প্রদ্যুৎরাজের খামখেয়ালি
রাজীব দত্ত
সত্যজিৎ রায়ের একটা গান খুব প্রসিদ্ধ, ‘মহারাজা…!! তোমারে সেলাম… সেলাম… মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম…’। ছবিটার নাম গুপি গায়েন বাঘা বায়েন। এই আর্টিকেলটা পড়ার আগে আমি আমাদের রাজ্যের মহারাজা প্রদ্যুত কিশোর মাণিক্য বাহাদূর কে (মথা প্রধানকে নয়) বলবো, একবার এই গানটা শুনুন। শুনেছি আপনি সঙ্গীত প্রিয় মানুষ। রক , জ্যাজ আপনি খুব শোনেন। আপনার রক্তেও সঙ্গীত রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এরপর ‘গোমতী নদী’ আর ‘ত্রিপুরা’ বা ‘তিপ্রাসা’ ভাগ হবেনা। কোনও কিছুর বিনিময়ে নয়। বাইশ হাজার চাকরীর বিনিময়ে নয়, এডিসির বিনিময়ে নয়, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারের বিনিময়ে নয়, ২০২৩ বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নেও নয়। প্রদ্যুত কিশোর যথেষ্ট শিক্ষিত, এবং মেধাবী, সৎ এবং ধর্মনিরপেক্ষ একজন মানুষ। একজন সাধারণ ত্রিপুরাবাসী হিসেবে আমি এটাই বিশ্বাস করি। তাই উনার আজ এই গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু ত্রিপুরার মহারাজ মানেই চল্লিশ লক্ষ মানুষের রাজ্য। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র একজন রাজনীতিক হয়ে উনার বংশ পরিচয়, বংশের ঐতিহ্য, রক্ত এবং আনুগত্য ভুলে গেলেন!!
একজন মহারাজের কাছ থেকে একজন ত্রিপুরাবাসী হিসেবে এটা প্রত্যাশা ছিলনা। ডিয়ার মিস্টার মহারাজা, আপনি এবং আপনার বংশধরেরা অর্থাৎ এই রাজ্যের রাজা বাহাদুরেরা কি শুধু তিপ্রাসাদের রাজা ছিলেন? না ত্রিপুরার সর্বস্তরের জনগণের রাজা ছিলেন! আপনার পূর্ব পুরুষ কি কোনদিন তিপ্রা আর বাঙালি করেছে না ত্রিপুরার সমগ্র জনগোষ্ঠীর কথা বলেছে?
ত্রিপুরার রাজ পরিবারের আজ এই যে জয়জয়কার সেটা রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর কারনে। এরপর ত্রিপুরাকে পৃথিবী চেনে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের কারনে। অবারিত দ্বার ছিল ত্রিপুরার মাটি এবং ভারতবর্ষ। ধন্য ধন্য করেছে বিশ্ববাসী। এখনও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের নজরানা দিয়ে যাচ্ছে দিল্লীকে, বাংলাদেশ সরকার। এই শতকে শচীন কর্তার ‘মেঠো সঙ্গীত আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসের কারনে ত্রিপুরাকে মানুষ চেনে আর জানে। আর জানে আপনার বাপ-দাদার রাজপ্রাসাদ উজ্জ্বয়ন্ত প্যালেস বা রাজবাড়ী, ঊনকোটি, নীরমহল, এবং পিলাকের কারনে। আর চেনে আশির জুনের দাঙ্গা বিদ্ধস্থ ত্রিপুরার কারনে। উপজাতি আর বাঙালির হত্যালীলা সবাই দেখেছে। এই হত্যালীলার মাস্টারমাইন্ড প্রাক্তন টিএনভি নেতা বিজয় কুমার রাংখল আজ আপনার দলের প্রধান। রত্নাকর দস্যু পরবর্তী জীবনে বাল্মিকি হয়ে রামায়ন লিখেছিলেন। রাংখল সাহেবের হেটটা (সাহেবি টুপিটা) কিন্তু আজও ছবিতে উজ্জ্বল।
রবীন্দ্রনাথ যখন এই রাজ্যে আসতেন তখন তিনি থাকতেন মালঞ্চ নিবাসে। এই মালঞ্চ নিবাস এখন বিয়েবাড়ি। ঐ বিয়েবাড়িতে নাকি আজকের দিনে সমুদ্র পাড়ের অনুভূতি দেয়! প্রি-ওয়েডিং শুট হয়! অবশ্য প্রদ্যোত বাবু বিয়ে করেননি, তাই অভিজ্ঞতা নেই। যাই হোক…। রাজপ্রাসাদ, উজ্জ্বয়ন্ত প্যালেসে এখন মাণিক্য কোর্ট। কি কান্ডটাই না ঘটে গেলো! রাজপ্রাসাদের আরেকটা অংশেই বিয়েবাড়ি ‘চন্দ্রমহল’। মহারাজা প্রদ্যোত কিশোর, ভাবুন আপনি আপনার ঐতিহ্য, রাজধর্ম, রক্ত কোনটাই রক্ষা করতে পারেননি। মহারাজের প্রাসাদে, প্রদ্যোৎ কিশোরের মহল্লায়, তিপ্রা মথার ঘরের ভেতরে বিয়ে বাড়ি, হোটেল, রেস্তোরা! এরপর ত্রিপুরা রক্ষা করবেন? ৩৫ আসনে কেন? ৬০ আসনে নয় কেন? মানে ত্রিপুরার ২৫ আসনে আপনার গ্রহণযোগ্যতা নেই। মানে আপনি অর্ধেক। বিশ্বাস যোগ্যতা তৈরি করুন। পাহাড়ি বাঙালি, রাজা-উজির সব এক। ত্রিপুরার নেতা হোন। আপনি মহারাজা হয়ে অর্ধেক মানুষের লোক। অর্ধেক ভোট নেই আপনার। ৩৫ এ ১৮ পাবেন। সরকার গড়তে পারবেন না। বিজেপির সাথে গেলেও না। বিজেপি ম্যজিক ফিগার পাবেনা ২০২৩ সালে রিগিং করেও। কংগ্রেসের সাথে গেলে কি হবে জানিনা তবে আপনি রাজনৈতিক ভাবে সাচ্চা থাকবেন। কারণ বিজেপি বিরোধী হিসেবেই এডিসি জিতেছেন আপনি। সিপিএম ফুরিয়ে গেছে আরও এক দশকের জন্যে।
এবার আসি আসল কথায়, রাজবন্দনা করলাম উপরিউক্ত পরিচ্ছদে। কোথাও কি মনে হচ্ছেনা এডিসি’তে যতটা উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল শেষ তিন-চার মাসে তা হচ্ছেনা! আপনি এডিসি’র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ট্র্যাডিশানেল পোশাক পরে আসতে নির্দেশ দিচ্ছেন, বিধানসভায় যদি তিপ্রা মথার কোন বাঙালি প্রার্থী জয়ী হয় তাহলে কি তাদেরও বলবেন ধুতি-পাঞ্জাবী পরে আসতে? না উপজাতিদের পোশাক পরে আসতে! এডিসি’তে চার থেকে পাঁচ লক্ষ বেকার। এতো সংখ্যক বেকারের মধ্যে মাত্র ২২ হাজার চাকরী, কাদের দেবেন? আপনি বাইশ হাজার চাকরীতে বিকিয়ে যাচ্ছেন আপনার রাজনৈতিক শত্রু বিজেপি’র কাছে? নিজের দর্শনের কাছে? অবশ্য তিপ্রা মথার দর্শন মানেই আপনার ইচ্ছে অনিচ্ছে। কোন ইজম আপনার দলের নেই। আপনি বলছেন গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড এর দাবীকে যেই রাজনৈতিক দল লিখে দেবে আপনি তাদের সাথেই যাবেন। অর্থাৎ সিপিএম, বিজেপি বা কংগ্রেস বা তৃনমূল, সমাজবাদী পার্টি, আপ যেকোনো দলের সঙ্গে আপনি যেতে রাজী। তাই নয় কি? তাহলে আপনার দলের মতাদর্শ এবং দর্শনটা কি? যখন যেমন তখন তেমন? ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ মানে কি আরেকটা আশির জুনের দাঙ্গা? টিএনভি সভাপতি বিজয় রাংখল আপনার সাথে আছে, উনাকে জিজ্ঞেস করুন কি চাইছে! শ্রীহট্টের ইতিহাস পড়ুন, এই অঞ্চলে কাদের আধিপত্য ছিল? পিলাকের ইতিহাস প্রমান করে দিচ্ছে ত্রিপুরার হাজার বছরের ইতিহাস। ত্রিপুরায় বাঙালিরা উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। আপনি মহারাজা হিসেবে বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ডের কথা বলছেন, এই তিপ্রাল্যান্ড উপজাতি অনুপজাতি সবার। বিবেকানন্দ স্টেডিয়ামের সভায় আপনি তিপ্রাল্যান্ড নিয়ে স্পষ্টীকরণ দেবেন বলেছিলেন, দেননি। এই স্পষ্টীকরণ দরকার ত্রিপুরার মানুষের। কারণ আপনি ত্রিপুরার মাটিতে বসে রাজনীতি করছেন। তবে হ্যাঁ এটাও সত্যি উপজাতিদের গত পঁচাত্তর বছরে আরও উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল। অর্ধেক সময় অর্থাৎ ৩৫ বছর বামফ্রন্ট শুধু মাথা গুনেছে আর ভোট ভড়েছে নিজেদের ভোটবাক্সে আর কিছু করেনি। তাই আজ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে মানুষ। সারা রাজ্যে শুধু নয় এই আগরতলা শহরেও প্রচুর উপজাতি অংশের মানুষের জমি বেদখল হয়ে আছে। উপজাতিদের উন্নয়নের অর্থ লুটপাট চলেছে। অধিকার লুণ্ঠিত হয়েছে, শিক্ষা-কাজ-স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে সাওয়াল করুন। উপজাতি মহল্লার মায়েদের-শিশুদের মৃত্যু হার বেড়ে গেছে, বাচ্চাগুলি অপুষ্টিতে ভুগছে খেয়াল আছে আপনাদের? শিশুদের ওজন এবং উচ্চতা কমে যাচ্ছে সেই তথ্য আছে? আজকের জেনারেশান এডিক্টেড হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন ড্রাগস-জুয়ায়। শেষপর্যন্ত ডিপ্রেশানে সুইসাইড করছে। উপজাতীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে একটা আস্ত জাতি, আপনাদের হুঁশ নেই। শুধু ভোট চাই আর ‘তিপ্রাল্যান্ড’ মানে জমি। নিজের জমিটাই তো রক্ষা করতে পারলেন না, নতুন জমি পেয়ে কি হবে? ভ্যাটিক্যান সিটি? সম্প্রতি দুই বন্ধু মিলে বেশকিছু দ্বীপ কিনে নতুন রাষ্ট্র তৈরি করছে। আপনার বাদশাহী খোয়াব দেখলে মনে হয় আপনিও তাই চাইছেন। রাজা মহারাজারা এরকম খাম খেয়ালিই হয়ে থাকেন জেনেটিক্যালি। আপনিও তার বাইরে নন। তাই আশ্চর্য হই না।
৩৫ টি আসনে লড়াই করার হুমকি দিয়ে আপনি কি প্রমান করতে চাইছেন? এর উত্তর জানতে চায় ত্রিপুরার চল্লিশ লক্ষ (!) মানুষ। আপনি ত্রিপুরাবাসীকে বিভক্ত করে দিচ্ছেন না কি? আপনি মহারাজা, আপনি ৬০ আসনে কেন প্রার্থী দেবেন না? শুধু কেন ৩৫ আসনে? এর উত্তর আপনি দিতে পারবেন না। এটাই সত্যি। আপনি ত্রিপুরার অর্ধেক বোকা মানুষের স্বপ্ন, ভবিষৎ নিয়ে খেলছেন। ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ মানে কি অর্ধেকটা ত্রিপুরা? মানে ৩৫ আসনের জমি? যেখানে উপজাতি অংশের মানুষের সংখ্যাধিক্য! এবার তাহলে আমার প্রশ্ন, বাকী ২৫ আসনে যে তিপ্রাসারা থাকেন তাদের ল্যান্ড কোনটা হবে? না তাদের আপনার স্বপ্নের তিপ্রাল্যান্ডে মুফতে জমি এবং পুনর্বাসন দেবেন? মহারাজা, আপনার কথায় কিন্তু কিছুই স্পষ্ট নয়। আপনি ত্রিপুরার মহারাজাদের গরিমা ভূলুণ্ঠিত করছেন বিয়ের আসর বসিয়ে। রবীন্দ্রনাথের মালঞ্চ নিবাসটা তো অন্তত ছেড়ে দিতে পারতেন, না উনি বাঙালি কবি বলে অচ্ছুৎ আপনার কাছে? আপনার থেকে কি আশা করতে পারে এই রাজ্যের চল্লিশ লক্ষ মানুষ! আপনি অত্যন্ত জনপ্রিয় এই রাজ্যের অসহায় তিপ্রাসাদের কাছে। ত্রিপুরার উপজাতি অংশের মানুষ অনেকদিন পরে একজন উপজাতি নেতা পেলেন। এবার অন্তত তাদের কথা ভাবুন…। মহারাজাদের অনেক গোসসা, জানি আমার গর্দান নিতে পারেন আপনি। কিন্তু একটু ভাবুন। একটা ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম এবং ‘ক্রাইম-ফ্রি ত্রিপুরা স্টেট’, চাইছে মানুষ। মানুষ আজ দিশেহারা। একজন সঠিক নেতৃত্ব চাইছে রাজ্যের মানুষ এবং সঠিক দিশা। আর স্বচ্ছতা। তাই মহারাজা এতো গুলি কথা। ৬০ আসনের কথা ভাবুন। এই ত্রিপুরার কথা ভাবুন।
গুপি-বাঘা মাত করে দিয়েছিল সব। গুপি বাঘায় ঠাকুর মশাই বলছেন, ‘আমার ঐ যষ্ঠীর ছায়া যতক্ষণ না ঐ প্রস্তর খণ্ডে স্পর্শ করছে ততক্ষণ সকাল…’। আপনার সকাল মানেই খামখেয়ালি, ‘গ্রটার তিপ্রাল্যান্ড’। গুপি বাঘার রাজা এবার উত্তর দিন। (এই লেখাটির যাবতীয় দায় লেখকের, লেখক একজন ত্রিপুরাবাসি এবং জাত ধর্ম কিছুই ব্যাবহার করেন না) ।