পূর্বোত্তরে অন্য রবীন্দ্রনাথ
পান্নালাল রায়
উত্তর পূর্বাঞ্চলের সম্পদ সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল। কবি তার সদ্ব্যবহারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন।ত্রিপুরার বাঁশ,প্রত্নসম্পদ, আসামের বয়ন শিল্প,মণিপুরী নৃত্য-পূর্বোত্তরের সম্ভাবনাময় এই সব বিষয়ে কবি খুবই আগ্ৰহী ছিলেন। আচার্য জগদীশচন্দ্রের গবেষণার জন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা থেকে বাঁশ চেয়ে পাঠিয়েছেন,বাংলার ঘরে ঘরে চালু করতে চেয়েছেন আসামের বয়ন শিল্প, আবার শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় মণিপুরী নৃত্য সংযোজনে তিনি ত্রিপুরা থেকে নিয়ে গেছেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক।
রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরা সফরে এসেছেন।শিলং সফর করেছেন তিনবার। এছাড়াও গৌহাটি, শ্রীহট্ট, কুমিল্লা সফর করেছেন তিনি। সেদিন এই সফরকালে উত্তর পূর্বাঞ্চল যেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ পেয়েছিল।পূর্বোত্তরের সংস্কৃতি সমৃদ্ধির প্রতি যেমন কবির দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল, তেমনই এখানকার সম্ভাবনা পূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি আমাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।
১৩১২ বঙ্গাব্দের (১৯০৫ খ্রীঃ) ২রা আষাঢ় রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষার জন্য ত্রিপুরার বাঁশ চেয়ে মহারাজা রাধাকিশোরকে লিখছেন-"... ত্রিপুরায় যে মূলীবাঁশ জন্মে-শিশু অবস্হায় তাহার বৃদ্ধি অতিশয় দ্রুত। এই গাছের চারা তাঁহার পরীক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক হইয়াছে।সদ্য অঙ্কুরিত মুলীবাঁশের চারা মহারাজ যদি সত্বর তাঁহার ঠিকানায় পাঠাইয়া দিতে আদেশ করিয়া দেন তবে তাঁহার বিশেষ উপকার হইবে।..."
শুধু বিজ্ঞান গবেষণা নয়,গৃহ নির্মাণের উপকরণ হিসেবেও যে ত্রিপুরার বাঁশ খুবই উপযোগী সেটাও জানা যায় কবির চিঠি থেকে।১৩১০ বঙ্গাব্দের ৭ফাল্গুন কবি রাজপুরুষ কর্ণেল মহিম ঠাকুরকে লিখছেন-..."আমাদের বোলপুর বিদ্যালয়ের একটা বড় ঘর তোমাদের দেশের মুলিবাঁশের দরমার দ্বারা ছাউনি করিতে চাই।খবর পাইলাম কুমিল্লা হইতে ছাইবার উপকরণ সস্তায় পাওয়া যায়।.... আমাদের হেড মাস্টারবাবু বলিতেছেন তোমাদের দেশের বাঁশের কাজ আমাদের প্রয়োজনের পক্ষে অতি সুন্দর ও স্হায়ী হইবে।..."
১৯১৯ সালের নভেম্বরে গৌহাটি সফরকালে অসমীয়া মেয়েরা তাদের হাতে বোনা এণ্ডি ও মুগার চাদর উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন কবিকে। এই হাতে বোনা তাঁতের কাপড় রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল। কবি এটা লক্ষ্য করেছিলেন যে, এই বয়নশিল্প আসামের সমাজ জীবনের অঙ্গ হয়ে পড়েছে। তিনি চেয়েছিলেন বঙ্গদেশেও এমনটা হোক। ঘরে ঘরে বয়নশিল্পের প্রসার ঘটুক। হয়তো গ্ৰামীন আর্থিক বিকাশে এই উদ্যোগ খুবই প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল কবির কাছে। এই উদ্দেশ্যে একজন অসমীয়া মহিলাকেও শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে মণিপুরী তাঁতও কবির সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আসামের তুলনায় তাঁর কাছে আরও ভালো মনে হয়েছিল মণিপুরী তাঁত। তিনি মণিপুরী নৃত্যের পাশাপাশি মণিপুরী শিল্পকর্ম শিক্ষারও প্রচলন করতে চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। সেসময়ে ত্রিপুরার মণিপুরী নৃত্যগুরু বুদ্ধিমন্ত সিংহ শান্তিনিকেতনে ছিলেন। মেয়েদের নৃত্যচর্চার পাশাপাশি মণিপুরী শিল্পকর্ম শেখাবার জন্য কবি বুদ্ধিমন্তের স্ত্রীকেও সেদিন শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কবি ত্রিপুরার তদানীন্তন মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোরকে লিখেছেন-"আমাদের মেয়েরাও নাচ ও মণিপুরী শিল্পকার্য্য শিখতে উৎসুক প্রকাশ করিতেছে। মহারাজা যদি বুদ্ধিমন্ত সিংহের স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবার আদেশ দেন তবে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে।..."
রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা থেকে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। আসামের তাঁত বাংলার ঘরে ঘরে চালু করতে চেয়েছিলেন। মণিপুরী নৃত্যের পাশাপাশি মণিপুরী বয়নশিল্পেরও প্রসার চেয়েছিলেন তিনি। এই ভাবে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সম্পদ সম্ভাবনার প্রতি কবি কত আগে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিলেন তা ভাবলে আজ বিস্মিত হতে হয়!অনগ্ৰসর এই অঞ্চলের সম্ভাবনাপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় কবিকে নাড়া দিয়েছিল সেদিন।
ত্রিপুরার প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের প্রতিও সেদিন কবির দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল।১৩৩২ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরায় কবির শেষ সফরকালে কিশোর মহারাজা বীরবিক্রমের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। তখন রাজার সঙ্গে আলোচনাকালে কবি ত্রিপুরার প্রাচীন মন্দির,প্রাসাদ সহ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ সংরক্ষণের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। এমনকি রাজমালা সম্পাদনা বিষয়েও সেদিন আলোচনা হয়েছিল তাদের মধ্যে। উল্লেখ করা যায় যে, বীরবিক্রমের উদ্যোগে পণ্ডিত কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় চার খন্ডে শ্রীরাজমালা প্রকাশিত হয়েছিল।
পূর্বোত্তরের বয়ন শিল্প কবিকে নাড়া দিয়েছিল। সেই সূত্রেই হয়তো জাগরিত হয়েছিল কবির নৃত্যচেতনা। সেটা ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দ। আগরতলা আসার আগে কবি তখন সিলেট সফরে। শহরের উপকণ্ঠে টিলাভূমির উপর এক সাহেবের বাংলো বাড়িতে কবি অবস্হান করছিলেন।বাড়ির দরজায় টানানো ছিল মণিপুরী তাঁতে তৈরি আচ্ছাদন বস্ত্র।এর মাধ্যমে কবি মণিপুরীদের শিল্প নৈপুণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরী পল্লী পরিদর্শনকালে মণিপুরী নৃত্যগীতে মুগ্ধ হন তিনি। এই সিলেট সফর শেষে আগরতলা আসেন কবি। আগরতলা থেকে মণিপুরী নৃত্যগুরু শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাবার প্রস্তাব রাখেন তিনি। সম্ভবতঃ এ ভাবেই শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় যুক্ত হয়েছিল মণিপুরী নৃত্য।খুলে গিয়েছিল এক সম্ভাবনার দুয়ার। কবি অবশ্য প্রথম আগরতলাতেই উপভোগ করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য।১৮৯৯ সালে মহারাজা রাধাকিশোরের আমন্ত্রণে কবি সেবার প্রথম এসেছিলেন আগরতলায়। কিন্তু এর প্রায় দুই দশক পর সিলেটের মাছিমপুরে দেখা মণিপুরী নৃত্যগীতই কবির নৃত্যচেতনা উসকে দিয়েছিল বলে মনে হয়।
পূর্বোত্তরের সংস্কৃতি সমৃদ্ধির প্রতি কবির দৃষ্টি আকর্ষণ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় সিলেটের জমিদার কবি হাছন রাজার কথাও। হাছন রাজার গান ও গানের দার্শনিক তত্ত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি।১৯২৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর কলকাতার সিনেট হলে ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের ১ম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ হাছন রাজার গানের অংশ বিশেষ উল্লেখ করে তাতে দর্শনের তত্ত্ব পাওয়ার কথা বলেছিলেন। ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ডের ম্যাঞ্চেষ্টার কলেজে অনুষ্ঠিত 'হিবার্ট লেকচারে'ও কবি উল্লেখ করেছিলেন হাছন রাজার প্রসঙ্গ। মূলতঃ রবীন্দ্রনাথের জন্যই হাছন রাজার গান দেশ বিদেশের রসিক জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সিলেটের এই জমিদার কবির গান নিয়ে ইউরোপে শুরু হয় গবেষণা।এপার- ওপার দুই বাংলায় হাছন রাজার গানের শ্রোতার সংখ্যাও দ্রুত বাড়তে থাকে। এই ভাবে পূর্বোত্তরের সম্ভাবনা পূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি কবি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।আর তাতে খুলে গেছে বন্ধ ঘরের অর্গল!