশকের ওই টাল মাটাল সময়ে নিজের কাজ নিয়ে অতৃপ্তিতে ভুগছিলেন রাহুল দেববর্মণ। সময়ের সঙ্গে মানুষের মন মানসিকতা যে বদলাচ্ছে - সে কথা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তিনি নিজেকে ফের নতুন ভাবে গড়ে পিটে নিতে চাইছিলেন। কিন্তু কাজ আর পাচ্ছিলেন না তেমন। স্বজনেরা সব মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।

আশির দশকের নঞর্থক পরিবর্তনের ধাক্কা রাহুল দেববর্মণ শেষ পর্যন্ত আর সইতে পারেন নি। প্রাণবন্ত ‘ও হাসিনা জুলফোঁ ওয়ালি জানে জাহাঁ / ঢুনতি হ্যায় কাফির আঁখে কিসকা নিশান/ মেহফিল মেহফিল এ শামা ফিরতি হো কাহাঁ’র পাশাপাশি হৃদয় স্পর্শী ‘মেরে নৈনা শাওন ভাদো, ফির ভি মেরা মন প্যায়াসা’ অথবা প্রাণোচ্ছ্বল ‘আজ না ছোড়েঙ্গে বস হামজোলি/ খেলেঙ্গে হাম হোলি / চাহে ভিগে তেরি চুনরিয়া / চাহে ভিগে রে হোলি / খেলেঙ্গে হাম হোলি’র মতো গানের সুরকার রাহুল দেববর্মণ অনন্তলোকের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন প্রায় নিঃশব্দেই। পরিচিতেরা পাশে কেউই ছিলেন না তাঁর মহাপ্রয়াণের সময়। পুরোনো বন্ধু এবং চিত্র নির্মাতারা একে একে সবাই দূরে সরে গিয়েছিলেন।

পূর্বে নাসির হোসেনের ছয়টি চলচ্চিত্রে রাহুল দেববর্মণ সুরারোপ করেছিলেন। ওইসব চলচ্চিত্রের গান তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু ‘কায়ামত সে কায়ামত’ (১৯৮৮) এর জন্য নাসির হোসেন ভিন্ন সংগীত পরিচালককে বেছে নিয়েছিলেন। তবে রাহুল দেববর্মণ সম্ভবত জীবনের চরম ধাক্কাটি পান বন্ধু সুভাষ ঘাইয়ের কাছ হতে। ‘রাম লখন’(১৯৮৯)এর জন্য সুভাষ ঘাই প্রথমে রাহুল দেববর্মণকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাঁকে বসিয়ে সুভাষ ঘাই তাঁর নতুন চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন লক্ষ্মীকান্ত প্যায়ারেলাল দ্বয়কে। এই ঘটনার অভিঘাত রাহুল দেববর্মণের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব ছিল। খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। ক’দিন বাদেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ।

রাহুল দেববর্মণের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লতা মঙ্গেশকার দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ওকে কেউ কাজ দিচ্ছিল না। কর্মহীন পঞ্চম যেন জীবন্মৃত অবস্থায় ছিল। খুবই অসুখী ছিল জীবনের শেষ ক’টা দিন। মাঝেমধ্যেই সে তার মনঃকষ্টের কথা বলতো আমায়। এখনও এই কথা ভেবে আমি ব্যথিত হই যে, তার সুরারোপিত কয়েকটি গান ভালো হয় নি বলে কী নির্মম ভাবে ইন্ডাস্ট্রি তাকে পরিত্যাগ করেছিল।’

মীরা আর শচিন দেববর্মণের একমাত্র সন্তান রাহুল দেববর্মণের জন্ম ১৯৩৯’র ২৭ জুন। শৈশবেই তিনি অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সুর করে গাইবার অভ্যাস তাঁর গড়ে উঠেছিল সেই অল্প বয়সেই। একদিন ছোট্ট রাহুল দেববর্মণকে পঞ্চম মাত্রায় গাইতে শুনে অভিভূত হয়েছিলেন অভিনেতা অশোক কুমার । তাঁর ডাক নাম সেদিন থেকে হয় ‘পঞ্চম’। সুরকার হিসেবে বাবার স্নেহচ্ছায়াতেই গড়ে উঠেছিলেন রাহুল দেববর্মণ। পিতা শচিন দেববর্মণের অর্কেস্ট্রা গ্রুপে তিনি হারমোনিকা বাজানোর দায়িত্বে ছিলেন। প্রয়োজনে নতুন সুর বাঁধার কাজে পিতাকে সহায়তা করতেন। স্বাধীন স্বতন্ত্রভাবে প্রথমবার কাজ করেন ‘ছোটে নবাব’ (১৯৬১) চলচ্চিত্রে। ‘চলতি কা নাম গাড়ি’, ‘কাগজ কে ফুল’ , ‘তেরে ঘর কে সামনে’র মতো আরও বহু ছবির বিভিন্ন গানে সুর দেওয়ার কাজে শচিন দেববর্মণকে সাহায্য করেছিলেন। ‘ছোটে নবাব’ ছবিতে সুর দেওয়ার জন্য প্রথমে অনুরোধ করা হয়েছিল শচিন দেববর্মণকে। তিনি অনাগ্রহী ছিলেন বলেই রাহুল দেববর্মণ এই সুযোগ পেয়েছিলেন। ২

তবে সাফল্যের জন্য তাঁকে আরও বছর চারেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৬৫’তে মুক্তি পায় তাঁর সুরারোপিত চলচ্চিত্র ‘তিসরি মঞ্জিল ’। বক্স অফিসে চূড়ান্ত সফল এর ছয়টি গানই প্রভুত জনপ্রিয় হয়েছিল; সেই জনপ্রিয়তা আজও অম্লান। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। রাহুল দেববর্মণ হয়ে উঠেছিলেন উপমহাদেশের অবিসম্বাদিত সুরকার। সংগীতের রাজকুমার। গোটা সত্তর দশক এবং আশির দশকের প্রথমার্ধ অব্দি রাহুল দেববর্মণ দেশের মূল ধারার সংগীতের সুরকার হিসেবে একচ্ছত্র অধিপতির মতো বিরাজ করেছেন।

কিন্তু বলিউড এমনই এক ইন্ডাস্ট্রি যেখানে ন্যূনতম ব্যর্থতারও কোনও স্থান নেই। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাহুল দেববর্মণের সুরারোপিত বেশ কয়েকটি গান কাঙ্খিত মান বজায় রাখতে পারে নি। গানগুলি ছিল পুনরাবৃত্তির দোষে দুষ্ট। নতুন সুর বা চমক এসব গানে ছিল না। ‘ম্যাঁয় আওয়ারা হুঁ’, ‘অর্জুন’, ‘রোমান্স’এর গানগুলি সত্যি ভালো হয় নি। আগেই উল্লেখ করেছি, এরই মধ্যে তবু তাঁর আরও কয়েকটি সুরারোপিত গান যথেষ্ট প্রশংসনীয় ছিল। মন কেড়েছিল শিল্প রসিক তথা সংগীতপ্রেমীদের। সুহৃদ গুলজারের কবিতায় রাহুল দেববর্মণের সুরারোপিত সেই সময়ের সুমুধুর গানগুলি আজও যেন সমানে গুঞ্জরিত হয়। কখনও ভোলা কী সম্ভব লিবাস, ইজাজত, নমকিন, মাসুম অথবা আঙ্গুর’এর গানগুলি ! ভোলা সম্ভব নয় ‘দিল পরদেশি হ্যায়’এর মতো নন-ফিল্মী অ্যালবামের গানগুলির কথাও। এতেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। ডিসকো গানের জনপ্রিয়তায় জোয়ারে সবই যেন ভেসে গিয়েছিল তখন।

প্রয়োজনে বলিউড কী ভীষণ নির্লিপ্ত হতে পারে রাহুল দেববর্মণ তার কিছুটা আঁচ পেয়েছিলেন সেই সত্তর দশকেই। ‘আ গলে লগ যা’ (১৯৭৩) ব্লক বাস্টার হওয়া সত্বেও মনমোহন দেশাই দ্বিতীয়বার রাহুলকে সুযোগ দেন নি। একই ভাবে দীওয়ার (১৯৭৫) ছবির অসাধারণ সাফল্যের পর যশ চোপড়াও সুযোগ দেন নি রাহুলকে দ্বিতীয়বার । তবে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় অবশ্যই। রাহুল আসলে তখন নিজের কাজেই মগ্ন ছিলেন। তৃপ্ত ছিলেন নিজের নির্বাচিত কিছু বন্ধুবান্ধবের পরিসরে। ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ কয়েকবার প্রবঞ্চিত হওয়া সত্বেও নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করেন নি। গড়ে তুলেন নি ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর স্বার্থোদ্ধারে সহায়ক হয় এমন কোনও গোষ্ঠী।

রাহুল একবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের জানিয়েছিলেন, গোটা সত্তর দশক এবং আশির দশকের প্রথমার্ধ অব্দি কাজের চাপ এতোটাই ছিল যে তাঁকে আক্ষরিক অর্থেই দিনরাত মেহনত করতে হতো। বাড়ির সামনে লেগে থাকতো চিত্র পরিচালক আর প্রযোজকদের লম্বা লাইন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে চিত্রটা পুরো পাল্টে যায়। বাড়ির সামনে ভিড়বাট্টা আর ছিল না। খোঁজ খবরও রাখতো না কেউই। নিঃসঙ্গ অবস্থায় কর্মহীন দিনগুলি কাটতো তাঁর। এহেন দুর্গতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিধু বিনোদ চোপড়া বলেছিলেন যে, আত্মবিশ্বাস কমে গিয়েছিল রাহুল দেববর্মণের। তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল কাছের লোকজন সব। আশা ভোঁসলেও পাশে ছিলেন না । রাহুল দেববর্মণ তাই ভাবতে শুরু করেছিলেন তিনি ফুরিয়ে গিয়েছেন। সংগীত জগতে নতুন কিছু দেবার মতো ক্ষমতা তাঁর আর নেই। কিন্তু নিজের সম্পর্কে তাঁর এই ধারণা ছিল ভুল। নিজের প্রতিভা সম্পর্কে লোকজনের অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলেন সংগীতের ওপর।

পরিতাপের বিষয়, এই বিধু বিনোদ চোপড়ার ‘নাইন্টিন ফোরটি টু : আ লভ স্টোরি’ মুক্তির তিন মাস আগে রাহুল দেববর্মণ মাত্র ৫৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন। এই চলচ্চিত্রটির সুরকার ছিলেন রাহুল দেববর্মণ। বক্স অফিসে ‘নাইন্টিন ফোরটি টু : আ লভ স্টোরি’ তুমুল সাফল্য লাভ করে। এই ছবির দৃশ্যায়ন, সিনেমাটোগ্রাফি, গীতিকাব্য এবং মনীষা কৈরালার অভিনয় সর্বত্র প্রশংসিত হয়। কিন্তু শিল্প রসিকদের অশ্রুসজল করে তুলেছিল প্রয়াত সংগীতকারের স্মৃতি। রাহুল দেববর্মণের সুরারোপিত এই ছবির সব ক’টি গানই ছিল মধুময়; হৃদয় স্পর্শ করেছিল আপামর দেশবাসীর। উৎকর্ষতার জন্য বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে এই ছবি লাভ করে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ সংগীতকারের পুরস্কারটি পেয়েছিলেন রাহুল দেববর্মণই। আজ এই চলচ্চিত্রের সব ক’টি গানই কালজয়ী আইকনিক শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে।

‘পরিন্দা’র (১৯৮৯) পর বিধু বিনোদ চোপড়া আরও একটি সংগীতবহুল ছবি বানাতে চেয়েছিলেন। শচিন দেববর্মণের সুরারোপিত ছবি বানানোর খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু শচিন দেববর্মণ তো তখন প্রয়াত। তাঁর অবর্তমানে কাজটি করতে পারেন শুধু একজনই। তিনি রাহুল দেববর্মণ। বিধু বিনোদ চোপড়া তাই রাহুল দেববর্মণের সঙ্গে দেখা করেছিলেন । দৈন্যদশা চলছিল রাহুল দেববর্মণের তখন। বিধু বিনোদ চোপড়া বুঝতে পেরেছিলেন যাঁর সংগীত শুনে বড় হয়েছেন - তিনি এখন তাঁর অতীতের ছায়া মাত্র ! কিন্তু স্বপ্নদ্রষ্টা পরিচালক হাল ছাড়েন নি। তাঁর মনে হয়েছিল রাহুল দেববর্মণ এখনও ফুরিয়ে যান নি। প্রত্যেক শিল্পীর জীবনেই নিস্ফলা পর্ব আসে। কারোর জীবনে তা অচিরেই দূরীভূত হয়; কারোর জীবনে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু জাত শিল্পীর মনের অন্তর্লীন গহীন কোণের কোথাও না কোথাও অক্ষত রয়ে যায় প্রতিভার দ্যুতি। উপযুক্ত সময় সুযোগ পেলে পূর্ণমাত্রায় তা বিচ্ছুরিত হয়। সংগীত পরিচালক রাহুল দেববর্মণের ওপর তাই আস্থা হারান নি তিনি।

কিন্তু ‘কুছ না কহো’ গানটি প্রথমবার যে ভাবে সুর দিয়েছিলেন তা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন বিধু বিনোদ চোপড়া। বলেছিলেন, ‘এমন জঘন্য দায়সারা সুর আপনার মতো সুরকারের কাছে প্রত্যাশা করি না।’ রাহুলের পেছনেই ছিল দেওয়ালে ঝোলানো শচিন দেববর্মণের ছবি। বিধু বিনোদ সে দিকে একবার তাকালেন; ফের বললেন, ‘দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতকার আপনি। আপনার মাধ্যমে আপনি শচিন দেববর্মণ’কে ফিরে পেতে চাইছি !’ আসলে রাহুলের আত্মবিশ্বাস যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল সে কথা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। রাহুলও জানতেন এইচএমভি কর্তৃপক্ষ যদি জানতে পারে বিধু বিনোদ চোপড়া ‘নাইন্টিন ফোরটি টু : আ লভ স্টোরি’র সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দিচ্ছেন তাঁকে - কোম্পানি তবে হয়তো রেকর্ডিং নাও করতে পারে। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনও শিল্পীর পক্ষেই মনঃসংযোগ সহকারে কাজ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। বিধু বিনোদের আশ্বাসে রাহুল যেন কিছুটা মনোবল ফিরে পেয়েছিলেন। অশ্রুসজল চোখে তিনি বিধু বিনোদকে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে। আমাকে একটা সপ্তাহ সময় দিন।’ তারপর বাকি সাত দিন জুড়ে কাজে ডুবে রইলেন তিনি। প্রতিশ্রুতি মতো এক সপ্তাহেই সমাধা করেছিলেন কাজ। পিতা শচিন দেববর্মণের সুরের অনুকরণেই বেঁধেছিলেন ‘নাইন্টিন ফোরটি টু : আ লভ স্টোরি’র সব ক’টি গান। পুরনো ছন্দও যেন ফিরে পেয়েছিলেন তিনি।

এখানে পুনর্বার বলে নেওয়া ভালো যে, শচিন দেববর্মণও তাঁর জীবদ্দশায় পুত্র রাহুল দেববর্মণের সহায়তা পেয়েছিলেন। শচিন দেববর্মণের সুরারোপিত বলে কথিত বহু জনপ্রিয় গানই আসলে পুত্রের তৈরি। রাহুল দেববর্মণ মাত্র নয় বছর বয়সে ‘অ্যায় মেরে টোপি পালাট কে আ’ গানের সুর করেছিলেন এবং শচীন দেববর্মণ ফানটুশ (১৯৫৬) চলচ্চিত্রে সেই গান ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তী কালে ‘প্যায়াসা’র ‘সর জো তেরা চকরায়ে’ কিম্বা ‘আরাধনা’র ‘মেরে সপনো কী রানী কব আয়েগী তু’ এবং ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’র মতো প্রভুত জনপ্রিয় গানগুলির সুরকার ছিলেন রাহুল দেববর্মণই।

আগেই বলেছি, ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা সংগীতের প্রবাদ প্রতীম ব্যক্তিত্ব রাহুল দেববর্মণকে তাঁর সৃজনের বন্ধ্যা সময়ে পরিত্যাগ করেছিলেন। ইন্ডাস্টির অনেকেই তখন ধরেও নিয়েছিলেন রাহুল দেববর্মণ ফুরিয়ে গিয়েছেন। নতুন কিছুই দেবার ক্ষমতা তাঁর আর নেই। কিন্তু এই ধারণা যে কতখানি ভুল ছিল ‘‘নাইন্টিন ফোরটি টু : আ লভ স্টোরি’’র সুরারোপিত অবিস্মরণীয় সব সুমুধুর গানগুলিই তার প্রমাণ।

অবসাদগ্রস্থ দুঃখী রাহুল দেববর্মণ অকস্মাৎই চলে গিয়েছিলেন। এই অকাল বিদায় যেন উজ্জ্বলতর পঞ্চম পর্বের এক অনাকাঙ্খিত বিষাদ ক্লিষ্ট উপসংহার। ‘‘নাইন্টিন ফোরটি টু : আ লভ স্টোরি’র সংগীতের ভুবনজয়ী সাফল্য তিনি দেখে যেতে পারেন নি; কিন্তু জনগণের হৃদয়ে অবিনশ্বর হয়ে রইলেন সংগীতের রাজকুমার।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.