।। জীবনের নকশা ।।

অরিন্দম নাথ

(১) অভিরূপবাবু ছিলেন এক রাজনীতিবিদ । আমার এক প্রিয় ব‍্যক্তিত্ব । তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় অন্য ভাবে । কবি সুকান্তের বই পড়ে । তিনি ছিলেন অকৃতদার । দীর্ঘজীবি । যেন পিতামহ ভীষ্ম । তবে ভীষ্মের রূপ ছিল না । অরূপ । সাদা ধুতি । হাতকাটা সাদা পাঞ্জাবী পরতেন । সঙ্গে ক‍্যাম্বিশের জুতো । কালো ফ্রেমের চশমা । অ্যা ব‍্যাচেলর লিভস্ লাইকে লায়ন, ডাইস লাইক অ্যা ডগ । তাঁর প্রসঙ্গ এলে এই আপ্তবাক‍্য বলতাম । অবশ্য আড়ালে আবঢালে । তাঁর নৈতিকতাবোধ ছিল উচ্চমার্গের । রসিকতা করা থেকে পিছিয়ে আসতাম । মৃত্যু এক অমোঘ সত্য । অনেকেই আশা করেন তাঁর মৃত্যু হবে ভাদ্রমাসের তালের মত । ম‍্যাচিউরড্ হয়ে হঠাৎ খসে পড়বে ।

(২) বাস্তবে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো ছিল রোগভোগের । খুবই কষ্টের । পাঁচ-ছটি প্রাণী তাঁকে সঙ্গ দিত । এরমধ্যে ছিল দুটো শালিক । একসঙ্গে প্রাতরাশ করতো । দুজন বয়স্ক কনস্টেবল । বাসব ও ভূপেন্দ্র । তাঁকে নিজেদের বাবার চেয়ে বেশি ভালোবাসত । কন‍্যাসমা রেবা । জনজাতি মহিলা । তিনি তাঁকে মা ডাকতেন । মহিলা ছোট্ট একটি চাকুরী করতেন । দুপুরে দুজনে একপাতে খেতেন । অভিরূপবাবু তখন দ্বিতীয় শৈশবে । গান্ধীজীর ভাষায় সেকেন্ড এন্ড পিটিয়েবল্ চাইল্ডহুড । রেবা ম‍্যাডাম তাঁকে ছোট ছেলের মত শাসন করতেন । একজন নার্স । নাতনিসমা সেঁউতি । রাজনৈতিকভাবে বিপরীতমেরুর পরিবারের । ভীষণই সুন্দরী । তার উপস্থিতি দেশী গোলাপের সুবাস নিয়ে আসত । সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক ভেদাভেদ মিলিয়ে যায় । তিনি তাকে বিবাহিত দেখতে চাইতেন । তার বিয়ের জন্য অগ্রিম বেনারসি শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন । মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বায়না করলেন সেঁউতিকে বিয়ের সাজে দেখবেন । মেয়েটি তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেছিল । অবশ্য বাষ্পায়িত নয়নে ।

(৩) সেঁউতি এখন বিবাহিত । একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মা । ওরা এখন কৈশোরে । স্বামী সায়ান । প্রতিষ্ঠিত ব‍্যবসায়ী । ভীষণই হাশিখুশি ছেলে । সেঁউতি আসলে নার্স ছিল না । উচ্চ-শিক্ষিতা । ধাত্রীবিদ‍্যা অল্পস্বল্প জানত । সে ছিল মূলত হাউসকিপার । একজন ডিভোর্সি । কলেজে পড়ার সময় প্রথম বছরেই তার বিয়ে হয় । পালিয়ে গিয়ে বিয়ে । শ্বশুর এক আধাসামরিক বাহিনীর অফিসার । সরকারি বেতন কখনও ব‍্যাংক থেকে ওঠাতেন না । প্রচুর অর্থের মালিক । আবার সেই পরিমাণই অর্থ ও যশের লোভী । তাই গরীব পরিবারের মেয়েকে যখন একমাত্র ছেলে রমিত বিয়ে করে নিয়ে এল খুশি হলেন না । তবে বৌয়ের রূপ দেখে আহ্লাদিত হলেন । বৌমা শ্বশুর বাড়ি থেকেই কলেজ করে । স্নাতক হয় । রমিতের রূপ ছিল । গুণ ছিল না । ভদ্রলোক রমিতকে পেস্টিসাইডের এজেন্সি নিয়ে দিয়েছিলেন । কিন্তু বদসঙ্গে ব‍্যবসা পটলে ওঠে । সে সবসময় মাতাল হয়ে আসত । শ্বশুর বাড়িতে থাকলে সন্ধ্যার পর রোজ ড্রিংকস নিয়ে বসতেন । রমিতের মা আর্থরাইটিসের রুগী । প্রায়ই তার নজর পড়ত সেঁউতির উপর । শ্বশুরের পয়সায় সংসার চলে । সারাক্ষণ এই খোঁটা চলত । একসময় মানসিক নিগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক নিগ্রহও শুরু হল । সেঁউতি তার প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক পিতার কাছে ফিরে এল । রমিতের পরিবার সেঁউতির মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলল । পয়সা কথা বলল । রমিতের উকিল খুব সহজেই ডিভোর্স আদায় করে নেয় ।

(৪) একবছর পর সেঁউতি স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয় । রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ ক্লাসে । তখন মাসখানেকের ক্লাস হয়ে গেছে । একটু প্রসঙ্গান্তরে যাচ্ছি । হুমায়ুন আহমেদ মানুষের প্রেমে পড়ার এক অদ্ভুত ব‍্যাখ‍্যা দিয়েছেন । প্রতিটি মানুষ প্রকৃতির সৃষ্টি ৷ আলাদা করে একটি নকশা অনুসারে ৷ এই নকশার একটি অংশে থাকে নারী ৷ অপর অংশে পুরুষ ৷ দুইয়ের মিলে অপূর্ব সুন্দর ডিজাইন । খুবই জটিল ৷ কিন্ত ভীষণ রকম সুন্দর ৷ তারপর, প্রকৃতি সেই ডিজাইনকে কেটে দু ভাগ করে দেন ৷ একটি ভাগ দেন এক তরুণ বা পুরুষকে ৷ অন্যটি কোন তরুণী বা নারীকে ৷ তারপর ছেলেটি ব্যাকুল হয়ে নকশার অন্য অংশ খুঁজে বেড়ায় ৷ মেয়েটিও তাই করে ৷ কেউ যখন তার ডিজাইনের কাছাকাছি কিছু দেখে তখনই সে প্রেমে পড়ে ৷ তারপর দেখে ডিজাইনটি ভুল ৷ হুবহু সঠিক নয় ৷ তার জীবনে নেমে আসে কিছুটা হলেও হতাশা ৷ প্রকৃতি এই কাজ ইচ্ছে করেই করেন ৷ মূল ডিজাইনের কাছাকাছি কিছু দেখিয়ে আবার সরিয়ে নেন ৷ তিনি চান না মানুষেরা সার্থক হোক ৷ নারী-পুরুষ মিলে মূল ডিজাইনটি তৈরি করুক ৷ এই না চাওয়ার কারণ আছে ৷ মূল ডিজাইনটি দেখে ফেলা মানেই পরম সৌন্দর্যের মুখোমুখি হওয়া । প্রকৃতি মানুষকে তা দিতে রাজি নন ৷ তার ধারণা পরম সৌন্দর্য দেখতে মানুষ এখনও প্রস্তুত হয়নি ৷

সেঁউতি সহপাঠী সৌরিকের মধ‍্যে নকশা খুঁজে পায় । সে ছিল রাজ‍্যের এক প্রান্তিক শহরের ছেলে । একটি সরকারি দপ্তরে চাকুরী করতো । স্টাডি-লিভ নিয়ে পড়তে এসেছিল । বয়সে সেঁউতি থেকে কিছুটা বড় । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিকনিকে গিয়ে দুজনের কাছে আসা । নকশা বিনিময় ঘটে এক দেবীর মন্দিরে । তারপর তাদের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়া চলে । সহপাঠীরা নিশ্চিত ছিল এই প্রেম পূর্ণতা পাবে । কিন্তু একটি ঘটনায় সৌরিক নকশা হারিয়ে ফেলে ।

সৌরিক ছিল মা-বাবার একমাত্র সন্তান । ওর বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন । তখন তার মা অসুস্থ । ক‍্যান্সারের রুগী । জিবি হাসপাতালের ক‍্যান্সার ওয়ার্ডে ভর্তি । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি মার শুশ্রূষা করে । রাত্রিতে মাকে দেখার জন্য একজন স্পেশাল নার্স রেখে দিয়েছে । রাহী সুন্দরী । অন্যের নিভে যাওয়া জীবনে দীপ জ্বালানোই নার্সের কাজ । রাহী সেই চেষ্টাই করতো । এরমধ্যে কোনও ফাকি ছিল না । দিনের পর দিন রাহীর সেবা পেয়ে ভদ্রমহিলা তার মধ্যে নিজের পুত্রবধূকে দেখলেন । সেঁউতি ডিভোর্সি । এইকথা ভেবে সৌরিক মায়ের কাছে সেঁউতিকে তখনও নিয়ে আসেনি । একটু ইতস্ততঃ করছিল । এমনি সময়ে ঘটনাটি ঘটলো । সচরাচর সিনেমাতেই আমরা এই সীন দেখে থাকি । এক সন্ধ্যায় ভদ্রমহিলা সৌরিক এবং রাহীর দুই হাত মিলিয়ে দিলেন । শুধু তাই নয়, নিজের গলার সোনার হার খুলে নিয়ে মল‍্যবদল করালেন । ঘটনার আকষ্মিকতায় সৌরিক হতচকিত হয়ে গিয়েছিল । কোনও প্রতিবাদ করতে পারেনি । মায়ের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সারারাত সে জিবি হাসপাতালের বারান্দায় কাটায় । নিদ্রাহীন । ভোররাতে ঠিক করে ভবিতব‍্যকে মেনে নেবে । সে সেঁউতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে । কেউ কারণ বুঝতে পারে না । এমনকি সেঁউতিও বুঝতে পারে না । তখন ফাইনাল পরীক্ষারও বেশিদিন বাকি ছিল না । একসময় পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীরা যে যার বাড়িতে চলে যায় । সৌরিক রাহীকে বিয়ে করে । কিছুদিনের মধ‍্যে তার মা মারা যান । সে এখন সুখী । দুই মেয়ে সঞ্চারী ও সায়রী এবং স্ত্রী রাহীকে নিয়ে তার সংসার । মেয়েদের একজন ডাক্তারী পড়ছে । অন‍্যজন এবার দ্বাদশ দিচ্ছে । সেও আগের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছে । রাহী এখন মেট্রন ।

(৫) এই সত্য হয়তো গোপনই থাকত । কয়েকবছর হল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা একটি ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছে । সৌরিক প্রথম থেকেই ছিল । সেঁউতি সম্প্রতি যোগ দিয়েছে ।ইদানিং তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পঁচিশ বছর পূর্তি হয়েছে । সেই উপলক্ষে সবাই মিলে পিকনিকে গিয়েছিল । সেই ধর্মস্থানেও যেতেও ভুল করেনি । সেঁউতি ও সৌরিকও গিয়েছিল । পঁচিশ বছর পর । মুর্তির সামনাসামনি এসে দুজনের নকশার কথা মনে হয় । তখন দুজনেই স্ট‍্যাচুবৎ হয়ে যায় । অন্য সহপাঠীরা কিছু একটা আচ করে । তাদেরই একজন রিয়াংকা সৌরিককে উদ্ধার করে । তার কাছে সৌরিক কাঁদতে কাঁদতে নিজের জীবনের কাহিনি ব‍্যক্ত করে । নিজেকে তার হালকা মনে হয় । আর সেঁউতি! সেও একসময় বন্ধুদের মুখে সৌরিকের বাস্তবতা জানতে পারে । সে ভাবে জীবন আসলে নদীর মত । তাকে তার আপন গতিতে চলতে দেওয়া উচিত ।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.