সেনাবাহিনীতে ঠিকা নিয়োগ কেন?

পুরুষোত্তম রায় বর্মন

সেনাবাহিনীতেও ঠিকা নিয়োগ, চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ, চার বছর মেয়াদে নিয়োগ। এসবের পোশাকি নাম অগ্নিপথ। মোদি সরকার অগ্নিপথ প্রকল্প রূপায়ণে বদ্ধ পরিকর। এর বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের জুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল প্রতিবাদ । সারা দেশে বেকার সমস্যা প্রচন্ড তীব্র। বছরে 2 কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। অন্য সব প্রতিশ্রুতির মত সেই প্রতিশ্রুতি এখন বিশবাঁও জলে নিচে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগ প্রত্যাশী লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতী অগ্নিপথের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়েছেন, অগ্নিপথ প্রকল্পে ১৭ থেকে ২১ বছরের তরুণ তরুণীরা চার বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক সেনায় যোগ দিতে পারবেন। তাদের বলা হবে 'অগ্নিবীর'। সেনায় শূন্যপদ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চতুর্থ বছরের শেষে সর্বাধিক ২৫ শতাংশ অগ্নিবীরকে সেনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে । বাকিরা বেকারের খাতায় নাম তুলবেন নতুন করে। চাকুরীতে স্থায়িত্বের কারণে গরীব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণরা মূলত সেনার চাকুরীকে বেছে নেন। সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হতে দীর্ঘ কঠোর অনুশীলন ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় । দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পরিশ্রমের পর সেনায় চাকরি পাওয়ার পর যদি চার বছরের মাথায় অবসর নিতে হয় তাহলে অনিশ্চয়তার সাগরে পড়তে হবে। তাই শুরু হয়েছে বিক্ষোভ আন্দোলন সারা দেশজুড়ে। উত্তর থেকে দক্ষিনে। হতাশায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যু হয়েছে। ইতিমধ্যে মেল ও এক্সপ্রেস মিলিয়ে ৯৪ টি ট্রেন ও ১৪০ টি প্যাসেঞ্জার ট্রেন বাতিল হয়েছে। হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। এই পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী কেন্দ্রীয় সরকার। অগ্নিপথ একটি হটকারী প্রকল্প। সেনাবাহিনীকে নিয়ে খেলছে কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ ও সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে ঠিকা শ্রমিক দিয়ে সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ হয় না বরং সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা , দক্ষতা, উৎকর্ষ, ঐতিহ্য সবকিছু চূড়ান্ত ভাবে বিপন্ন হয়। সরকার নয়া উদারনীতি প্রয়োগ করছেন সেনাবাহিনীতে। পেনশন ও অন্যান্য দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন। তার জন্যই ঠিকা নিয়োগ। অগ্নিপথ প্রকল্প ঘোষণার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পরোক্ষে স্বীকার করে নিল, ভারতীয় অর্থনীতি ভারতের পক্ষে উপযুক্ত সেনাবাহিনী ধারণ করতে অসমর্থ। তাই ঠিকা নিয়োগ। কিন্তু এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে বলে মনে করছেন প্রাক্তন সামরিক কর্তারা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য , অগ্নিবীরেরা চার বছরের সময়ে ছুটি বাদ দিয়ে খুব বেশি হলে তিন বছর কাজ করার সুযোগ পাবেন। যার মধ্যে প্রশিক্ষণ হবে ৬ মাস। এত অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ ও কাজ করার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কি করে পাকিস্তান এবং চীন সীমান্তে কঠিন দায়িত্ব পালন করবেন। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা, মানসিকতা, উৎকর্ষ এত অল্প সময়ে রপ্ত করা যায় না। যাদের চাকরির মেয়াদ ৪ বছর তারা কি জেনেশুনে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে পারবেন। কোষাগারের অর্থ বাঁচানোর নামে সেনাবাহিনীকে নিয়ে এধরনের ছেলেখেলা অত্যন্ত বিপদজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। কোনরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই এ ধরনের প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে এবং কার্যকর করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও এতদিনকার প্রথা ভাঙ্গা হচ্ছে। ১৭৪৮ কে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শুরু বলে চিহ্নিত করা হয়। সেনা নিয়োগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈচিত্র ও বিশিষ্টতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এ কারণেই অঞ্চলভিত্তিক সেনা নিয়োগ করা হয়েছে। এই নিয়োগ পদ্ধতি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে শুধুমাত্র পেশাগত দক্ষতা দিয়েছে তা নয় সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করেছে। পাকিস্তানের মতো ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কোন একটি প্রদেশের আধিপত্য নেই। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবের আধিপত্য। অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কোন একটি রাজ্য , কোন ভাষাগত গোষ্ঠী অথবা কোন সম্প্রদায়ের বিশেষ আধিপত্য নেই। ভারতীয় জনসমাজের সমস্ত অংশের সুষম প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। এত দিন অব্দি ভারতীয় সেনাবাহিনী সৈনিকদের দিয়েছে বেতন, উর্দি , সম্মান , অবসরকালীন পেনশন, পুরস্কার, আত্মমর্যাদা , স্বীকৃতি। এ কারণেই ভারতীয় সেনাবাহিনী আকর্ষণ করেছে নিয়োগ প্রত্যাশীদের। কিন্তু মোদি সরকার সর্বভারতীয় নিয়োগের নামে কয়েক শত বছরের নিয়োগ পদ্ধতি বাতিল করতে চলেছে। এর ফলে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হবে। ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতাসীন হয়ে সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে চাইছে। দুর্বল করতে চাইছে। ফ্যাসিস্টদের কুনজরে সেনাবাহিনী। আরেকটা গুরুতর প্রশ্ন, চার বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করার পর যারা বেকার হবেন সেনার প্রশিক্ষণ নিয়ে, অস্ত্র চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে, বেকার জীবনে তাদেরকে দিয়ে লুম্পেন বাহিনী বা প্রাইভেট আর্মি গঠন করা হবে না তো ? যেখানে ৪৫ কোটি ভারতীয় কর্মহীন এবং চাকরির প্রত্যাশা ছেড়ে দিয়েছে , সেখানে চার বছর কাজ করার পর বেকার হওয়া প্রাক্তন সেনা কর্মীদের ব্যবহার করবে ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলো । সামাজিক হিংসা ছড়ানোর কাজে। অবিলম্বে অগ্নিপথ প্রকল্প বাতিল করতে হবে। সেনা নিয়োগের ক্ষেত্রে হঠকারী পদ্ধতি অবলম্বন করা চলবে না। ফ্যাসিস্টরা মুখে উগ্র জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলে কিন্তু কার্যত তারা জাতি ও দেশের চরম শত্রু। অগ্নিপথ প্রকল্প তার জ্বলন্ত প্রমাণ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.