নস্টালজিয়া

দেবারতী দত্ত

গ্রামটির নাম ভারি সুন্দর, ইচ্ছাপুর। প্রথম যখন জানতে পারলাম গ্রামটির কথা, তখন তার নামকরণ নিয়ে আমার মনে এক দারুন কৌতুহল চাড়া দিল। 'ইচ্ছাপুর' মানে ইচ্ছারা যেখানে বাঁধনহীন ভাবে ছুটে চলে, লোকেদের অন্তরালে। মনের ভেতরে কেউ অজান্তেই বলে উঠল 'যাবি ইচ্ছেদের সাথে পাড়ি দিতে?' মায়ের মুখে শুনেছি আমার দাদুর বাড়িও নাকি ওই গ্রামে তেই আছে। দাদু দিদারা কেউই এখন বেঁচে নেই। কিন্তু মামারা এখনও রয়েছে ওই গ্রামেতেই। তাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে রয়েছে চাকরিসূত্রে। তাদের সাথে যোগাযোগ ঐ মুঠোফোনের মাধ্যমেই চলে। বড় হওয়ার পর সবার সাথে দেখা হয়নি আমার। যখন খুব ছোট ছিলাম, কয়েকবারই দাদুর বাড়ি ঘুরতে গেছি, মায়ের সাথে। এখন এতগুলো বছর পর, সব স্মৃতি গুলো কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

ব্যালকনিতে বসে বসে ভাবছিলাম, সেই ছোট্টবেলার পুকুরপাড়, বড় দালান বাড়ি, আমবাগান। কিন্তু আজ সবই শুধু গল্প হয়ে রয়ে গেছে। হঠাৎ বৃষ্টির দমকা হাওয়ায় আমার ভাবনার পাতাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। অনেক কিছু মনে করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু চিন্তাটাকে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম না। গ্রামের নামটা যে ইচ্ছাপুর ছিল, তাও মনে নেই আমার। অনেক ছোটবেলায় যাওয়া তো, তাই মনে না থাকারই কথা। তাই মায়ের মুখে গ্রামটির নাম শুনে, কেমন জানি মনে হচ্ছে কোথাও কোনো পুরোনো সংযোগ রয়েছে। মায়েরও তেমন করে দাদুর বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। তার প্রধান কারণ বাবার কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি। যার জন্য আমাদেরকেও বাবার সাথে সাথেই বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো। কখনো দু'বছর, কখনো পাঁচ বছর, এমন করেই ছোট থেকে আমার বড় হওয়া। আমার পড়াশোনার জন্য মায়ের কোথাও যাওয়া হয়নি।

এবার ঠিক করলাম আমরা সবাই মিলে ইচ্ছাপুর যাব বেড়াতে। বাবাকে বললাম অফিস থেকে ছুটি নিতে। আমিও কলেজ থেকে কিছুদিনের ছুটি নেব। চাকরি পাওয়ার পর থেকে আমি খুব বেশি ছুটি উপভোগ করিনি। তাই আশা করছি ছুটিটা পেয়েই যাব। তাই ফোনে ফোনে ভাই বোনদের সাথে সব প্ল্যান করে নিলাম। সবাই বহু বছর পর আবার একসাথে হবো। মনে মনে কত ছক কষলাম, কি করে কি করব। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। দিল্লি থেকে ডিরেক্ট ফ্লাইট ধরে কলকাতা তারপর ট্রেনে চেপে দক্ষিণ 24 পরগণা জেলা। তারপর অটো করে সোজা ইচ্ছাপুর। রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ গাছেরা মনে হচ্ছে আমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে। মাঝে মাঝে কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা আমাদের মন প্রাণ কে ছুঁয়ে যাচ্ছে। স্টেশন থেকে দাদুর বাড়ি প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ। যেতে যেতে মা বলছিল "কিছুই আগের মত নেই, সব কেমন পাল্টে গেছে। হরি কাকার চায়ের দোকানটাও আর নেই।" মাটির দোকানগুলো ভেঙ্গে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও, পুরোটা ছুঁতে পারেনি। গ্রামের পথ ধরতেই মনে হচ্ছিল এ এক অমোঘ আকর্ষণ। যার টানে আমরা কেমন ভিন রাজ্য থেকে ছুটে চলে এসেছি। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজের হাতছানি। প্রশস্ত মাঠ, অবারিত ধানক্ষেত। এ যেন কোনো শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া। ওই মহকুমার বিদ্যালয় পরিদর্শক ছিলেন আমার দাদু। তাই গ্রামের সবাই তাকে খুব সমীহ ও শ্রদ্ধা করত। তাই যখন বললাম অমলেন্দু রক্ষিতের বাড়ি যাবো, তখন স্টেশনের লোকেরা সাথে সাথেই পুরো ঠিকানা টা বলে দিলো।

চল্লিশ মিনিট পথ পর করে আমরা এসে পৌঁছলাম দাদুর বাড়ি। এখনো আমি দাদুর বাড়িই বলি। হয়তোবা দাদু দিদা কেউই নেই কিন্তু তাদের স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে পুরো বাড়ি জুড়ে। আমাদের আসার খবর পেয়ে মামা মামীরা ভাইবোনেরা দৌড়ে বেরিয়ে এলো। এত বছর পর দেখা হতেই সবাই আনন্দে কেঁদে ফেললাম। বিশাল বাড়ি, গেইট থেকে বাড়ির ভেতর যেতে আমাদের পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে নিলো। এই বড় উঠোন, তার একপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। বারান্দার এক পাশে ঠাকুর ঘর, তাতে বিরাজমান আমাদের প্রাণের ঠাকুর, রামঠাকুর। মামিরা এখনো দিদার নিয়ম কে ধরে রেখেছে। মালপত্র রেখে সবাই মিলে বাড়িটা একবার ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ির পেছনে সমস্ত বড় বড় ফুলের গাছ, ঘাট বাঁধানো পুকুর। আমার একটু একটু করে ছোটবেলার কথা মনে পরলো। দাদুর হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, মাছ ধরা, ফল খাওয়া আরো কত কি। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, এখানে এসে মায়ের আনন্দ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ভাই-বোনেদের কে পেয়ে, আমাকে ভুলেই গেছে। বাবাও দেখলাম ফোন ছেড়ে মামাদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করলো। বাবারো তেমনভাবে ছুটি কাটানো হয় না। তাই শহর থেকে দূরে এসে, এই গ্রাম্য জীবন বাবার কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠলো। ঘুরে এসে, স্নান করে, ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে বসলাম বারান্দার এক কোণে। এখান থেকে বাড়ির পেছনের পুরো দৃশ্য আমার নজর কাড়লো। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যাস্ত দারুণভাবে মন টানলো। মনে মনে দাদুর প্রশংসা না করে পারলাম না, এত সুন্দর একটা বাড়ি বানানোর জন্য। প্রকৃতির এত সাবলীলতা এখানে না আসলে বোঝাই হতো না। ততক্ষণে মা মামীরা মিলে গরম গরম লুচি বানিয়ে নিল, তার সাথে কচি পাঁঠার মাংস। কথিত আছে 'ঘ্রানে ন অর্ধ ভজনং।' আমরা আসবো বলে, মামারা বাজারে কোন খামতি রাখেনি। কিছুক্ষণ বাদেই সবার সামনে চলে এলো, বাঙালির পছন্দের খাবার লুচি আর পাঁঠার মাংস, তার সাথে নানান রকমের মিষ্টি। সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে, জমিয়ে খেলাম। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার পরে, রাত নামলো। কি অপূর্ব শোভা পূর্ণিমা রাতের। পুরো উঠোনে তার আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে।

এই গ্রাম আধুনিকতার চাকচিক্য থেকে সহস্র যোজন দূরে। ইচ্ছে হয় আজীবন এখানেই থেকে যাই। এখানে নেই কোনো সময়ের কড়াকড়ি, নেই কোন টার্গেট সেট, নেই গরলতা,নেই কলহ-বিবাদ। এ যেন এক অন্য পৃথিবী, যেখানে মানুষগুলো প্রাণভরে শান্তির নিশ্বাসটুকু নেয়। গ্রামের মানুষগুলো কত সরল, শান্ত ও অতিথি পরায়ন। এখানে মন ভাঙার খেলা চলে না, বরং বিশ্বাস কে ধরে রাখার চেষ্টা চলে দিনরাত। ধোঁয়া আর দূষণ মন প্রাণে হাফ ধরায়না। প্রকৃতির আদরে তারা লালিত। এই দশ বারো দিন যে, কেমন করে কেটে গেল তা বুঝতেই পারেনি। সবার আদর-যত্নে এক মায়ার বেস্টনে আটকে পড়েছি। মন কিছুতেই ফিরে যেতে চাইছে না। কিন্তু সময় তো অন্য কথা বলে। আমরা বড্ড বেশী মেকী সভ্যতায় বিশ্বাস করি। ক্লাব,পার্টি, ডিসকো ছাড়া আমরা চলতেই পারি না। রাত করে বাড়ি ফেরাটাও এখন স্ট্যাটাস সিম্বল।কই ইচ্ছাপুরে তো এমনটা হয় না? এখানে বড় মাঠে ছেলে মেয়েরা খেলা করে। খেত ধরে ছুটে যায় বহুদূর। তাদের কাছে আকাশটাই বাইরের জগত। তারা রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত কে বাঁচিয়ে রেখেছে সবার মধ্যে। চলে আসার দু-তিন দিন আগে, হঠাৎ শুনতে পেলাম যে, দাদুর বাড়ি বিক্রি হয়ে যাবে। দেখতে গেলে সেটা ঠিক সিদ্ধান্ত। তাদেরও বয়স হচ্ছে কি করেইবা একা একা থাকবে মামা মামীরা। কিন্তু কোথাও যেন মন সাড়া দিচ্ছে না। মানতে চাইছে না আভিজাত্য ভরা এই বাড়ি একদিন ভেঙ্গে সেখানে তৈরি হবে এক বিশাল শপিং মল। শেকড়হীন হয়ে পরবো আমরা সবাই। হয়তোবা আর কখনো ফিরে আসবো না ইচ্ছাপুরে। ভাবতেই মনটা কেমন কেঁদে উঠলো। যতই বলি আমরা যোগাযোগে থাকবো আজীবন কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে না। কাজে-কর্মে, অফিসের চাপে সংসারের দায়বদ্ধতায় আটকে যাই। রাতে দু'চোখের পাতা এক করতে পারলাম না কিছুতেই। বারবার মনে হচ্ছে দাদু আমাকে বলছে "বাড়িটার অস্তিত্ব শেষ যেন না হয়", বুঝতে পারলাম না কি করব।

সকালবেলায় সবার সাথে কথাটা নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু কোন উপায় বেরিয়ে এলো না। কারণ অ্যাডভান্স পেমেন্ট করা হয়ে গেছে। এই পাঁচ ছয় মাসের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। হঠাৎ ছোট মামার কাছে একটা ফোন এলো। অনেকক্ষণ কথা বলার পর, এটাই বুঝতে পারলাম যে আলোচনার বিষয়বস্তু এই বাড়ি। শেষে মামা বলল," আমি বাড়িতে সবার সাথে কথা বলে জানাবো তোমাকে।" তারপর জানতে পারলাম যে ছোটমামার বন্ধুর ছেলে এই বাড়িটা কিনতে চাইছে। এই বাড়িটা ফার্মহাউস করবে। পাশাপাশি এটাও আশ্বস্ত করলো যে বাড়িটার কোন ক্ষতি হবে না। যেমন আছে তেমনি থাকবে। শুধু রং করে সাজিয়ে তুলবে এটুকুই। এমন পুরনো বাড়িই সে খুঁজছিলো। যার কাছে এসে দুদণ্ড শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। সে আরো বেশি দামে কিনবে এই বাড়িটা। আমরা সবাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। কথাবার্তা এগুলো এবং ভাল দিন দেখে রেজিস্ট্রিও হয়ে গেল। আমরা ছুটিটা আরও কিছু দিন বাড়িয়ে দিলাম। মামা ওরাও খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাবে। ব্যাস, সব গুছিয়ে নিতে যতটা সময়ের প্রয়োজন। সব ভালয় ভালয় মিটলো। যেদিন চলে আসব তার আগের রাতে, উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মনে হলো কোথাও দাদুর ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে। বিশ্বাস করলাম যে, আধুনিকতা চেষ্টা করেও ছুঁতে পারিনি পুরনো ঐতিহ্য কে। গাড়িতে ওঠার আগে একবার তাকিয়ে দেখলাম বাড়িটাকে, নিশ্চুপ পড়ে থাকা বাড়িটা কেমন যেন হঠাৎ প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। আবার দেখা হবে মনে মনে এই প্রতিশ্রুতি দিলাম। পথ চলতে লাগল আপন গতিতে, পেছনে পড়ে রইল আমার ছেলেবেলা।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
06.06.2022B.DuttaLost in childhood memories. Thnx for making us nostalgic. More to read such story from U.