রবীন্দ্রনাথ, মণিপুরী নৃত্য ও ত্রিপুরা

পান্নালাল রায়

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মাধ্যমেই একদিন বাংলার ভদ্র সমাজে নৃত্য চর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু শুরুর সেই দিন গুলোতে নৃত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অনেক বিরূপ সমালোচনারও সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও বাঙালি ভদ্র সমাজে নৃত্যচর্চা ছিল অতীব নিন্দনীয়। নৃত্যের প্রসঙ্গ এলেই যেন সকলের চোখের সামনে ভেসে উঠতো বাঈজী নাচের কথা। রাজা, বাদশা, জমিদারদের ফূর্তির জন্যই যেন সৃষ্টি হয়েছে এই নৃত্যের। আবহমানকাল থেকে চলে আসা বাংলার নানা লোকনৃত্যও কোনঠাসা। একমাত্র অন্ত্যজদের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে টিকে রয়েছে তা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশের নানা ধ্রুপদী নৃত্যও চলে গেছে অন্তরালে। এই রকম অবস্থায় বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বলা যায় এক বিপ্লব ঘটালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর হাত ধরেই নৃত্য এসে গেল সামনে, হয়ে উঠল সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম উপাদান। কিন্তু এর সূচনা পর্বে কবির অভিজ্ঞতা নিশ্চিত তেমন সুখকর ছিল না। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও উঠেছিল যে তিনি যুবতীর নাচের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন।যাই হোক, শেষপর্যন্ত অবশ্য রবীন্দ্র নৃত্যভাবন ফলিত রূপ পাবার পর বাংলায় শুরু হয় নৃত্যচর্চা। দিনে দিনে প্রসার লাভ করে তা।

রবীন্দ্রনাথ কেন এবং কিভাবে নৃত্য সম্পর্কে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন সে নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কেউ কেউ এর পেছনে কবির দেশ বিদেশে ভ্রমণ ও বিভিন্ন অঞ্চলের নাচ দেখার অভিজ্ঞতার কথাও উল্লেখ করেছেন। কেউ বলেছেন কবি শিক্ষাকে পরিপূর্ণ আনন্দময় করার উদ্দেশ্যেই শান্তিনিকেতনে নৃত্য শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু সেই নৃত্য ভাবনা কিভাবে কবির মধ্যে এসেছিল? এ সম্পর্কে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন,"... জোড়াসাঁকো বাড়িতে গান ছিল, বাজনা ছিল, অভিনয় ছিল, কিন্তু নাচ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মাথায় ঘুরছিল নাচ, তবে তার প্রকাশটা কিভাবে হবে ধরতে পারছিলেন না।...১৯১১ সালে রাজা নাটকে ঠাকুরদার চরিত্রে অভিনয়ের সময় রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ মঞ্চে গানের সঙ্গে নেচেও ছিলেন।... তারপর ১৯১৬ সালে ফাল্গুনী নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের নাচের ছবি অবনীন্দ্রনাথ অমর করে রেখেছেন , তাঁর সেই বিখ্যাত ছবিতে। তবে এ সবই বিচ্ছিন্ন একক প্রচেষ্টা।বাংলার নৃত্য জগতে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা হল ১৯১৯ সালে।..."

কবি শিলং-গৌহাটি হয়ে সিলেট সফরে গিয়েছিলেন ১৯১৯সালে। সিলেটের মাছিমপুরে তিনি মণিপুরী নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন। এরপরই কবি শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৃত্য প্রচলনের চিন্তা করেন বলে গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন।সফর শেষে শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে তিনি ত্রিপুরা থেকে একজন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক পাঠাবার অনুরোধ জানান। ত্রিপুরার সিংহাসনে তখন বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য। কবির অনুরোধে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহকে তখন শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সিলেট সফরের আগেও রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় মণিপুরী নৃত্যগীত উপভোগ করেছিলেন। ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে কবি যখন প্রথম আগরতলায় আসেন তখন তাঁর সম্মানে মণিপুরী নৃত্য-গীতের আয়োজন হয়েছিল। সেটা ১৮৯৯ সাল। কিন্তু প্রথম মণিপুরী নৃত্য উপভোগ করলেও সেসময় নৃত্য নিয়ে তিনি তেমন কিছু ভাবেননি। পরবর্তী দেড় দশকে নাচের প্রতি কবির আগ্ৰহ পরিলক্ষিত হলেও তা পূর্ণতা পায় ১৯১৯ সালে সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরী নাচ দেখার পর।বলা যায় সিলেটে দেখা মণিপুরী নাচ কবির নৃত্য ভাবনা উসকে দিয়েছিল। অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন 'তিনি দেখলেন মণিপুরী নাচের ভঙ্গি,বিন্যাস ও ছন্দ তাঁর নিজের গানের মেজাজের সঙ্গে ভালো মেলে।...'

কবি ত্রিপুরা থেকে নিয়ে গেলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক। শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৃত্যের গোড়াপত্তন হল। অমিতাভ চৌধুরী বলেছেন,সারা বাংলাদেশে এটাই প্রথম অপেশাদারি ভিত্তিতে নৃত্য শিক্ষার প্রবর্তন।সে যুগে কোনো বিদ্যালয়ে ছাত্রদের নাচ শেখানো এক দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল।শান্তিদেব ঘোষ জানিয়েছেন, গুরুদেবের আগ্ৰহে নৃত্য চর্চার সূত্রপাত হলেও বিরূপ সমালোচনার আশঙ্কায় সেদিন বিদ্যালয়ের মাসিক মুখপত্র 'শান্তিনিকেতন'-এ ভিন্ন ভাবে খবরটি দেয়া হয়েছিল।নাচকে বলা হয়েছিল 'সাংগীতিক ব্যায়াম'।১৩২৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যার 'শান্তিনিকেতনে' প্রকাশিত সংবাদটিতে বলা হয়--'ত্রিপুরাধিপতি মহারাজ বাহাদুরের দরবার হইতে দুই জন কলাবিদ্ আশ্রমে আসিয়াছেন।আশ্রমের বালকেরা তাঁহাদিগের নিকট হইতে মৃদঙ্গ সহযোগে সাংগীতিক ব্যায়াম শিক্ষা করিতেছে।' কবির একান্ত চেষ্টায় সেদিন বাংলার মেয়েদের মধ্যে নৃত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটলেও তদানীন্তন সামাজিক পরিবেশের বিরুদ্ধে কিন্তু তাঁকে একরকম সংগ্ৰাম করতে হয়েছিল। সেই সূত্রে কবিকে অনেক বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ১২ই মাঘ তারিখের 'সঞ্জীবনী' লিখেছিল--'শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃদ্ধ হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার বিলাস বাসনা এখনও 'সবুজ' রহিয়াছে।শুনা যায়, তিনি বিশ্বভারতীতে নারীর নৃত্যের ক্লাস খুলিয়াছেন।... তিনি সরলচিত্ত সংসারানভিজ্ঞ বালিকাগণকে এ কি শিক্ষা দিতেছেন।'১৭ই ফাল্গুন 'সঞ্জীবনী' আরও লিখেছিল--'শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অল্প বয়স হইতেই নাটকের পক্ষপাতী। সেই সময় হইতে তিনি আপন গৃহে ,আপন আত্মীয়স্বজনের সম্মুখে নাটকের অভিনয় করিতেন।ক্রমে তাহার দ্বার উন্মুক্ত করিলেন এবং অবশেষে এখন যুবতীর নৃত্যে অর্থোপার্জন করিয়াছেন। ভবিষ্যতে অবস্হা আর কি ঘৃণিত হইবে কে জানে!'

যাইহোক, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় নৃত্য হয়ে উঠল সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম উপাদান। কবি তাঁর সৃষ্টিকর্মে গুরুত্বপূর্ণ স্হান দিলেন নৃত্যকে। একের পর এক নৃত্যনাট্য রচনা করতে থাকলেন তিনি। ত্রিপুরা থেকে শান্তিনিকেতনে আনা মণিপুরী নৃত্য শিক্ষকদের নৃত্য সংযোজনার কাজে লাগালেন কবি। বুদ্ধিমন্তের পর ঠাকুর নবকুমার সিংহ,নীলেশ্বর মুখার্জি,বসন্ত সিংহ, রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ প্রমুখ পুষ্ট করলেন শান্তিনিকেতনের মণিপুরী নৃত্য ধারাকে। অনুশীলন পর্বে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বসে বসে পর্যবেক্ষণ করতেন। ভুল শুধরে দিতেন। এমনকি নিজেও সঠিকটা করে দেখাতেন।প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যের প্রাধান্য থাকলেও পরবর্তী সময়ে অবশ্য অন্যান্য নৃত্যধারা নৃত্যচর্চাকে প্রভাবিত করে। নৃত্যনাট্য গুলোতে বিভিন্ন ধারার নৃত্যের সংমিশ্রণ ঘটে। এমনকি সংযোজিত হয় বিদেশি নৃত্যকলাও। রবীন্দ্রনাথের অদম্য উৎসাহ এতটাই ছিল যে, তিনি স্বয়ং নৃত্যনাট্য দল নিয়ে দেশবিদেশ সফর করেছেন। অনুশীলন পর্ব থেকে মঞ্চ রূপায়ন পর্যন্ত কবি তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন সব কিছু। এমনকি কবি তাঁর বিভিন্ন গানে নৃত্য সংযোজনার বিষয়ে সতর্ক নজর রাখতেন। পর্যালোচনা করতেন।মতামত দিতেন।সব মিলিয়ে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারা যেন হয়ে উঠেছিল আমাদের সংস্কৃতির ঐকতান।আর এক্ষেত্রে ত্রিপুরার সামান্য অংশ গ্ৰহণও যেন আজ আমাদের কাছে অসামান্য গর্বের সঙ্গে স্মরণযোগ্য ঘটনা!

ছবিঃ১৯৩৪ সালে শ্রীলঙ্কায় 'শাপমোচন' নৃত্যনাট্য দল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ। ত্রিপুরার নবকুমারও আছেন এই দলে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.