ইতিহাসের আলোকে রাধামোহন ঠাকুর এবং তাঁর পরিবার

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

রাজন্য আমলে ত্রিপুরি রাজপরিবার সম্ভূত ঠাকুর এবং কর্তা পরিবারগুলির মধ্যে আভিজাত্য, শিক্ষাদীক্ষা এবং কেতায় রাধামোহন ঠাকুর পরিবারের সমকক্ষ কেউ ছিল না। রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত আমার মা সবিতা দেববর্মণের দাদুর বাড়ি কর্নেল বাড়ীর কথা অবশ্য আলাদা। মা তাঁর আত্ম জৈবনিক গ্রন্থ "পাতার ভেলা ভাসাই নীরে" লিখেওছেন তাঁর ঠাকুরমা শশী মঞ্জরী কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্যা হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় একই তথ্য পাই প্রয়াত গবেষক কুমুদ কুণ্ডু চৌধুরীর লেখার মধ্যেও। মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের আমলে রাধামোহন ঠাকুর ছিলেন ত্রিপুরার বিচার বিভাগের প্রধান। পরে তিনি রাজকীয় সৈন্য বাহিনীরও প্রধান হন। ককবরক ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রণেতা হিসেবেও তিনি খ্যাত।

তাঁর ছেলে রেবতীমোহন দেববর্মা ছিলেন আমার বাবার (সলিল দেববর্মা) ঠাকুরদা। তিনি ছিলেন রাজন্য আমলের জবরদস্ত মন্ত্রী। যাতায়তের সুবিধার্থে রাজা তাঁর জন্য হাতির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মাহুত সহ হাতিটির স্থান হয়েছিল আমাদের বাড়িতেই। (সেই হাতির শেকল ১৯৯৩-৯৪ পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে ছিল ! পরে চুরি হয়ে যায়) রেবতীমোহনের স্ত্রী ছিলেন রাজকুমারী কুমুদিনী দেবী; মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের কন্যা। সম্পর্কের দিক থেকে বীরচন্দ্র মাণিক্য হন আমার দাদু। আমরা চন্দ্রবংশ। জ্ঞাতি, গোষ্ঠী, বংশ, গোত্র - এক বলে মূল রাজবাড়ীর সমস্ত বিয়ে শাদী শ্রাদ্ধ শান্তির অনুষ্ঠানে আমাদের পরিবারকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়।

বড়দের কাছে ত্রিপুরি রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঠাকুর এবং কর্তা পরিবারগুলির বিষয়ে কত কথাই শুনেছি। রাধামোহন ঠাকুরেরই আর এক ছেলে ললিত ঠাকুর ছাত্রাবস্থায় ছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের ক্লাসমেট। রাজন্য ত্রিপুরার ভারত অন্তর্ভুক্তির পর তিনি আমাদের ত্রিপুরি সম্প্রদায়কে সংবিধানের তপশিলী জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ললিত ঠাকুরের আপন অগ্রজ সহোদর প্যারীমোহন ঠাকুর ছিলেন প্রতিভাবান ব্যক্তি। বাংলার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় কিউরেটর। গবেষণামূলক তাঁর অমূল্য কিছু লেখা রয়েছে ওই সময়ে প্রকাশিত জার্নালে। দীর্ঘদিন শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে তাঁর স্ট্যাচু ছিল।

সমাজ জীবনে আমাদের পরিবারের এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা কম বেশি সবাই জানেন। তবে সংগত কারণেই এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পরিবারের সেই রমরমা ভাব আর নেই। যৌথ পরিবার দ্বি-খণ্ডিত হওয়ার পর জমিজমাও সবই বিক্রিবাট্টা করে দেওয়া হয়েছিল। জমি ছিল তৎকালীন রাজন্য ত্রিপুরার অংশ কুমিল্লার পাহাড়পুরেও। দেশভাগের পর তার পুনরুদ্ধার আর সম্ভব হয় নি। তবে বছর চল্লিশ আগেও এই পরিবারের ঔজ্জ্বলের কিছু আভাস পেয়েছিলাম একবার যখন মা'র সঙ্গে জিরানিয়া সহ সংলগ্ন গাঁয়ে গিয়েছিলাম। সেবার এক অশীতিপর বৃদ্ধ এসে মা'র হাতদুটি ধরে খুব খুশি হয়ে কাঁপা গলায় বলেছিলেন, "আমরা তোমাদের জমিদারীরই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম!"

সময়ের সঙ্গে তো কত কিছুই হারিয়ে যায় এবং গেছেও। রাজন্য আমলের বহু দলিল দস্তাবেজ হারিয়ে গিয়েছে। নষ্ট হয়েছে অনেক বইপত্তর। অনেকে অনেক জিনিস চেয়ে নিয়ে পরে ফেরত দেন নি আর। ১৯৬০-৬১'এ ত্রিপুরা সফরে এসেছিলেন কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়। তিনি লোকমুখে শুনেছিলেন আমাদের বাড়ির ঐতিহ্যের কথা। লালু কর্তার (ব্রজেন্দ্র কিশোর দেববর্মা) স্ত্রী নাকি শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায়কে এই তথ্য জানিয়েছিলেন। আমাদের বাড়িতে এসে পরম কৌতূহলে খুঁটিয়ে দেখেছিলেন রাজন্য আমলের বিভিন্ন জিনিস । পরে ফেরত দেবেন বলে কয়েকখানি রিসা চেয়ে নিয়েছিলেন। তিনটি রেখে দিয়ে বাকিগুলি ফেরত দিয়েছিলেন ।

আমাদের বাড়িঘর ভাঙ্গাভাঙ্গির ফলেও ধ্বস্ত হয়েছে রাজন্য আমলের প্রচুর জিনিস। প্রপিতামহী কুমুদিনী দেবীর ব্ল্যাক মরিস'এর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল শুধু গাড়ির পেছনের কাঁচখানি। সেই কাঁচকে বাবা পরে টি টেবিলের কভার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এমন সব লণ্ডভণ্ডেরও পরেও আজও কিন্তু রয়ে গিয়েছে কিছু অ্যান্টিকস। সোনা এবং রুপোর সুতো দিয়ে বানানো রাজকুমারীদের হাতে তৈরি রিসা রয়েছে মাত্র কয়েকখানা। রয়েছে হাতির দাঁত দিয়ে বানানো ষোল ঘুঁটি (একটি চুরি হয়ে যাওয়াতে এখন রয়েছে ১৫টি )। রয়েছে এমন আরও কয়েকটি অ্যান্টিকস। বাবা সযত্নে রেখে দিয়েছেন আমার প্রপিতামহী অর্থাৎ রাজকুমারী কুমুদিনী দেবীকে স্বহস্তে লেখা মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের বেশ কয়েকটি চিঠি।

ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী রাজন্য আমলের এইসব অমূল্য সম্পদ বাড়িতে নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখবো কিনা - সে বিষয়ে আমরা এখন চিন্তাভাবনা করছি। আমার অনুজ সৈকত'এর অভিমত, " রাজন্য স্মৃতি বিজড়িত জিনিসগুলি বাবা মা'র নামে আগরতলা মিউজিয়ামে দেওয়াই বিধেয়।" সৈকতের কথায় যৌক্তিকতা আছে অবশ্যই। আমিও সেই কথাই ভাবছি।

আমার শুধু একটাই শঙ্কা, প্রত্নশালায় এসব দিয়ে দিলে বাকি জিনিসের ভিড়ে হারিয়ে যাবে না তো ! মা'র মুখে শুনেছি মহারাণী প্রভাবতী দেবী (মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের স্ত্রী) নাকি একবার গাড়িতে চড়ে আমাদের বাড়িতে স্বল্প কিছুক্ষণের জন্য এসেছিলেন। তিনি এসেছিলেন আমাদের গৃহ মন্দির থেকে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি নিতে। উদ্দেশ্য ছিল সেই মূর্তি রাখবেন লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে। ... আমি আজও যখন লক্ষীনারায়ণ মন্দিরে যাই -মন্দিরের গর্ভগৃহে রাখা ছোটবড় অসংখ্য মূর্তির মধ্যে আমাদের বাড়ি থেকে তুলে আনা রাধাকৃষ্ণের মূর্তিটিকে খুঁজি। জানি লক্ষীনারায়ণ মন্দিরে আমাদের বাড়ির দেবমূর্তি আছে । কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে সেই মূর্তিকে এখন শনাক্ত করা দুঃসাধ্য !


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.