ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের বাংলার পৃষ্ঠপোষকতা
পান্নালাল রায়
ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাগণ বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। রাজা এবং রাজ পরিবারের লোকেরা নিজেরাও সাহিত্য চর্চা করেছেন। রাজসভার কাজে ব্যবহার করেছেন বাংলা। এমনকি আধুনিক যুগেও রাজকার্যে যাতে বাংলার ব্যবহার ব্যাহত না হয় সেজন্য রাজা সতর্ক নজর রেখেছেন। পঞ্চদশ শতকে রত্ন মাণিক্যের সময় থেকেই ত্রিপুরার রাজকার্যে পার্সি ও বাংলার প্রভাব পড়তে থাকে। পঞ্চদশ শতকে মহারাজা ধর্ম মাণিক্য রাজমালা রচনা করান।এই রাজমালাকে বাংলা কাব্যের প্রাচীন নিদর্শন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ত্রিপুরার মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন ধন্য মাণিক্য (১৪৯০-১৫২৯ খ্রীঃ)। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে বেশ কিছু ধর্মগ্ৰন্হ বাংলাতে অনূদিত হয়েছিল।এর মধ্যে রয়েছে 'উৎকল খন্ড পাঁচালী' , 'যাত্রা রত্নাকরনিধি' এবং 'প্রেত চতুর্দশীর গীত'। ত্রিপুরায় সঙ্গীতচর্চার প্রসারে ধন্য মাণিক্য মিথিলা থেকে রাজ্যে কয়েকজন সংগীতজ্ঞ এনেছিলেন।
ত্রিপুরার ইতিহাসে নানা কারণে উজ্জ্বল হয়ে আছেন গোবিন্দ মাণিক্য। ত্রিপুরায় আবহমানকাল থেকে চলে আসা নরবলি প্রথা তিনিই রদ করেছিলেন।১৬৬০ থেকে ১৬৭৩ খ্রীঃ পর্যন্ত দু'দফায় রাজত্ব করেছিলেন তিনি। গোবিন্দ মাণিক্য সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলাতে অনুবাদ করিয়েছিলেন 'বৃহন্নারদীয় পুরাণ'। শুধু গ্ৰন্হ রচনাই নয়, তা যাতে সাধারণ্যে প্রচরিত হয় সেজন্য রাজা গ্ৰন্হটির বেশ কিছু প্রতিলিপিও করিয়েছিলেন।
উল্লেখ করা যায় যে, তখন মুদ্রণযন্ত্র ছিল না, পাঠকদের চাহিদা মেটানোর একমাত্র অবলম্বন ছিল হাতে লেখা পুঁথি।
দ্বিতীয় ধর্ম মাণিক্যও(১৭১৪-২৯খ্রীঃ) সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় মহাভারতের পদ্যানুবাদ করিয়েছিলেন।জগৎ মাণিক্যও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলা কাব্যে অনুবাদ করিয়েছিলেন পদ্মপুরাণের অন্তর্গত 'ক্রিয়াযোগসার'।গ্ৰন্হটি রচিত হয়েছিল ১৭২৬ খ্রীষ্টাব্দে।জগৎ মাণিক্য এই পুঁথির নকল প্রজাদের ঘরে ঘরে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন।
এবার আসা যাক বীরচন্দ্র মাণিক্যের(১৮৬২-৯৬খ্রীঃ)কথায়। ত্রিপুরার এই রাজাই প্রথম কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।কবির 'ভগ্ন হৃদয়' কাব্য গ্ৰন্হ পাঠ করে রাজা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক ভুবনজয়ী সম্ভাবনা লক্ষ্য করেছিলেন। তারপরই কিশোর কবিকে সম্বর্ধনা জানাতে রাজা তাঁর সচিবকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায়।এই ভাবেই ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের।চার জন মাণিক্য রাজার রাজত্বকালের দীর্ঘ সময় ব্যাপী অটুট ছিল এই সম্পর্ক।বীরচন্দ্র সাহিত্য-সংস্কৃতির একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি রাজপরিবারের সদস্যদের সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন। রাজা নিজেও ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি। তাঁর রচিত ছয়টি কাব্যগ্ৰন্হের কথা জানা যায়। তিনি শ্রীমদ্ভাগবত গ্ৰন্হ প্রকাশনার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেনের 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' গ্ৰন্হটি প্রকাশেও মহারাজা অর্থ সাহায্য করেছিলেন।বীরচন্দ্রের পর সিংহাসনে বসেন রাধাকিশোর মাণিক্য (১৮৯৬-১৯০৯খ্রীঃ)। পিতার মতো তিনিও ছিলেন গভীর সাহিত্যানুরাগী, পৃষ্ঠপোষক। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।রাধাকিশোরের পৃষ্ঠপোষকতায় পণ্ডিত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ প্রকাশ করেছিলেন 'শিলালিপি সংগ্ৰহ' । বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু সহ বাংলার তদানীন্তন অনেক সাহিত্য সেবীকে রাজা আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দীনেশচন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।রাধা কিশোরের আমলে সরকারি মুখপাত্র রূপে প্রকাশিত হয় ' ত্রিপুরা স্টেট গেজেট '। গোবিন্দ মাণিক্যের আদেশে রচিত 'বৃহন্নারদীয় পুরাণ' পুঁথিটি রাধাকিশোরের পৃষ্ঠপোষকতায় মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়।
পূর্ব পুরুষদের মতো মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যও(১৯০৯-২০খ্রীঃ) শিল্প-সংস্কৃতির পূজারী ছিলেন। বৈষ্ণব সাহিত্যের কিছু দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি পুনরায় সম্পাদনা করে প্রকাশের জন্য রাজা কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি 'রাজমালা' পুনরায় সম্পাদনা করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বীরেন্দ্র কিশোর একজন গুণী চিত্রকর এবং গীতিকার ছিলেন। রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক বেশ কিছু সংগীত তিনি রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।
পূর্বতন রাজাদের মতো বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যও (১৯২৩-৪৭ খ্রীঃ) সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই প্রকাশিত হয় 'শ্রীরাজমালা'। তিনি পৃথক ভাবে 'রাজমালা' সংক্রান্ত গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যালয় স্হাপন করেছিলেন।'রবি' সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশেও রাজা পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বীরবিক্রম একজন কবি ও নাট্যকার ছিলেন। অবশ্য তাঁর সাহিত্য বিষয়ক তৎপরতা মূলতঃ রাজপরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি হোলি বিষয়ক একটি সংগীত গ্ৰন্হ রচনা করেছিলেন।১৯৪১ সালে তা প্রকাশিত হয়। বীরবিক্রম রবীন্দ্রনাথকে 'ভারতভাস্কর' উপাধি দিয়েছিলেন।
'রাজমালা' এবং রাজসভার উদ্যোগে পুরাণ গ্ৰন্হের অনুবাদ ছাড়াও কয়েকটি ইতিহাসাশ্রিত বাংলা কাব্য রচিত হয়েছিল রাজন্য ত্রিপুরায়। এরমধ্যে রয়েছে 'কৃষ্ণমালা' ,'চম্পকবিজয়','শ্রেণীমালা',
'গাজিনামা'। এইসব কাব্যে ঐতিহাসিক উপাদান থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকদের গুণকীর্তন প্রাধান্য পেয়েছে। তবে 'গাজিনামা' এর ব্যতিক্রম।এই কাব্যের কোনো রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না।সমসের গাজির জীবন ও বীরত্ব নিয়ে পরবর্তী সময়ে তাঁর এক গুণমুগ্ধ গ্ৰাম্য কবি শেখ মনোহর এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন।
মহারাজা কৃষ্ণমাণিক্যের(১৭৬০-৮৩ খ্রীঃ) সংঘাতপূর্ণ জীবন ও বীরত্বের কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছিল 'কৃষ্ণমালা'।কৃষ্ণমাণিক্যের পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজধর মাণিক্য (২য়) সিংহাসনে বসেন। তিনি জয়ন্ত চন্তাই'র মুখে কৃষ্ণমাণিক্যের বীরত্বের কাহিনি শুনে সেসব লিপিবদ্ধ করার জন্য উৎসাহী হয়ে রামগঙ্গা শর্মা নামে একজন ব্রাক্ষ্মণকে কাব্য রচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন।রাজধর মাণিক্যের রাজত্বকাল হলো ১৭৮৫-১৮০৬ খ্রীঃ।তাতে ধারনা করা হয় 'কৃষ্ণমালা' অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের রচনা।
মহারাজা দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্যের রাজত্বকালে (১৬৮৫-১৭১২খ্রীঃ) রচিত হয়েছিল 'চম্পকবিজয়'। রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত না হলেও রাজার গুণকীর্তন সহ ত্রিপুরার রাজবংশের প্রতি আনুগত্যের ছাপ প্রবল ভাবে উপস্হিত কাব্যে।
রাজ আমলে রচিত অপর একটি কাব্যগ্ৰন্হ হলো 'শ্রেণীমালা'। কাশীচন্দ্র মাণিক্যের রাজত্বকালে (১৮২৬-২৯) এটি রচিত হয়েছিল। রচনা করেছিলেন দুর্গামণি উজির।চারখন্ডে বিভক্ত এই গ্ৰন্হে ত্রিপুরার রাজবংশের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ত্রিপুরার ইতিহাসের এক বর্ণাঢ্য চরিত্র সমসের গাজির বীরত্ব, সাধারণ প্রজা থেকে তাঁর ত্রিপুরার সিংহাসন লাভ ইত্যাদি নিয়ে রচিত হয়েছিল 'গাজিনামা'।সেখ মনোহর নামে এক গ্ৰাম্য কবির স্বতঃপ্রণোদিত সৃষ্টি হচ্ছে 'গাজিনামা'।
ত্রিপুরার রাজা এবং রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যেও সাহিত্য চর্চার ধারা ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২-৯৬) ছিলেন সে যুগের একজন সুবিখ্যাত বৈষ্ণব কবি। তাঁর পরবর্তী রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যরা কাব্য চর্চা করেছেন।বীরচন্দ্রের পুত্র সমরেন্দ্র চন্দ্র যেমন ছিলেন সেযুগের এক জন বিখ্যাত গদ্য লেখক, তেমনই কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী ছিলেন সুখ্যাত কবি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও অনঙ্গমোহিনীর কাব্যের প্রশংসা করেছেন।
মহারাজা বীরচন্দ্র রচিত ছয়টি কাব্যগ্ৰন্হের কথা জানা যায়।গ্ৰন্হসমূহ হচ্ছে 'হোরি','ঝুলন গীতি', ' প্রেম মরীচিকা', 'উচ্ছ্বাস', 'অকাল কুসুম', এবং 'সোহাগ'।বীরচন্দ্রের কাব্য সমূহ সেদিন পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বৈষ্ণব ভাবাপন্ন এই কবি রাজার অধিকাংশ কবিতাই ছিল বৈষ্ণব রসে সিক্ত। মহারাজা রাধাকিশোরের পত্নী তুলসীবতী মুখে মুখে সংগীত রচনা করতে পারতেন।রাধাকিশোরের পুত্র পরবর্তী রাজা বীরেন্দ্র কিশোর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক বেশ কিছু সংগীত রচনা করেছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক পরবর্তী রাজা বীরবিক্রমও হোলি বিষয়ক সংগীত গ্ৰন্হ রচনা করেছিলেন।
কাব্য সাহিত্যের মতো গদ্য সাহিত্যেও ত্রিপুরার রাজপরিবারের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। মহারাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের(১৮৪৯-৬২)পুত্র নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মার 'আবর্জ্জনার ঝুড়ি' বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য গদ্য সাহিত্যের নিদর্শন হয়ে আছে।বীরচন্দ্র মাণিক্যের পুত্রের বড় ঠাকুর ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত লেখক। তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্ৰন্হে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের নানা উপকরণ ছড়িয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে 'আগ্ৰার চিঠি','ভারতীয় স্মৃতি','ত্রিপুরার স্মৃতি','জেবুন্নিসা বেগম' ।
মহারাজা বীরবিক্রমের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কালীপ্রসন্ন সেনগুপ্ত সম্পাদিত ' পঞ্চমাণিক্য'। ত্রিপুরার পাঁচ জন রাজার কীর্তি ও জীবন কাহিনী রয়েছে এতে।রাজ আমলের অপর এক বিখ্যাত লেখক হলেন কর্ণেল ঠাকুর মহিম চন্দ্র দেববর্মা। তিনি ছিলেন বীরচন্দ্রের এডিকং। রাধাকিশোরের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বেশ কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এইসব প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয় 'দেশীয় রাজ্য' গ্ৰন্হ। মহারাজা বীরবিক্রমের সোনামুড়া ও উদয়পুর বিভাগ ভ্রমণের ডায়েরীতে রয়েছে তাঁর গদ্যের নিদর্শন।
এবার আসা যাক কৈলাসচন্দ্র সিংহের 'রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্ৰন্হের কথায়।রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতা নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে রচিত এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। সুপ্রাচীন কাল থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ত্রিপুরার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন ছড়িয়ে আছে গ্ৰন্হটিতে, তেমনই সেই আমলের বাংলা গদ্য সাহিত্যেরও এক সেরা নিদর্শন এটি।
ত্রিপুরার রাজ কার্যে যেমন বাংলা ব্যবহৃত হতো, তে