“শুধু আবেগের বহিঃপ্রকাশ কবিতা নয়, বড়জোড় শ্লোগান হতে পারে।”
সৌম্যদীপ দেব
April 13, 2025
প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতা যাকে সময়ের ময়দানে আরো বেশি করে পরিচিত করে তুলেছিল তিনি কবি তন্ময় মণ্ডল। তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সৌম্যদীপ দেব
সৌম্য: আপনার থেকে প্রথমেই জানতে চাই, এই সময়ের কবিতায় প্রতিবাদের মুখ ও স্বর অনেকাংশেই বেশি বলেই মনে হয়। কেন? এতো প্রতিবাদ কেন? কেন কবিরা প্রতীবাদী হতে বাধ্য হচ্ছেন? ক্ষয়িষ্ণু সমাজের গায়ে একটা নতুন ডিসকোর্স নয় তো?
তন্ময় : কবিতায় সমাজ-দেশ-কাল সর্বোপরি সমকালীন সময়ের ছাপ ভেসে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। প্রতিবাদও সেই প্রবহমান সময়রেখার একটি অংশমাত্র। কবি মানুষের কথা, সমাজের কথা এমনকি ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনুভূতির কথা লিখবেন তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতে, তেমন রসদ থাকলে সেই রচনাই অসংখ্য মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে উঠবে। আর নতুন ডিসকোর্সের ব্যাপারে বলি শুধু আবেগের বহিঃপ্রকাশ তো আর কবিতা নয় বড়জোড় শ্লোগান হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত আবেগ একটি ভালো কবিতার জন্ম দিতে পারে। তবে এখন যে খুব প্রতিবাদের কবিতা লেখা হচ্ছে তা আমার মনে হয় না। অনেকেই লিখছেন। অনেকে হয়তো আগামীতে লিখবেন। চলমান সব ঘটনা নিয়ে সব কবির পক্ষে লেখা সম্ভব নয়, আর আজকের এই বিনোদনসর্বস্ব যুগে রিলস-এর অনেক বেশি ক্ষমতা কবিতার চেয়ে। কবিতা অবশ্য কোনোকালেই খুব জনপ্রিয়তম শিল্পমাধ্যম ছিলও না।
সৌম্য: এই সময়ে বিশেষত কলকাতার নাগরিক জীবনে বহু জনপ্রিয় গান গাইয়ের কবি বা লেখক হওয়ার সাধ জেগেছে। তারা হুড়মুড় করে হঠাৎ এক সকালে লেখক হয়ে উঠলেন। কেন? এই অত্যাশ্চর্য বিষয়টি কেন হয়েছে বলে মনে হয় আপনার? আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় লেখালেখি তাদের কাছে চয়েজ নয় চান্স! নিজেকে সময় দেওয়া, গড়ে নেওয়া আর বীজতলা তৈরি! কোথাও নিজেই নিজেকে অস্বীকৃত করা নয় তো?
তন্ময় : অনেকেরই অনেক কিছু হয়ে ওঠার ইচ্ছে জন্মাতে পারে। সময় বা বয়স সেক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়। এক ব্যক্তি একাধিক ক্ষেত্রে সাধনায় লিপ্ত থাকতেই পারেন, তাতে উদ্বেগের কিছু নেই। সময়ের ঘূর্নাবর্তে টিকে থাকতে হলে যা দরকার সেই সৃষ্টি যদি কেউ করতে পারেন তা তো আনন্দের। আবার কলকাতা বইমেলায় আপনি দেখবেন অনেক গায়ক, অভিনেতার বইপ্রকাশ হয়। এতে খারাপ দিক কিছু আছে কি-না আমি জানি না, তবে ভালো দিক কয়েকটা আছে। প্রথমত বইয়ের প্রকাশক লাভবান হবেন। দ্বিতীয়ত কোনো জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যমের মানুষের অংশগ্রহণ লেখালিখির মতো স্বল্প জনপ্রিয় ক্ষেত্রকে খানিকটা হলেও বিস্তৃত করবে বলে আমার মনে হয়।
সৌম্য: কীভাবে এই লেখক জীবনের জন্ম হয়েছিল? কুসুমাস্তীর্ণ পথ তৈরি করতে পেরেছেন না আজ-ও কণ্টকাকীর্ণ?
তন্ময়: আমি যেখানে জন্মেছি সেটি একটি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। যেখানে বড় হয়েছি সেখানের অধিকাংশই শরণার্থী পরিবার। ফলে শৈশব থেকেই বাংলা ভাষার একাধিক উপভাষার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। মনের আনন্দে যেখানে যখন গিয়েছি তাদের উচ্চারণে কণ্ঠ মিলিয়েছি। পরে বুঝেছি এগুলো আমার অনেক কাজে এসেছে নানা সময়ে। ২০১১ সাল থেকে আমি পাকাপাকিভাবে কলকাতায় থাকি। তবে বুকের ভেতর লালন করি একটি সবুজ গ্রাম। জীবনের পথ হোক বা লেখালেখির—সে তো বন্ধুর হবেই, প্রতিকূলতা ছিল, থাকবেও। কিন্তু নিজেকে নির্মাণের প্রক্রিয়া, সৃজনশীলতার ধারাবাহিক চর্চাই কণ্টকাকীর্ণ পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। বসে বসে শুধু প্রত্যাশার গাছে জল দিলে তাদের বিপন্নতা গ্রাস করবেই।
সৌম্য: ‘পুলসিরাত পেরিয়েই পারিজাত বন’ আপনার জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। মেধাবী নামকরণ নিঃসন্দেহে। এই নামকরণের প্রেক্ষাপট ও বর্তমান কবিতার ভাষা বোধ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে বলুন।
তন্ময়: ওটা একটা অধ্যায় ছিল তখন জীবন বদলাচ্ছে অতিদ্রুত। আর আমি যা বিশ্বাস করি না—তা কখনও লিখিনি। সবার সঙ্গে সব মত মিলতে নাও পারে। অন্ধকার গহ্বরে বসে আলোকিত সকালের প্রার্থণায় লেখা হয়েছে এই বইয়ের কবিতাগুলো। ‘পুলসিরাত’ ও ‘পারিজাত বন’ এই দুটি শব্দই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান দুটি ধর্মে খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। মূলত সংঘাতের কথা, সম্প্রীতির কথা, জীবনের কথা, জীবন ছাড়িয়ে মহাজীবন—তা ব্যক্তিগত হতে পারে আবার তার গ্লোবাল অ্যাপিলও থাকতে পারে। নিকশ তমসার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আলোর কুচির সন্ধান করেছি। বাকি যারা পড়েছেন তারা বলবেন।
সৌম্য: “এখনকার কবিরা কবিতা যতনা লেখে, ততোধিক লেখে উৎসব।” — কেনো এমন মনে হয় আপনার?
তন্ময়: এটা বিশ্বায়নের প্রভাব। যিনি প্রকৃত অর্থেই লিখতে এসেছেন আলোর আড়ম্বরে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যাবে না। কবিতা নিমগ্নতা চায় তবে কোলাহলের অংশ হয়ে যদি কবিতার পরিমণ্ডল বড় হয় হোক না ক্ষতি কী। উৎসব হোক, উৎসবে অংশগ্রহণেও উৎসাহ থাকুক তবে যদি দেখা যায় দুর্গাপুজোয় প্যান্ডেল হল ইয়া বড়, লাইট-মাইক গমগম করছে—হঠাৎ খেয়াল পড়ল ঠাকুরই আনা হয়নি। এইরকম হলে তো মুশকিল। নিরন্তর চর্চা, ধারাবাহিকভাবে লেখার টেবিলে না বসলে উৎসবের আলো, কিছুদিন পরেই আগ্রহে ভাটা পরে ম্লান হয়ে যাবে।
সৌম্য: ‘পালক জীবন’ এর অভ্যন্তর থেকে ‘মৃত্যুকে খোলা চিঠি’ তে কী বলতে চান?
তন্ময়: ‘মৃত্যুকে খোলা চিঠি’ আমার প্রথম কবিতার বই। নয়-দশ বছর আগে প্রকাশ পেয়েছিল। এই বইটি বলতে পারেন এক তরুণ কবিতাপ্রয়াসীর নিজস্ব কাব্যভাষার অনুসন্ধান। বইটি আমার প্রাথমিক পরিচিতি তৈরির ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা নিয়েছিল। ‘পালক জীবন’-এ চেষ্টা করেছি কবিতার ভাষা আমূল বদলে ফেলতে।
সৌম্য: লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা৷ সাংবাদিক হিসেবে সংবাদ লেখা যেখানে শেষ হয়, ঠিক তার পর থেকেই শুরু হয় গল্প। — কী বলবেন আপনি?
তন্ময়: পেশা হিসাবে সবাইকে কোনো না কোনো কাজ বেছে নিতে হয়। তবে আমি সবসময় চেয়েছিলাম লেখালিখি সংক্রান্ত কোনো কাজ হলেই ভালো। তাই অনেক পথ ঘুরে এখানে খানিক থিতু হয়েছি। তবে পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা লেখায় তো প্রতিভাত হয়ই। আমাদের পেশায় নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি একটু বেশিই। এখানে রিক্সাচালককেও কাছ থেকে জানার সুযোগ রয়েছে আর সম্ভ্রান্ত কোনো ব্যাবসায়ীর মনোজগত পড়ে ফেলার সুযোগ আছে। এসব নিজের অজান্তেই গল্প-কবিতায় চলে আসে।
সৌম্য : ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ একজন লেখকের অবশ্যই পড়া উচিত, এটা মনে হয় আপনার? যদি হয় তাহলে কেন? ধর্মতত্ত্বের বাইরে গিয়ে সাহিত্য জিজ্ঞাসা ও দর্শনের রেখাটুকু আপনার পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলুন।
তন্ময়: সব লেখককে পড়তেই হবে এমন কোনো অবশ্যপাঠ্য বই পৃথিবীতে নেই। অবশ্যপাঠ্য অ্যাকাডেমিশিয়ানদের ক্ষেত্রে হয়। লেখক তাঁর প্রয়োজন বা খিদে অনুযায়ী খাদ্য অর্থাৎ বই গলাধঃকরণ করবেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক লেখকের রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। লেখকের পড়া আর একজন পাঠকের পড়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। পাঠক কাহিনি পড়েন, লেখক প্রকরণ ও গঠনশৈলীর উৎসমুখে লুকনো মণিটি আবিষ্কার করার চেষ্টায় থাকেন। আর প্রকৃত ধর্ম মানুষকে সংযম দেয়, সুশৃঙ্খল করে। কিছু মানুষ নিজের সুবিধার্থে কোথাও আড়ম্বরসর্বস্বতা কোথাও ব্যক্তিস্বার্থকে ধর্মের মোড়কে চালান করতে গিয়েই বিপত্তি তৈরি করে। একজন লেখকের কাছে সবচেয়ে বড় ধর্ম মানবিক মূল্যবোধের ধর্ম।
সৌম্য: কেন লেখেন? কেন লিখতে হবে?
তন্ময়: চাইলেই চাঁদে যেতে পারব না। চাইলেই অমানুষের মাথায় বসিয়ে দিতে পারব না তিমিমাছের মুণ্ডু। চাইলেই সব অন্ধকারের আস্ফালন এক লহমায় মুছে দিতে পারব না। তাই লিখি।
সৌম্য: সাহিত্যে ছকটা কোথায় ভাঙছে এই প্রজন্মের কেউ কেউ? আদৌও ভাঙা যাচ্ছে (ব্যতিক্রমকে গুরুত্ব দিয়েই)? মানে সেই ঘুরিয়ে আবার একই পাত্রে পরিবেশন নয় তো? এই সময়ের সাহিত্যে নিরীক্ষাকে কীভাবে দেখছেন?
তন্ময় : যাঁরা ছক ভাঙেন তাঁরা চিরকালই সংখ্যায় কম। নতুন প্রজন্মের অনেকেই নিরীক্ষা করছেন। কবিতায়, গদ্যে। নতুন আঙ্গিকই তো সাহিত্যের প্রবাহমানতাকে ত্বরান্বিত করে। দিগন্ত খুলে দেয়। আরো দশটা বছর পার করলে তাঁদের মুখগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হবে।
সৌম্য: আপনি তো গল্পও লিখছেন ইদানীং। গল্পের বইও প্রকাশিত হয়েছে। গল্প লেখার ক্ষেত্রে অন্তর্গত দর্শন বা চালিকাশক্তি কী? সে ব্যাপারে একটু বলুন।
তন্ময় : কবিতাই মূলত লিখতাম একটা সময় অবধি, কখনও কখনও টুকরো টুকরো গদ্য। বলা যায় কবিতাই হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে অবয়ব দিত। একদিন মনে হল সব কথা বলা যাচ্ছে না কবিতায়, আরো বড় ক্যানভাস চাই। ব্যাস শুরু হল গল্প লেখা। আমার গল্পের প্রথম ও শেষ উপাদান রক্তমাংসের মানুষ। পরিচিত পরিবেশ, সংকট, প্রতিরোধ, ভালোবাসা, ঘৃণা সবই আছে। আগস্টে প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম গল্পের বই ‘বোড়ে’। এই বইয়ের বেশ কয়েকটা গল্পই তীব্র পলিটিক্যাল। সব গল্পেই আমি সমাজের বিভিন্ন স্তরের ‘বোড়ে’ শ্রেণির মানুষের মুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেছি।
সৌম্য: ২০১৩ থেকে ২০১৮ ‘নবাঙ্কুর’ পত্রিকা আপনার সম্পাদনায় প্রকাশিত হল৷ তারপর কেনো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল এই সাহিত্য-শিল্পের কাগজ?
তন্ময় : কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের দাবিতে পত্রিকার নিজস্ব চরিত্র তৈরি হয়। প্রত্যেকটি লিটিল ম্যাগাজিনের একটা নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল থাকাই ভালো। তা না হলে নিজস্বতা হারিয়ে যায়।
সৌম্য: নতুন কী পড়ছেন? নতুন কী লিখছেন?
তন্ময়: যখন যা পড়তে ভালো লাগে পড়ি। প্রতিদিন দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় পড়ার জন্য রাখার চেষ্টা করি। বিশ্ব জুড়ে ছড়ানো এত মণিমুক্ত। সে তুলনায় সময় বড় কম। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সবই লিখছি যখন যে লেখা আসছে। একটি শিশুদের উপযোগী ছড়ার বই বের হবে সামনেই। আর একটা নিবন্ধের বইয়ের কাজ চলছে ‘বাঙালির সংকট ও অন্যান্য’।
আরও পড়ুন...