।। সুখানুভূতি ।।
অরিন্দম নাথ
ফুটবল খেলার উৎপত্তি কোথায় সঠিক জানিনা । কোথাও পড়েছিলাম এই খেলার উৎপত্তি শ্রমিকদের হাত ধরে । একজায়গায় কিছু নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিল । মাটি খুঁড়তে গিয়ে একটি মরার খুলি খুঁজে পায় । তখন ইলশাগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছিল । এরইমধ্যে শ্রমিকরা মরার খুলি নিয়ে লাথালাথিতে মত্ত হয়ে পড়ে । পৃথিবীর প্রথম ফুটবল খেলা । আমরা প্রত্যেকেই জীবনে কমবেশি ফুটবল খেলায় অভ্যস্ত । বিশেষ করে বাঙালিরা ।
আমার ছোটবেলা কেটেছে ধর্মনগরে । প্রথম স্কুল পদ্মপুর নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয় । এরপর আমার আলমাম্যাটার বি বি আই । বীর বিক্রম ইনস্টিটিউটিশন । তখন আমাদের ছোট্ট শহরে খেলাধুলার এক মহাল বিরাজ করত । একদিকে বি বি আই । অন্যদিকে ডি এন ভি । দীননাথ নারায়ণী বিদ্যামন্দির । প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রেশারেশি । কখনও কখনও মারামারি । এই আকর্ষণেই গ্রামের স্কুল পদ্মপুর ছেড়ে বি বি আই-তে ভর্তি হওয়া ।
আমাদের শারীর শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় ক্ষিতিমোহন ভট্টাচার্য । এছাড়া ছিলেন শিবেন্দু চক্রবর্তী । ক্ষিতি স্যারের মাথায় আধাপাকা চুল ছিল । ছেলেরা আড়ালে আবডালে ডাকত আদাবুড়া । হয়তো হাফ এজেডের সিলটি রূপান্তর । স্যার ছাত্রদের চারটি ভবনে ভাগ করেছিলেন । কীর্তি ভবন । স্ফূর্তি ভবন । শক্তি ভবন । জ্যোতি ভবন । এরপর এই ভবন গুলোর সদস্যরা বিভিন্ন ইনডোর এবং আউটডোর গেমে অংশ নিত । বেস্ট ভবন ট্রফি বিতরণ হত । কি ক্রাইটেরিয়াতে এই ভবন বন্টন হত জানিনা । তবে শক্তি ভবনের ছাত্ররা ভীষণই হেলথ মিনিস্টার হত । বৃষ্টির সঙ্গে ক্যারিকেটে হাটতে পারত । গা ভিজত না । আমি ছিলাম কীর্তি ভবনে । আমাদের ক্যাপ্টান ছিলেন অলক মুখার্জি । প্রথম বছর মার্চপাস্টে আমি ভবনের প্ল্যাকার্ড বিয়ারার ছিলাম । একটি পুরস্কার পেয়েছিলাম । খেলার সুবাদে জীবনে একমাত্র পুরস্কার ।
অলকদা কয়েক বছর আগে স্পোর্টসের অফিসার হিসেবে অবসরে এসেছেন । এখন ধর্মনগরে থাকেন । তিনি টোটাল ফুটবল খেলতেন । উইঙ্গ, লিঙ্কম্যান এবং ব্যাকে সব জায়গাতেই মানিয়ে নিতে পারতেন । অনেক সময় তিনি আমাদের শিক্ষকদের সঙ্গেও খেলতেন । কালীদাস দত্ত । কেমিস্ট্রির মানিক স্যার । ইংরেজির শিবদাস দত্ত । কখনও কখনও আমার বাবাও খেলতে যেতেন । একবার স্যারদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ হয়েছিল । শিক্ষক দিবসে । তখন সুরেশ চক্রবর্তী বি বি আইয়ের প্রধান শিক্ষক । তিনি রেফারি হয়েছিলেন । আমরা সেদিন বাধনহারা আনন্দ পেয়েছিলাম । ধর্মনগরের অতীতের ঐতিহ্যবাহী দিনগুলো ভুলার নয় । জামাল উদ্দিন, কৈলাস রিয়াং,কাজল দত্ত, মাখন সিনহা, আমুতন সিনহা, সুদীপ সোম, দহরাম রিয়াং , তাপস দে, সুশান্ত নাথ, বিকাশ নাথ, ফটিক দত্ত, রাতুল ভৌমিক, দিপু চক্রবর্তী, অসীম মুখার্জি, দিপেন দেব, চন্দন শর্মা, চন্দন চক্রবর্তী এমনি সব ফুটবলাররা মাঠ মাতিয়ে রাখতেন ।
ফুটবল সম্পর্কে এই লেখার ইচ্ছে হঠাৎই । গত সপ্তাহের কথা । কলকাতা থেকে কিছু অতিথি এসেছিলেন । এরমধ্যে দুইজন বার্তাজীবী বন্ধু । একজন পুরুষ । একজন মহিলা । পুরুষ ভদ্রলোক অকৃতদার । বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে । ভদ্রমহিলা ওনার চেয়ে একটু বড় । সঙ্গে তাঁর স্বামী এবং পুত্রবধূ । ত্রিপুরার প্রতি তাঁদের ভীষণ আসক্তি । ফিবছর ঘুরতে আসেন । করোনার কারণে দু'বছর আসতে পারেননি । এই এলেন । শহরের একটি রেস্তোরাঁয় নৈশভোজে আমন্ত্রণ করেছিলাম । সঙ্গে আমার স্ত্রী । আমার একটি খারাপ স্বভাব আছে । বয়স পেরিয়ে যাওয়া ব্যাচেলর দেখলে লেগ-পুলিং করা । কারণে অকারণে দেবদাস খুঁজা । এইকরে কখনও কখনও মণিমুক্তো বেরিয়ে আসে । এক্ষেত্রে কিন্তু অন্য ফল হচ্ছিল । পারমিতা বিরক্ত হচ্ছিল ।
তাই প্রসঙ্গান্তরে গেলাম । অন্য পুরুষ বন্ধুটির সঙ্গে গল্প জুড়লাম । তিনি একজন প্রফেশনাল ফুটবল রেফারি । আক্ষেপ করছিলেন কোভিডের কারণে প্রায় দু'বছর ঘরে বসা । এরমধ্যে একটি বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেছেন । ছোট্ট রোল । রেফারির ভূমিকায় । প্রচারবিমুখ লোকটির সহচর্য ভালো লাগে । কিছু মজাদার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে বলি । একদম নিরাশ করেন না । গ্রাম বাংলায় এখনও প্রচুর ফুটবল খেলা হয় । একদিনের টুর্নামেন্ট ৷ ফাইভ-অ্যা সাইড । সিক্স-অ্যা সাইড । পনের-ষোলটি করে টিম থাকে । দুইটি গ্রুপে খেলে । প্রতিটি ম্যাচ পনের-বিশ মিনিটের ৷ ড্র হলে টাই-ব্রেকার ৷ আর তাতেও ফয়সালা না হলে টস । একবার এমনি টস করেছেন । মাঠের মধ্যে দুই দলের ক্যাপ্টান । দুজন লাইন্সম্যান । আর রেফারি । চারপাশে দুই দলের সমর্থক । তুমুল উত্তেজনা । তিনি টস করেছেন । হেড ওঠেছে । যে দলটির ক্যাপ্টান টেল বলেছিল সে ভীষণ সেয়ানা । মুহূর্তে 'আমরা জিতেছি!' 'আমরা জিতেছি!' বলে তাদের সমর্থকদের দিকে দৌড়ে গেল । অন্যপক্ষের ক্যাপ্টান এবং খেলার পরিচালকদের তখন ভ্যাবাচেকা অবস্থা । অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা কিছুটা আচ করতে পারেন । তারা এগিয়ে আসেন । মাইক্রোফোনে ঘোষণা করেন, "রেফারির সিদ্ধান্তই, ফাইনাল সিদ্ধান্ত ।"
এরপর থেকে টস করার আগে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করেন । হেড বা টেল, ক্যাপ্টানরা যা কল করেছে হাতের কবজিতে লিখে দেন । আরেকবার হয়েছে বিপদ । ভীষণ উত্তেজনার সব ম্যাচ । সেই গ্রামে আগে কখনও যাননি । বোমা এবং আগ্নেয়াস্ত্রের ভীষণ ছড়াছড়ি । দুই দলের উগ্র-সমর্থকদেরই দাবি তাদের দলকে জেতাতে হবে । গোল হলে অফসাইডের নিয়মে বাতিল করতে হবে । তাদের দলকে পেনাল্টির সুযোগ দিতে হবে । সুযোগ পেলেই ভিড়ের মধ্য থেকে রেফারি-লাইন্সম্যানদের বোমা-পিস্তল দেখায় । সন্ধ্যের দিকে ফাইনাল খেলা । উত্তেজনা তখন চরমে পৌঁছালো । তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো বাড়তে থাকলো । দেড়-দু'হাজার টাকা পারিশ্রমিক ! এরজন্য পিতৃদত্ত প্রাণ বিসর্জন দেবেন ! তাঁরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলেন বাঁশিতে আর ফু দেবেন না । কর্মকর্তারা বিপদ আচ করলেন । তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আশ্বাস দিলেন । সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত পারিশ্রমিক । ঠিক হল খেলা শেষ হলে রেল পর্যন্ত তাঁদের পৌঁছে দেওয়া হবে । আবার খেলা শুরু হল । একসময় সফলভাবে শেষও হল ।
আরেকবারের ঘটনা । একদিনের ফুটবল টুর্নামেন্ট । উদ্যোক্তা একটি জিলা পুলিশ । ফাইনাল ম্যাচ শুরু হবে । দুই দলের ক্যাপ্টান, দুইজন লাইন্সম্যান ও রেফারি মাঠের মাঝখানে টস করবেন । চারপাশে লোকে লোকারণ্য । এমন সময় বিপত্তি । গোলপোস্টের সঙ্গে নেট থাকে । একদিকের গোলপোস্টের জালে একটি কুকুর আটকে গিয়েছে । অনেক কষ্টে সারমেয়টিকে বন্ধনমুক্ত করা হল । এবার কুকুরটি সোজা চলে গেল মাঠের মধ্যে । সেখানে তখনও খেলা শুরুর প্রস্তুতি চলছে । তারপর কাউকে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়েই কুকুরটি রেফারির পায়ে কামড়ে দিল । আর পরমুহূর্তেই লাফ দিয়ে একদিকের দর্শকদের মধ্য দিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল । সেইম্যাচে আমাদের বন্ধু বাঁশিতে ফু দিতে পারেননি ।
পরদিন সকালে জলিকে নিয়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছি । কুকুরটি কেন এমন আচরণ করলো ব্যাখ্যা খুঁজলাম । জলি এবং তার বন্ধুদের সহচর্যে কিছু উত্তর খুঁজে পেলাম । একটি মনে ধরল । রেফারির বাঁশির আওয়াজে মাঠের কুকুরেরা বিরক্ত হয় । মাঠের উপর অন্যরা অধিকার কবজা করবে তা পছন্দ নয় । গোল হলে বাঁশি বাজে । আর বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই বাজি-পটকা ফুটে । তাই কুকুরটি সেদিন পালের গোদাটিকে সনাক্ত করে কামড়ে দিয়েছিল । আর বুঝিবা গেয়েছিল, "বাঁশি শুনে আর কাজ নাই.. ।"
গীতিকার শাহির লুধিয়ানভির একটি গান আছে । আমার ভীষণ পছন্দের । 'ম্যায় পল দো পল কা শায়র হু... পল দো পল মেরি কহানী হ্যা'... আমি কবি এক দুই মুহূর্তের জন্য....এক দুই মুহূর্তের জন্য আমার গল্প । কবি বর্তমানকে উপভোগ করার বার্তা দিয়েছেন । তথাপি আমার মত অনেকেই হয়তো অতীতকে ভালোবাসেন । অতীতের প্রসঙ্গ এলে নস্টালজিক হয়ে পড়েন । সেই সুখের মুহূর্তগুলি মনে করেন । একধরনের প্রেম মনে জাগে । প্রেমে পড়লেই মানুষ সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারে । সেই প্রেম জাগতিক হতে পারে । কিংবা রোমান্টিসিজম । অথবা আসক্তি । খেলাধুলার প্রতি আসক্তি । গানের প্রতি আসক্তি । লেখালেখিতে আসক্তি । ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ানোর আসক্তি । প্রতিটিই আমাদের সুখানুভূতি এনে দেয় । সেই এক পল দুই পল নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি ।