।। আমগাছের দলবদল ও বৈরাগ্য ।।

অরিন্দম নাথ

(১)

ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় একটি কবিতার সূত্রে । আধুনিক কবিতা । স্বপ্ন গারদে আবদ্ধ একটি কিশোরকে নিয়ে । কবিতাটি পড়ে, আমি বিষ্মিত হলাম । কবি পরিচিত । তিনি বুঝিয়ে বললেন । সেই থেকে ছেলেটির সঙ্গে ভাব । বন্ধুত্ব । ভীষণই চটপটে । যেন এক পশলা বৃষ্টি । একঝলক মুক্ত হাওয়া । ওর পরশ খুবই রিফ্রেশিং লাগে । চেষ্টা করি, ওর ভালো করার । হীরকদ‍্যূতি এখনও ফুটিয়ে তুলতে পারিনি । মনে বিশ্বাস, সেই প্রভা আসবে ।

(২)

গতবছর এমনই দিনের কথা । আমি অসুস্থ । এই খবর শুনে সে দেখা করতে এলো । সঙ্গে করে নিয়ে এলো কিছু আম । নিজেদের বাড়ির গাছের । সবমিলিয়ে তিনটে আমগাছ । রাজ‍্যের এক প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে তার বাড়ি । সীমান্ত লাগোয়া । কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাজনৈতিক হানাহানি লেগে থাকতো । সঙ্গে পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য । জনপদটি মাঝেমধ্যে পত্রিকার শিরোনামে আসে ।



আমগুলি ভীষণই ভালো । হলদে রঙ । দেশী হলেও পোকা নেই । একেকটির ওজন দুশো গ্রাম হবে । আমরা এমনি কেটে খেলাম । পাশাপাশি দুধ দিয়েও খেলাম । পরদিন তাকে ফোনে জানালাম । আমের গরবে সেও গর্ব বোধ করলো । বললো, 'স‍্যার, আগে আমগুলি এমন ছিল না । বছর দুয়েক হলো পরিবর্তন এসেছে । সাইজে ছোট হয়ে গেছে । হলুদ রঙ । আগে সবুজ থাকতো । তবে স্বাদ অপরিবর্তিত । পাশের বাড়িতে একটি বড় আমগাছ আছে । আমগুলি হলুদ । আমাদের গাছে এখন যেমন আম ধরে হুবহু তেমনি । হয়তো জেনেটিক‍্যালি কিছু হয়েছে ।'

(৩)

তার জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক কোনও উত্তর জানা ছিল না । এই বিষয়ে জ্ঞান আছে, এমনি একজনের শরণাপন্ন হলাম । সবকিছু শুনে তিনি বললেন, 'ও, এই ব‍্যাপার! ক্রস পলিনেশন হয়েছে ।'



বুঝলাম কৃত্রিম পরাগ সংযোগ । বা এমনি কিছু । এবার ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হলাম । কিছুটা বোধগম্য হলো । যা গল্পের তাগিদে যথেষ্ট । আম একলিঙ্গ (monoecious) গাছ । একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটে । গড়ে পচাত্তর শতাংশ স্ত্রী ফুল । বাকি পুরুষ ফুল । তারপর ভ্রমর আর বাতাসের কারসাজি । পরাগ সংযোগ ঘটায় । বন্ধুর বাড়ির গাছের ক্ষেত্রে একটু ব‍্যতিক্রম ঘটেছে । দুবছর যাবৎ পাশের বাড়ির গাছের পুরুষ ফুলের রেণুর সংস্পর্শে পরাগায়ন ঘটছে । হয়তো কোনও কারণে গাছটির পুরুষ ফুল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । অথবা ডাল কাটা পড়েছিল । গাছও হয়তো দুবছর যাবত তার পুরুষ সত্তা ডরমেন্ট রেখেছিল । কিংবা ডিভোর্স হয়েছে ।

(৪)

আরেকটি কথা । আমগাছটি মনে হয় রাজনীতি পছন্দ করে । গাছটি যেখানে জন্মেছে সেখানে গত কয়েক বছরে প্রচুর দলবদল হয়েছে । এখন কিছুটা স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে । গাছটি এইসব দেখেই উৎসাহিত হয়েছে । দলবদল ঘটিয়েছে । পাশের বাড়ির বড় গাছটির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে । ঘটনাক্রমে এই গাছের আমও ভালো । ভয়, যদি অজ্ঞাতকুলশীল কাউকে পছন্দ করে বসে ! তখনতো মাকাল ফল কিংবা ফ্র‍্যাঙ্কেনস্টাইনের জন্ম হবে ।

(৫)

দিন দু'য়েক আগে বন্ধুটির ফোন এসেছে । এ'বছর গাছে আম আসেনি । ইতিমধ্যে সে চাকুরিতে ঊন্নতি করেছে । তবে মাতৃহারা হয়েছে । বিদূষী মহিলা । আমি মনে মনে তাঁর একটি নাম দিয়েছিলাম । সিলেটের কল‍্যাণী কাজী । আমার মত তাঁর পূর্বসূরিদের জন্ম সিলেটে । তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন । গাছগুলি ওনার হাতের লাগানো । ইনফ‍্যাক্ট তাদের বাড়ির অধিকাংশ গাছ তিনি লাগিয়েছেন । অনেকগুলো গাছ মরে গেছে । অযত্নে নয় । শোকের থেকে ।

(৬)

আমির খানের 'তারে জামিন পর' ছবিতে একটি দৃশ্য আছে । ডেস্লেস্কিক (dyslexic) বাচ্চাটির বাবা ছেলেটিকে ভীষণ গালাগালি করতেন । তার আর্টের শিক্ষক ভদ্রলোককে সলমন দ্বীপের একটি গল্প শুনান । কোনও গাছের উপর কোপিত হলে সেখানকার আদিবাসীরা গাছটিকে মারে না । গাছটিকে ঘিরে গালাগালি করে । কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গাছটি মারা যায় । এই নিয়ে গবেষণা করে ব্রুস এইচ লিপ্টন নামে এক আমেরিকান গবেষক 'THE BIOLOGY OF BELIEF' নামে একটি বই লিখেছেন । তিনি মানুষের চেতন এবং অবচেতন মনের ক্ষমতার কথা বলেছেন । তাঁর কথায় চেতন মন থেকে অবচেতন মন শক্তিশালী । অবচেতন মনে আমাদের যে ইচ্ছে জাগে সেই অনুযায়ীই জীবন চালিত হয় । আমাদের অভ‍্যাস অবচেতন মন ঠিক করে দেয় । বাহ‍্যিক আচরণ আসলে অবচেতন মনের প্রতিবিম্ব । গাছেরও মন আছে । বিবেক আছে । তাই গাছ যখন বাঁচতে চায় না মারা যায় । গৌতম বুদ্দ এই সত্যিই আড়াই হাজার বছর আগে উপলব্ধি করেছিলেন । আমার বন্ধুর বাড়ির গাছগুলির মনে বৈরাগ্য এসেছে । কল‍্যাণী কাজীর অবর্তমানে তারা বাঁচার অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না । নতুন বীজ কিংবা সন্তানের কথাও ভাবে না । তাই হয়তো এই সন্ন‍্যাস । (৭)

তোমার মন যেমন তুমি মানুষটিও তেমনই । বাচ্চাদের বকাবকি করলে অবচেতন মনে রয়ে যায় । তার জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় । শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে । শাসন করার পাশাপাশি আদরও করতে হয় । যে যত এর ভারসাম্য খুঁজে পায় সে তত স্বার্থক পিতা কিংবা মাতা । এক বয়স্ক হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ভারি মজা করতেন । কিছু কিছু রোগী থাকে বাতিকগ্রস্থ । বার বার ডাক্তার এবং ঔষধ পাল্টাতে চায় । ঔষধ নেবার দুই তিনদিনের মাথায় রোগী গিয়ে অভিযোগ করত ঔষধে কোনও কাজ হচ্ছে না । পাল্টে দিতে কিংবা মাত্রা বাড়িয়ে দিতে । তিনি মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন । অ্যাটেন্ডেন্টকে বলতেন ফান্টুস দিতে । ফান্টুস তাঁরই দেওয়া নাম । হোমিওপ্যাথির সুগার গ্লোবিউলের উপর ডিস্টিল ওয়াটার । রোগী সুস্থ হয়ে জানিয়ে যেত । তিনিও ফান্টুসের জন্য অতিরিক্ত টাকা নিতেন না । এক তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে মানুষ সুস্থ হয় পজিটিভ চিন্তা থেকে ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.