উত্তরপূর্ব ভারতের প্রেক্ষাপটে বলিউড ছবি ‘অনেক’
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
এই সময়ে ভারতের বিভিন্ন বিনোদনমূলক গণ মাধ্যমগুলির মুখ্য বিষয় যেন উত্তরপূর্ব। ফ্লেভার অব দ্য সীজন। মেইনস্ট্রিম প্রিন্ট মিডিয়াতে এখন অলিম্পিক্সে পদক জয়ী উত্তরপূর্ব ভারতের মেয়েদের নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হচ্ছে। উত্তরপূর্বের সাহিত্যিকের ওপর কভার স্টোরিও হয়ে গিয়েছে। অঞ্চলের চিরায়ত রাজনৈতিক ভাঁড়ামোর কথা তো গত কয়েক বছর ধরেই চর্চিত হচ্ছে । তবে সব কিছু ছাপিয়ে আজও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উত্তরপূর্ব ভারতের ওই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনই। মূল ভূখণ্ডে বাসরত ভারতীয়দের কাছে উত্তরপূর্ব আজও যেন প্রহেলিকাময় এক জটিল ধাঁধা। এবম্বিধ অনুভূতির ফলে ওদের মনে উদ্যাপিত হয় দুই পরস্পর বিরোধী অনুভূতি। মূল ভুখন্ডে বাসরত কিছু ভারতীয় মনে করে উত্তরপূর্ব ভারত মানেই জংলী আর অসভ্য উপজাতিদের দেশ; আবার এর বিপ্রতীপে কিছু ভারতীয় এই অঞ্চল এবং স্থানীয় মানুষদের আদ্যন্ত স্বপ্নিল রোমান্সের মোড়কে দেখতে ভালবাসে। বলাবাহুল্য, এই দুই রকমের অনুভুতিই কিন্তু পূর্ব সঞ্জাত ধ্যানধারণার গড়ে তোলার জন্য দায়ী। আর কোন অঞ্চল এবং সেখানকার মানুষকে বিচার করতে গেলে - সে নেতিবাচকই হোক আর ইতিবাচক - এমন পূর্ব সঞ্জাত ধ্যানধারণাই কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিকে সর্বাগ্রে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অযৌক্তিকতার মধ্যে তখন সম্বাদের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং ধোঁয়াশা শেষ পর্যন্ত ধোঁয়াশাই থেকে যায়। উত্তরপূর্ব ভারতের পটভূমিকায় পরিচালক অনুভব সিনহার সাম্প্রতিক ফিল্ম "অনেক" দেখে উপরোক্ত কথাগুলিই ফের মনে পড়ল। উত্তরপূর্ব সম্পর্কে চলতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে এই ফিল্ম জনমানসে একটা ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে ঠিকই। কিন্তু এমন বার্তা পৌঁছে দিতে গিয়েও ওই ন্যারেটিভ'এর বাহক হয়ে উঠে মূল ভূখণ্ড থেকে আসা আন্ডার কভার ইন্টিলিজেন্স অফিসার আয়ুষ্মান খুরানা। তাঁর মাধ্যমেই বর্ণিত হয় কাহিনী। হলিউডে এমন ছবি প্রচুর হয়েছে। রেড ইন্ডিয়ান অথবা কৃষ্ণাঙ্গরা আদতে কত ভালো সর্ব সাধারণ্যে সেটা বোঝাতে গিয়ে শ্বেতাঙ্গ নায়কই যেন মসিহ'র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই আখ্যানে উত্তরপূর্ব এবং অঞ্চলের মানুষেরা হয়ে উঠে পার্শ্ব চরিত্র। উত্তরপূর্ব ভারতের কাহিনী হলেও তা দেখতে এবং শুনতে হয় মূল ভূখণ্ড থেকে আগত মুখ্য চরিত্রের মাধ্যমে। আমার আপত্তি এখানেই। উত্তরপূর্ব ভারতের কাহিনী স্থানীয় চরিত্রের মাধ্যমেই বিবৃত হোক না; কেন ভিন্ন অঞ্চলের চরিত্রের মাধ্যমে তা ব্যাখ্যাত হবে ! কেনই বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কারণ এবং উৎস বিশ্লেষিত হবে না ! এই অঞ্চলের মানুষ কেন 'অ্যালিয়েনেটেড' - উল্লিখিত হবে না সেই বিষাদমঞ্জরীও ! 'অনেক' সিনেমার কাহিনী উত্তরপূর্বের এই চিরায়ত সমস্যাগুলি জাস্ট ছুঁয়ে গেছে মাত্র। গভীরে যাওয়ার প্রয়াস লক্ষিত হয় নি এতে। সিনেমার টেকনিক্যাল কাজ প্রশংসনীয়। ভালো লেগেছে ক্যামেরার কাজ। তবে এতো সংলাপ বহুল কেন ! যে কোনও সিনেমায় সংলাপের আধিক্য পীড়াদায়ক। 'অনেক' সিনেমায় আয়ুষ্মান খুরানাকে দিয়ে প্রচুর সংলাপ বলিয়েছেন পরিচালক। এর দরকার ছিল কী ! উপন্যাসে এমন সব দীর্ঘ সংলাপ চলতে পারে। কিন্তু সিনেমার মতো দৃশ্য-মাধ্যমে সংলাপের আধিক্য বাঞ্ছিত নয়। বিনা সংলাপে সিনেমায় কী ভাবে কাঙ্খিত বিষয় দর্শক-শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব - সেটি নির্ভর করে পরিচালকের শ্রম আর মেধার ওপর। অনুভব সিনহার মেধা আছে অবশ্যই। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে আর পরিশ্রম করতে চান নি বলেই মনে হল। এ ছাড়া এ ধরনের সংলাপ বহুল চরিত্রে আয়ুষ্মান খুরানা যথাযথ অভিনয় করলেও - রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ এবং আমীরের মতো পৌনে তিন ঘন্টা নাগাড়ে দর্শক শ্রোতাকে তন্ময় এবং মোহাবিষ্ট করে রাখার 'ক্যারিশ্মা' তিনি এখনও অর্জন করতে পারেন নি। দীর্ঘ সংলাপের কারণেই 'অনেক'এর গতি মাঝেমধ্যে শ্লথ হয়ে পড়ে ! তবে অ্যাকশন দৃশ্যগুলির প্রশংসা করতেই হয়। বুদ্ধির ছাপ রয়েছে ওইসব দৃশ্যে। এ ছাড়া একটি বালক সন্ত্রাসবাদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই সিনেমায়। আমি জানি না শ্রী লঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিলদের মতো উত্তরপূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি কখনও বালকদের ব্যবহার করেছে কিনা। অসম্ভব ভালো অভিনয় করেছেন মনোজ পাহয়া। ভালো লেগেছে উত্তরপূর্ব ভারতের অভিনেতাদের সুদক্ষ অভিনয়। নাগা অভিনেত্রী আন্দ্রেয়া কেভিচুসা দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছেন। আশা করি, বলিউডে তিনি কালক্রমে উত্তরপূর্ব ভারতের একামেবাদ্বিতীয়ম প্রতিনিধি হয়ে উঠবেন। সব মিলিয়ে 'অনেক' সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র। রেটিং'য়ের বিচারে আমি পাঁচের মধ্যে সাড়ে তিন দিলাম। ছবির সামগ্রিক গুণমানের জন্য হল আড়াই নম্বর । বাকি এক নম্বর দিলাম উত্তরপূর্ব ভারত নিয়ে মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবি বানানোর সাহস দেখানোর জন্য !