“মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের সত্তার সঙ্গে মিশে আছেন ।”

সৌম্যদীপ দেব

April 25, 2025

১/ সৌম্য: জীবনের সূচনা মেলাঘর দিয়ে। আমরা জানি মেলাঘর নানানভাবেই আলোচিত অঞ্চল। সেকালের ও একালের মেলাঘরের মধ্যে হৃদয়বৃত্তির কোনো তফাৎ খুঁজে পান? আজকের মেলাঘরের জনজীবনে নাগরিক জীবনের ছোঁয়া কতটা?

অনুপম : মেলাঘরে আমার বেড়ে ওঠা। মেলাঘর নামটির সঙ্গে আমার অনেক আবেগ ও স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। ছাত্রজীবনের শুরুর শুরুটা ওখানেই। সে-ই ছিল এক আনন্দঘন দিন, ক্লাসের ফাঁকে স্কুলের মাঠে, গ্রাম্য খেলা গোল্লাছুট, ডাংগুটি, দাড়িবান্দা, খো-খো, কোবাডি আরও কতকি! এখন তো ছেলেমেয়েরা এগুলি জানেও না, জানার কথাও নয়। তাদের সময় কোথায়!

সঙ্গে মনে পড়ছে সেই রথের মেলার কথা, তাকিয়ে থাকতাম কবে আসবে দিনটি। মনে পড়ছে নীরমহলের কথা। আরও মনে পড়ছে সেই সান্ধ্যকালীন খেজুরের সদ্য নামানো রস আস্বাদনের কথা! এখনও মনে হয় মেলাঘরবাসীর সেই হৃদয়ের টান, আতিথেয়তা আজও অটুট ও অপরিবর্তিত আছে, থাকবেও। যদিও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তো হবেই।

২/ সৌম্য : ২০০৪ সালে ধর্মনগর গভর্মেন্ট ডিগ্রি কলেজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে বর্তমানে একটি কলেজের প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব। অধ্যাপক হিসাবে ক্লাসে আসা আর অধ্যক্ষ হিসাবে ক্লাসকে দেখা — দুই ভিন্ন সমীকরণ। কী বলবেন?

অনুপম : একদম মনের কথাটুকু জিজ্ঞেস করলেন। অধ্যাপক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে চর্চা করা, হতেই পারে তা ক্লাসের নির্দিষ্ট গন্ডিতে বা ক্লাসের বাইরে, ছেলে-মেয়েদের আগ্রহ দেখেই বুঝে নিতাম ক্লাসে ঠিক কতটা বোঝাতে পেরেছি। আগামী ক্লাসে কী শুরু করব।

প্রশাসনিক দায়িত্ব একদম আলাদা, ক্লাস ঠিকঠাক হচ্ছে কি-না, ছেলেমেয়েদের কিছু অসুবিধা হচ্ছে কী-না, কীভাবে কী করলে ওদের সুবিধা হবে, অফিসে কাজ সব আপডেট হচ্ছে তো। বিভিন্ন প্রশাসনিক মিটিং এটেন্ড করতে হচ্ছে সে হোক সাব্রুমের বা শিক্ষা দপ্তরের, অফলাইন বা অনলাইন। তবে কলেজের আমার সহকর্মী ও অফিস স্টাফ সকলেই ভীষণভাবে সহযোগিতা করে। দুটি পোষ্টেরই ভিন্ন কাজ ও দায়িত্ব।

৩/ সৌম্য : গবেষণা করেছেন ‘Cytology Cytochemistry & Tissue Culture of two dioecious members of Cucurbitaceae’ বিষয়ের উপর। প্রফেসর ড. সংগ্রাম সিনহার তত্ত্বাবধানে। — কেনো উদ্ভিদবিদ্যার দুটো ভিন্ন প্রজাতিকে নিয়ে গবেষণা করবেন ভেবেছিলেন?

অনুপম : না, এমন কোন ভাবনা ছিল না বা সেসব বিষয়ে অভ্যস্তও ছিলাম না। কিন্তু একটা বিষয় ভীষণ ভাল লাগত, সেটা হচ্ছে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। খুব উপভোগ করতাম। প্র্যাকটিক্যালে ভাল হাত ছিল বলেই স্যারদের নজরে আসা। থিওরি থেকেও প্র্যাকটিক্যালের জন্য অনেক বেশি সময় ব্যয় করতাম।

৪/ সৌম্য : যতদূর জানি, ব্যক্তি অনুপম ‘সততা’, ‘পরিশ্রম’ ও ‘একাগ্রতা’য় বরাবর প্রবল বিশ্বাসী। তাহলে এই তিনটি শব্দবন্ধই কী কর্মজীবনেরও মূলমন্ত্র?

অনুপম : একদম, এখনও মেনে চলি। কাজ করতে পছন্দ করি এবং এডভান্স হয়ে থাকতে চাই। সততা, পরিশ্রম ও একাগ্রতা — এই তিনটি শব্দ প্রত্যেকের জীবনের বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বা ছাত্রছাত্রীদের চলার পথের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত।

৫/ সৌম্য : শিশুর মেধা এখন শিক্ষাবিজ্ঞানে বহুল চর্চিত বিষয়। কোনো সমালোচক বলেন মেধাবী শিক্ষার্থী সব দিকেই মেধাবী। আবার দেখা যায় পড়াশোনায় ততটা না হলেও কেউ কেউ সহপাঠ্যক্রমিক কাজে অত্যন্ত পারদর্শী। আসলে মেধার বিচার কী আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অতিমাত্রায় পাঠ্যক্রম নির্ভর নয়?

অনুপম : তা সবসময় ঠিক নয়, অনেকের মেধা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিচর্যার অভাবে নিজেকে তুলে ধরতে অক্ষম। আবার অনেকে সহজাত ভাবেই নিজেকে তুলে ধরছে। প্রত্যেকের জীবনেই কিছু না কিছু পজেটিভ দিক থাকে, সেখানে ফোকাস হলেই সে উঠে দাঁড়াবে। লক্ষ করলেই দেখা যায় বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম নির্ভর শিক্ষা হলেও একটা সময়ের পর তার মেধা, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার আঙ্গিনায় এসে তার চিন্তার বিকাশ ঘটে এবং সমাজে তা প্রতিফলিত হয়। তবে কম বয়সে অতিরিক্ত চাপ না নেওয়াই ভাল। লক্ষ্য অবশ্যই সুদূরপ্রসারী রাখতে হবে।

৬/ সৌম্য : আপনার প্রচুর শিক্ষার্থী নানান জায়গায় ছড়িয়ে আছে। তাদের জড়িয়ে থাকা কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতা আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি বলেন।

অনুপম : ঠিক তাই। অনেক ঘটনাই মনে উঁকি দিচ্ছে। একটি ঘটনা বলতেই হয়, ২০১৭ সাল তখন আমি আগরতলার মহিলা মহাবিদ্যালয়ে কর্মরত, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানও বটে, UGC-NERO অর্থানুকুল্যে দুদিন ব্যাপী জাতীয় আলোচনাচক্র, বিষয়বস্তু ছিল — Recent Trends in Biodiversity Conservation and Bio-resource Utilization। প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু। আলোচনার দু'দিন ছিল ভীষণ ব্যস্ততা, কারণ আমিই ছিলাম আলোচনা চক্রের আহ্বায়ক। তখন মহাবিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ছাত্রীরা ছিল অতন্দ্র প্রহরী, ওদের সাহচর্য ও সহমর্মিতায় আমি যেন উদ্ভাসিত ছিলাম। অনেকের নামই মনে পড়ছে, এরা সকলেই এখন প্রতিষ্ঠিত।

৭/ সৌম্য : জীবনে যদি এমন দুটো জিনিস চাইতে বলা হয়। যা একেবারেই বিরলতম। কী চাইবেন?

অনুপম : জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের পাশে পেতে চাই, ওদের মায়াতে আবদ্ধ থাকতে চাই। দ্বিতীয়ত, অবসরকালে বিজ্ঞানচর্চা বিষয়ে ধারাবাহিক বিভিন্ন লেখালেখি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাই। কাজের মধ্যেই এই জীবনের একমাত্র সুখ।

৮/ সৌম্য : মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজে মধুসূদন স্মরণ ও চর্চার কোনো বিশেষ ব্যবস্থা বা উদ্যোগ কিছু কী আছে? একটু যদি বলেন।

অনুপম : খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করলেন। বাঙালি কোনোদিন তাঁকে ভুলতে পারবে না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের সত্তার সঙ্গে মিশে আছেন । প্রতি বছর ২৫শে জানুয়ারি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন উদযাপন করা হয়। এবছরও কবির জন্মদ্বিশতবর্ষ সারাদিন ব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে পালন করা হয়েছে, যেমন — কবির আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, কবির জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা, ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ, NSS-এর উদ্যোগে সাফাই অভিযান, বৃক্ষরোপন কর্মসূচী, সবশেষে প্রীতি ভলিবল ম্যাচ ইত্যাদি। আগামী দিনে আরও বৃহত্তর পরিকল্পনা রয়েছে।

৯/ সৌম্য : উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে উচ্চশিক্ষার পর শিক্ষার্থীর নতুন নতুন কর্মসংস্থান কী কী রয়েছে পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলুন।

অনুপম : আমাদের সময়কার কথা যদি বলি, তবে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে অর্নাস, এম এস সি, অন্তত ৫৫% মার্কস পেয়ে CSIR-UGC NET কোয়ালিফাই করা, CSIR NET পেলে স্কলারশিপ নিয়ে CSIR- এর কোন ভাল ল্যাবে গবেষণা করা, post doctoral করতে বিদেশ যাওয়া বা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনায় যোগ দেওয়া। বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণিতে উর্ত্তিনরা Common University Entrance Test (CUET) এ বসে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টিগ্রেটেড মাষ্টার ডিগ্রি বা আন্ডার গ্রেজুয়েট কোর্সে ভর্তি হতে পারে ও পরবর্তী সময়ে গবেষণার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া, উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে গ্রেজুয়েসন করার পর Microbiology, Bioinformatics, Molecular Biology নিয়েও মাষ্টার ডিগ্রি করতে পারে, বহু সুযোগ আছে, অবশ্যই আগ্রহ থাকতে হবে। Higher Studies-এ ইচ্ছে না থাকলে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসা যায়। তবে সময় নষ্ট করা চলবে না। লেগে থাকতে হবে। ইচ্ছা থাকলে উপায় বেরোবেই।

১০/ সৌম্য : Challenging education, Quality education এর মতো শব্দগুলো যখন প্রবলভাবে আমাদের মন ও মস্তিষ্কের দখল নিচ্ছে তখন কী মনে হয় ‘শ্রেণিকক্ষে যত না দায়িত্ব একজন শিক্ষকের, ততোধিক দায়িত্ব শ্রেণিকক্ষের বাইরে’ — কথাটি কতটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন?

অনুপম : কঠিন প্রশ্ন। আমার ভাবনায় শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষকদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নয়, শ্রেণিকক্ষে শুধুমাত্র সিলেবাস নিয়ে আলোচনা, ছেলে-মেয়েদের সঠিক মনোগ্রাহী, স্বাবলীল

পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট বিষয়ে বোঝানো, সময়ের মধ্যে কীভাবে উওর দেবে তা দেখানো, অনুপ্রাণিত করা ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে তো শ্রেণিকক্ষের বাইরে দায়িত্ব আরও অনেক বেশি, ক্লাসের ফাঁকে, এমনকি অতিরিক্ত সময়েও বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি যেমন — HIV/AIDS প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ রোধ, ড্রাগসের কুফল, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ দায়িত্ব তো বাড়ছে বটেই।

এডুকেশন সিস্টেম অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং, বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে কী নেই আমাদের হাতে, গুগল যে সমস্ত অজানা তথ্য নিয়ে হাজির, শুধুমাত্র সঠিক উপাদানটুকু খুঁজে নেওয়া, ব্যাস।

Quality education ভীষণ প্রয়োজন। এখন যে New Education Policy-2020 (NEP-2020) দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা চলছে। সুযোগ অনেক, কাজে লাগাতে হবে। সঠিক তথ্য জেনে তা নিয়ে এগোতে হবে।

আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.