লঙ্কাকাণ্ড
পার্থ চক্রবর্তী
রামের ভারতে পেট্রোল ৯০ টাকা আর রাবনের লঙ্কায় ৫০। এমন রামরাজ্য চাই না। আমাদের রাবনরাজ্যই ভালো। তারপর বেশিদিন গড়ায় নি। আজকের পরিস্থিতি কি? কলম্বোর ওষুধের দোকানের তাক শূন্য। কোনও ওষুধ নেই। পেট্রোল পাম্প তেল শূন্য। গত এক মাসে তিন গুন বেড়েছে তেলের দাম। সারা দিনে ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ। রাতেও রাস্তায় আলো জ্বলে না। বিদ্যুতের অভাবে হাসপাতালে অপারেশন এবং চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ। কয়লার অভাবে প্রায় সমস্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। (নমুনাঃ চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়)। দেশের রাজকোশে পড়ে আছে ১৯১ কোটি ডলার। অন্যদিকে দেশটার বৈদেশিক ঋণ ৫১০০ কোটি ডলার। যার মধ্যে এই আর্থিক বছরে সুদ দিতে হবে ৭০০ কোটি ডলার। কলম্বো জানিয়ে দিয়েছে ঋণ পরিশোধে অক্ষম তারা।
এই অক্ষমতার পরিনতি ভয়ঙ্কর। চীনের মত দেশ যারা বিপুল পরিমান ঋণ দিয়েছে, তারা দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রন করবে। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিকাঠামো(বন্দর, বিমান বন্দর), এবং প্রাকৃতিক সম্পদ চলে যাবে ঋণদাতা রাষ্ট্রের হাতে। অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে যাবে, অর্থনৈতিকভাবে চীনের উপনিবেশে পরিনত হবে শ্রীলঙ্কা। দেশের এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন রাষ্ট্রপতি রাজাপাক্ষে, তাঁর ভাই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে পালাতে চান। কিন্তু বিমানবন্দর ঘিরে রেখেছে জনগন। দেশ ধ্বংসের নায়কদের কিছুতেই পালাতে দেবে না। সরকারী সেনার সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হচ্ছে দফায় দফায়। সরকারি দলের এক সাংসদ বিক্ষোভকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন। (উপরের তথ্যের সূত্র এই সময় পত্রিকা, কোলকাতা, ১০/৫/২২)।
কিভাবে এই অবস্থায় পৌঁছাল দেশটি। এক সময় মানব উন্নয়নের মাপকাঠিতে এশিয়ার প্রথম সারিতে ছিল দেশটি। রাজাপক্ষে সরকারের জনমোহিনী নীতি এবং বৈদেশিক ঋণের বোঝায় ডুবে গেল দেশটি। দুবাই বা হংকং এর সমতুল্য একটি শহর নির্মাণ করেছে দেশটি। নতুন এই ঝাঁ চকচকে সিটির নাম কলম্বো পোর্ট সিটি। এটি নির্মাণের জন্য চিনের থেকে লাগামছাড়া ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় সরকার। আসলে তা ছিল চিনের ফাঁদ। এরপর সরকার আর্থিক ঘাটতি মেটানোর জন্য সার্বভৌম বন্ড বিশ্ব বাজারে ছাড়ে। এর অর্থ হল দেশের সম্পদ বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া। যা শোধ করতে না পারলে দেশের সম্পদ বিদেশের অধিকারে চলে যাবে। এই সঙ্গে ২০১৯ এর নির্বাচনে রাজাপক্ষে ট্যাক্স ও ভ্যাট কমাবার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফলে জনগন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত করে রাজাপক্ষকে। প্রতিশ্রুতি মত ১৫% থেকে কমিয়ে ট্যাক্সের পরিমান করা হয় ৮%। রাজাপক্ষের জনপ্রিয়তা বাড়ে। জ্বালানির ওপর ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া হয়। এই সস্তা রাজনীতির মাধ্যমে সরকার থাকলেও দেশ পতনের মুখে পৌঁছে যায়। সরকারের আয় ২৫% হ্রাস পায়। আয়ের থেকে ব্যায়ের পরিমান বেড়ে যায়। অবশেষে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে পড়ে।(সুত্র... বি বি সি বাংলা নিউজ)।
এর সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটন শিল্পের বিপর্যয়, ভ্রান্ত কৃষি নীতি এবং সবচেয়ে বড় কারন রাজাপক্ষে পরিবারের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ। শুধুমাত্র নিজেদের পরিবারের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বেহিসাবি খরচ, লাগামছাড়া ঋণ, আয়ের থেকে বেশি ব্যয় এবং ট্যাক্স কমানো ও ভর্তুকি বাড়ানোর নীতি নিয়ে আজ দেশকে চরম সংকটে ফেলে দিয়েছেন। এতোদিন ফ্রিতে এবং সস্তায় সুবিধা পাওয়া জনগন আজ মরিয়া হয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।সারা দেশে আগুন জ্বলছে।কারফিউ জারি দেশ জুড়ে।জনদরদী সরকারের দরদ শেষ,জনপ্রিয়তা পরিণত হয়েছে জনরোষে। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেছে। নিজের সুবিধা বুঝতে গিয়ে দেশের স্বার্থের কথা ভাবে নি কেউ। আজ তার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি আমাদের কাছে একটা শিক্ষা। ফ্রিতে পাওয়া সুবিধা, ট্যাক্সে বিরাট ছাড় এবং ভর্তুকির অর্থনীতি যে শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় ডেকে আনে তার প্রকৃষ্ট উদাহরন এই লঙ্কা কাণ্ড। একই ভাবে লাতিন আমেরিকার দুই সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র কিউবা এবং ভেনেজুয়েলা জনমোহিনী অর্থনীতি গ্রহন করে, বিশ্বে আদর্শ রাষ্ট্র হবার ফল এখন ভোগ করছে তীব্র আর্থিক সংকটের মাধ্যমে। আমরা কি কিছু শিখলাম? দেশের বোঝা টানতে হয়, বোঝা বাড়াতে নেই। সবার আগে দেশ।