প্রত্ন নিদর্শনে ঐতিহাসিক তথ্য সূত্রের সন্ধান

পান্নালাল রায়

ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী শহর উদয়পুরের জগন্নাথ দিঘি থেকে প্রাচীন বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধারের ঘটনা ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধানের সম্ভাবনা উন্মোচিত করছে ।বিগ্ৰহটি ঠিক কোন সময়কার এবং কি কারণে কারা এই বিগ্ৰহ দিঘিতে ফেলে দিয়েছিল তা উদঘাটন সূত্রে বেরিয়ে আসতে পারে অনেক তথ্য।

জগন্নাথ দিঘির দক্ষিণ পশ্চিম কোণে শ্লেট পাথরের মন্দিরটি অবশ্য আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত।এই মন্দিরটিই হলো ত্রিপুরার একমাত্র মন্দির যা শ্লেট পাথরে নির্মিত। অন্যান্য মন্দিরের চেয়ে তার কাঠামো এবং গড়ন আলাদা। জগন্নাথ মন্দির বা জগন্নাথের দোল নামে তার পরিচিতি হলেও আসলে এটি বিষ্ণু মন্দির। মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য এবং তাঁর ভাই জগন্নাথ দেব এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। তারা তাদের মাতার স্বর্গলাভের কামনায় ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটি উৎসর্গ করেছিলেন।প্রায় শতবর্ষ আগে প্রকাশিত 'উদয়পুর বিবরণ' গ্ৰন্হে ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এই মন্দির সম্পর্কে বলেছেন, "এইরূপ বৃহৎ ও সুন্দর মন্দির এ রাজ্যে আর নাই, পূর্ববঙ্গেও আছে বলিয়া জানা যায়না।"

এই মন্দির সম্পর্কে 'শ্রীরাজমালা' সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ জানিয়েছেন যে,এক সময় মন্দিরের গায়ে তার ইতিহাস সম্বলিত একটি শিলালিপি ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা খসে পড়ে স্হান নেয় নিকটবর্তী জঙ্গলে। মহারাজা বীরচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৮৬২-৯৬ খ্রীঃ) তা আগরতলায় এনে রাজপ্রাসাদে রাখা হয়।প্রস্তর ফলকটি দৈর্ঘ্যে তিন ফুট দেড় ইঞ্চি এবং প্রস্হে দুই ফুট দেড় ইঞ্চি। ষোলোটি পঙক্তিতে লিপি উৎকীর্ণ ছিল প্রস্তর ফলকে।বীরচন্দ্র মাণিক্যের সময়ে একবার তার পাঠোদ্ধার হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রাধাকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালে পণ্ডিত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ পুণরায় এই লিপির পাঠোদ্ধার করে তা তাঁর 'শিলালিপি সংগ্ৰহ' গ্ৰন্হে সন্নিবিষ্ট করেন। সেই সূত্রেও জানা যায় গোবিন্দ মাণিক্য ১৫৮৩ শকের(১৬৬১ খ্রীঃ) কার্ত্তিকী পূর্ণিমাতে মন্দিরটি বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।

মন্দিরটি স্হাপত্যবিদদেরও সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কেউ কেউ একে সারনাথের স্তুপের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। সেকালের বিশিষ্ট স্হাপত্যবিদ শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই মন্দিরটি সম্পর্কে 'রবি' পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, মন্দিরটি শুধু স্হাপত্যকলা হিসেবেই মূল্যবান নয়,এর মাধ্যমে ত্রিপুরার ধর্ম্মযুগের ও সভ্যতার একটি বিশেষ ধারা আবিষ্কার করা যাবে। তিনি বলেছিলেন, মন্দিরের গঠন সারনাথ স্তপের মতো।

১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট কে.এন. দীক্ষিত উদয়পুরের বিভিন্ন প্রত্নসম্পদ ও স্হাপত্য নিদর্শন পরিদর্শন করেন।এই মন্দিরটি সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন-'... The Temple was built in 1661A.D.in the reign of Gobinda Manikya,and was originally dedicated to Vishnu.

তিনি মন্দিরটি যথোপযুক্ত সংস্কার ও সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিলেন সেদিন। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।প্রায় শতবর্ষ আগে শ্রীরাজমালা সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সেনও মন্দিরটি সংস্কারে কোন চেষ্টা হয়নি বলে আক্ষেপ করেছিলেন।

যাইহোক, এসব আলোচনা থেকে দুটি জিনিস স্পষ্ট যে, মন্দিরটি ছিল বিষ্ণু মন্দির এবং শতবর্ষ আগেই তার অবস্থা ছিল ধ্বংসোন্মুখ। জগন্নাথ দিঘি থেকে উদ্ধার হওয়া বিষ্ণু বিগ্ৰহ নিয়ে আলোচনায় অনিবার্য ভাবে এসে যায় দিঘি সংলগ্ন মন্দিরের কথা। উদ্ধার হওয়া বিষ্ণু মূর্তি অতীতে এই মন্দিরেই পূজিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।বিগ্ৰহ বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সঠিক ভাবে বলতে পারবেন এর সঠিক নির্মাণকাল এবং তার নির্মাণ শৈলী কোন্ ঘরানার। তবে অনুমান করা যায় বহির্ত্রিপুরা থেকে আনা হয়েছিল এই বিগ্ৰহ। আলোচিত মন্দিরটি নির্মাণে ব্যবহৃত পাথরও আনা হয়েছিল বাইরে থেকে।

প্রশ্ন হলো এই বিগ্ৰহ দিঘিতে গেল কি ভাবে? কেউ বলছেন রাজধানী স্হানান্তরের সময় এই বিগ্ৰহ দিঘিতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। আবার কেউ অন্য‌ সম্ভাবনার কথাও বলছেন।

তবে সাধারণ ভাবে যা বলা যায়,বর্হিশত্রুর আক্রমণের সময় রাজধানী লুন্ঠিত হয়।আক্রমণ নেমে আসে মঠ মন্দিরে। সেটা মন্দিরে গোপনে রক্ষিত ধনদৌলতের জন্যও হতে পারে। দেশের অসংখ্য মন্দিরে নানা সময়ে এরকম বহু আক্রমণ লুন্ঠন সংঘটিত হয়েছে। উদয়পুর এর ব্যতিক্রম হবে কেন! গোটা ভারতের মধ্যেই উদয়পুর এক সুপ্রাচীন রাজধানী।রাজমালা অনুসারে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ত্রিপুরার রাজা যুঝার ফা রাঙ্গামাটিতে রাজধানী স্হাপন‌ করেছিলেন।ষোড়শ শতকে উদয় মানিক্য নিজের নামানুসারে রাজধানীর নাম রাখেন উদয়পুর। অষ্টাদশ শতকে কৃষ্ণ মাণিক্য উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান আজকের পুরান আগরতলায়।তা হলে দেখা যাচ্ছে প্রায় বারোশ বছর রাজধানী ছিল রাঙ্গামাটি-উদয়পুর।এই সুদীর্ঘ সময়কালের মধ্যে যুদ্ধবিগ্ৰহের অনেক ধকল গেছে রাজধানীর উপর দিয়ে।বর্হিশত্রুরা হানা দিয়েছে। লুন্ঠন চালিয়েছে। এছাড়াও ছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র সহ নানা কলহ,রাজার রাজধানী ত্যাগ ইত্যাদি। সপ্তদশ শতকে গোবিন্দ মাণিক্য কর্তৃক আলোচিত মন্দিরটি নির্মাণের পর অষ্টাদশ শতকে উদয়পুরে সমসের গাজির আক্রমণ সম্পর্কে ঐতিহাসিক কৈলাসচন্দ্র সিংহ লিখেছেন-"...সমসের ছয় সহস্র উৎকৃষ্ট বলবান সৈন্য প্রস্তুত করিয়া তাঁহারা রাজধানী উদয়পুর আক্রমণ ও লুন্ঠন করেন।..."

যাইহোক, মন্দিরটি নির্মাণকালের পরবর্তী সময়ে যেকোনও ভাবেই হোক বিষ্ণু বিগ্ৰহটি দিঘির জলে ফেলে দেয়া হয়েছিল। সেটা রাজধানী স্হানান্তরের সময়ও হতে পারে।আর উদয়পুর থেকে রাজধানী স্হানান্তরের সূচনা ঘটেছিল সমসের গাজির আক্রমণের সূত্রেই। যুবরাজ কৃষ্ণমণি সমসেরের আক্রমণের মুখে উদয়পুর ছেড়ে পুরান আগরতলায় বসবাস করতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে রাজা হয়ে পুরান আগরতলাতেই স্হায়ী ভাবে রাজধানী সরিয়ে আনেন।

ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের স্বদেশ দর্শন প্রকল্পে উদয়পুরের কয়েকটি দিঘির উন্নয়নের কাজ চলছে। সেই সূত্রেই জগন্নাথ দিঘির সংস্কার কাজ করতে গিয়ে পাওয়া যায় বিষ্ণু বিগ্ৰহটি। কিছু দিন আগেও এই দিঘির খনন কাজের সময় বিগ্ৰহের ভগ্নাংশ উদ্ধার হয়েছিল। বিষ্ণু মূর্তি উদ্ধারের ঘটনায় এবার কিছু ঐতিহাসিক সূত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে উদয়পুরের মাটির নিচে হয়তো এরকম আরও বিগ্ৰহ সহ অমূল্য প্রত্নসম্পদ লুকিয়ে আছে। শুধু উদয়পুর কেন, ঊনকোটি, পিলাক সহ ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে নানা প্রত্নসম্পদ।আছে পুরাকীর্তি। এসবে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ উপাদান। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক এসবের যথোপযুক্ত সংরক্ষণ খুবই প্রয়োজন।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.