গল্প- এক অন্য নববর্ষ
লেখা- দেবারতি দত্ত
তিয়াসা আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ঘুম ভাঙতেই বাড়ির পাশের ক্লাব থেকে ভেসে আসছিল 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো'। ছোটবেলার সেই গান মায়ের গলায় কতবার যে শুনেছি তা সঠিক করে বলতে পারবেনা তিয়াস। স্মৃতির পাতায় লেখা রয়েছে কত কত ঘটনা, শুধুমাত্র এই দিনটাকে কেন্দ্র করে।
তিয়াসা নিজেকে বছর কুড়ির ফ্ল্যাশব্যাকে নিয়ে গেল। সেই ছোট্টবেলা থেকেই সে তার মাকে দেখেছে, ভোরে ঘুম থেকে উঠে, স্নান করে, ঠাকুর ঘরের সব কাজ শেষ করে, রান্না ঘরে যেতে। বাড়ির সবার পছন্দের পুরো দায়িত্ব ছিল মায়ের কাঁধে। হয়তো মায়েরা এমনটাই হয়। বাবা ঐদিনটায় খুব আড়ম্বর ঘুরে নববর্ষ পালন করত। বাজার হত জমিদারি কায়দায়। খুব সকাল সকাল বাজারের বড় একখানা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পরতো। বাজারের বাহারি রকমের মাছের উপর ছিল বাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বাজার শেষ করে যখন বাড়ি ফিরে আসত, তখন বড় ব্যাগের সাথে আরেকটা ব্যাগের সংযোজন ঘটতো। সবার পছন্দের আলাদা করে খেয়াল রাখতো বাবা। মায়ের বাজারের ধরন দেখে মাথায় হাত পড়তো। তারপরেও হাসিমুখে সবার জন্য, তাদের পছন্দের রান্না করে খাওয়াতে, কোনরকম বিরক্তি প্রকাশ করত না। একবার শুনে নিন বাবার বাজারের তালিকা। তালিকার শীর্ষে থাকতো ইলিশ মাছ, গলদা চিংড়ি, বড় কাতল মাছ, মাছের মুড়ো, পাঁঠার মাংস, পাট পাতা, কুমড়ো ফুল, গন্ধরাজ লেবু, দই ও মিষ্টি। বাবা ঘরে ঢুকেই জোরে ডাক দিত "কি গো বাজার নিয়ে এলাম তোমরা এসে দেখো কেমন হলো?"এটা বাবার প্রত্যেকদিনের অভ্যেসের তালিকায় পরতো। ওদিক থেকে মা ছুটে এসে, বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে, একে একে বাজার গুলো আলাদা করে করে গুছিয়ে রাখতে। আমাদের আবার একটা নিয়ম ছিল যাত্রা করাবার। বাবা বাজার থেকে যে বড় কাতল মাছটা আনতো, সেটা দিয়েই মা ঢোকার দরজার মুখে রেখে, তার গায়ে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে ধানদুব্বো দিয়ে যাত্রা করাতো। এটাই ছিল এই বাড়ির নিয়ম।
এবারও প্রতিবছরের মতো মা, বাবার বাজারের প্রশংসা করলেন। বাবা মুচকি হেসে বলতো "দেখলি তোর মা এখনো আমাকে কেমন ভালোবাসো।"মা-বাবার বৈবাহিক জীবন চল্লিশ পার হয়ে এক চল্লিশে পা দিল। কিন্তু আজও তাদের একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি বরং দিনে দিনে তা আরও বেড়েছে। মা এদিকে সব রান্না-বান্না শেষ করে, আমাকে ডেকে বলতো, "মামনি খাবারের টেবিল রেডি করো"।সবাই আমরা একসাথে খেতে বসতাম এই বিশেষ দিনগুলোতে। অন্যান্য দিনে যে যার মতো কাজে বেরিয়ে পড়ি। তাই একসাথে লাঞ্চ করাটা হয়ে উঠেনা। কিন্তু রাতের ডিনারটা আমরা একসাথে করার চেষ্টা করতাম।
টেবিলে বসে কত কথা, কত ঘটনা ভাগাভাগি করে নিতাম।
আজ তিয়াসার ফেলে আসা দিনগুলো খুব মনে পড়ছে। তিয়াসার বিয়ের প্রায় পাঁচ মাস কেটে গেল। কিন্তু এখনো ও বিশেষ দিনগুলোতে মা-বাবাকে বাড়ির, সবাইকে খুব মিস করে তিয়াসা। শ্বশুরবাড়িতে তার আদরের কোন খামতি নেই। বাড়ির ছোট বলে, সবাই তিয়াসার আবদারগুলো কে খুব যত্ন করে, পূরণ করার চেষ্টা করে। তাই আজও পয়লা বৈশাখে, তিয়াসা যেমনটা চেয়েছে ঠিক তেমনভাবেই আয়োজন করা হয়েছে। তিয়াসা সকালবেলা উঠেই স্নান সেরে ঠাকুর ঘরের আয়োজন করেছে। নিজের হাতে, ফুলের মালা গেঁথে ঠাকুর ঘর সাজিয়েছে। ঘরের প্রত্যেকটা কর্নার রজনীগন্ধার ছোঁয়ায় ভরিয়ে তুলেছে। হালকা রবীন্দ্র গানের সুরে অনুরণন পুরো ঘর জুড়ে। তিয়াসা যেনো তার ম্যাজিক দিয়ে বাড়ির পুরো পরিবেশটাই পাল্টে দিয়েছে। সবাই মিলে হৈ হুল্লোড় করতে করতে, কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে পড়েছে, খেয়ালই করেনি তিয়াসা। তার রোল মডেল ছিল তার মা। মায়ের শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করেছে।ছোটবেলা থেকেই সে দেখেছে, মায়ের যৌথ পরিবারে মানিয়ে চলা। তার অবদান, তার পরিবারের জন্য অফুরান ভালোবাসা ও কর্তব্য। তাই মায়ের আদর্শ পাথেয় করেই, তার আগামী পথচলা। হয়তোবা তাই শ্বশুরবাড়ীর সবাই তিয়াসাকে চোখে হারায়।
দুপুর বেলার মেনুতে রয়েছে সরষে ইলিশ ভাঁপা, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, পাঁঠার মাংস, আম ডাল, আমের চাটনি, শেষ পাতে দই ও মিষ্টি। রান্নাবান্না গুলো সবাই মিলেমিশে করেছিল। তিয়াসা অপলক দৃষ্টিতে দিচ্ছিল যে, মানুষ গুলো খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছিল। মনে মনে সে নিজেও তৃপ্ত। সন্ধ্যেবেলায় বসল জমজমাট ঘরোয়া সাংস্কৃতিক আসর। যে যেমন পারে নাচ, গান কবিতা টুকরো সবকিছুই ছিল এই বিনোদনের আসরে।
তিয়াসা প্রথমবারের মতো নাচ করেছিল এই বাড়িতে। সবার কাছে এটা যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এত ভালো যে সে নাচ করত, সেটা অধরাই ছিল তার শ্বশুরবাড়িতে। আজ ছোট ননদের অনুরোধটুকু সে কিছুতেই ফেলে দিতে পারল না। তাই লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটা হঠাৎই ডানা মেলে উড়ে গেল। সবাই তার নাচের ভূয়শী প্রশংসা করলো। তাও কেন জানিনা তিয়াসা ঠিক খুশি হতে পারছিলনা। তার মন শুধু একজনের কাছ থেকেই বারবার শুনতে চাইছিল "তিয়াসা তোমার লুকোনো প্রতিভার প্রেমে পড়ে গেলাম। এখন থেকে যখনই সময় পাবে, নাচের চর্চাটা চালিয়ে যাবে।" হঠাৎ তিয়াসার ঘোর ভাঙলো যখন আবির তাকে কাছে টেনে বললো "নিজের ইচ্ছেগুলোকে এমন ভাবে আটকে না রেখে তাকে শেকল মুক্ত করে উড়তে দাও। তোমার পাশে থেকে, আমিই না হয় তোমার অর্ধ সমাপ্ত কাজের রুপকার হব।" এই কথা বলে, খুব স্নেহ তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরল আবির। তাদের নতুন পথ চলার একমাত্র সাক্ষী ছিল রাতের নির্জনতা।