।। যাত্রাপথের আনন্দগান ।।
অরিন্দম নাথ
আমরা থাকি নন্দননগরে । আগরতলার শহরতলী । একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল । শহর এদিকটায় দ্রুত বিস্তার হচ্ছে । নতুন নতুন ঘরবাড়ি হচ্ছে । সঙ্গে দোকানপাট, স্কুল, অফিস এবং আধুনিকতার আনুষঙ্গিক ছোঁয়া । পাশাপাশি কয়েক কদম হাঁটলে এখনও গ্রামের ছোঁয়া মেলে । কুমোর পাড়া । ধানক্ষেত । আনারস বাগান । রাঙ্গামাটির পথ । খোলা হাওয়া । প্রকৃতির এই উপহার মিস করতে মন চায় না । নিয়মিত মর্নিং ওয়াকে যাই । গতকালও তার অন্যথা হয়নি । বাংলা নববর্ষ । ১ লা বৈশাখ ১৪২৯ সাল । সকাল সাড়ে পাঁচটা । জলি আমাদের গাইড । সে আমাদের সারমেয় কন্যা । নিজ গতিতে এগিয়ে চলে । রাস্তাঘাট অপেক্ষাকৃত ফাঁকা । এখন রমজান মাস । সেহরির পর মুসলিম লোকেরা ঘুমিয়ে পড়ে । সেহেরি হল ভোরের টিফিন । ফজরের নামাজের আগের খাবার । এসব জানতাম না । এখানে আসার পর জেনেছি । কাছাকাছি একটি মসজিদ আছে । লোকজনের শৃঙ্খলা-পরাণয়তা দাগ কাটার মত । অধিকাংশ নতুন বাড়ি-ঘর জনজাতিদের । ওরা খুবই স্বাস্থ্য সচেতন । অনেকেই রেগুলার জগিং করে । তুলনায় বাঙালি প্রাতভ্রমণকারীদের সংখ্যা কম । অধিকাংশই আমাদের মত বয়স্ক । একটি দুটি বাঙালি পরিবার দ্বিচক্রযানে কোথাও যাচ্ছিল । স্বামী-স্ত্রী । সঙ্গে ছেলে বা মেয়ে । তাদের নিয়মিত দেখি না । হয়তো নববর্ষ উপলক্ষে বড়দের প্রণাম করতে যাচ্ছে । কিংবা কোথাও বৈশাখীর অনুষ্ঠানে অংশ নেবে । আকাশে হালকা মেঘ । তবে কাল বৈশাখীর ভ্রুকুটি নেই । হালকা হাওয়া বইছে । সবমিলিয়ে উপভোগ্য পরিবেশ ।
এরইমধ্যে নতুন সংযোজন । স্থানে স্থানে অস্থায়ী স্লটার হাউস । মাংসের দোকান বসেছে । পাঁঠার মাংস । সঙ্গে দেশী মুরগি । বয়লার কম । একটি দুটি মেষ । কোথাও বরাহের মাংস । দেশে এত পুরুষ ছাগল বেচে আছে ধারণা ছিল না । বেচারাদের জন্য খারাপ লাগলো । নববর্ষ তাদের কাছে শুভ নয় । নিশ্চিন্ত মৃত্যুর প্রতীক্ষা । উপজাতি মাছের দোকানদার বড় মাছ নিয়ে বসেছে । মাছগুলো সদ্যমৃত । গ্রাস কার্ফগুলোর আকৃতি ঈর্ষণীয় । গড়ে তিন কেজির বেশি । আস্ত মাছ নিতে হয় । দোকানে নো কাটাকাটি ।
একজায়গায় জলি বিরম্বনিয় পড়ে । একটি গরু রাস্তার পাশের ঘাস খাচ্ছিল । বড় রশিতে বাধা । জলি অনায়াসে পেরিয়ে যেতে পারত । হয়তো আমাদের ভরসায় বকাবকি শুরু করল । গরুটি তেড়ে এলো । এবার জলির পালিয়ে প্রাণ বাঁচে না । কিছুদূর যাওয়ার পর আবার বিপত্তি । এবার জলি আমাদের বিড়ম্বনা উপভোগ করে । এক জায়গায় কনস্ট্রাকশনের জন্য বালু ফেলা ছিল । একটি মহাদেবের ষাঁড় বালু নিয়ে খেলায় মত্ত । এবার জলি এগিয়ে যায় । আমরা ভয়ে কিছুটা সন্ত্রস্ত । 'যপসজ' মন্ত্র উচ্চারণ করি । য পলায়তি স জীবতি । ষন্ডের সামনে কার্যকরী মন্ত্র ! সাবধানে এগিয়ে যাই । ফেরার পথে মাছের দাম করি । একটি গ্রাস কার্ফ পছন্দ হয় । অল্প কম তিন কেজি । দাম পড়ে এক হাজার টাকা । গৃহিণী ঘরে নেই । নাইট ডিউটিতে । মাছটি দিয়ে মুইট্টা বানাতে বলি । পাচক বলে চিতল মাছের মুইট্টা হয় । গ্রাস কার্ফ ছেড়ে দেবে । আমি বলি আগে সেদ্ধ করে বোনলেস কর । তারপর ডিম মেশাও । আঠা হিসাবে বেসন দাও । নতুন রেসিপি হবে । এবার ছেলেটি উৎসাহ পায় ।
ঘরে ফিরে আমি চা খাই । পত্রিকা পড়ি । জলি সঙ্গ দেয় । একসময় যোগাসন করি । প্রাণায়ম করি । সঙ্গীত শুনি । প্রথমে বৈশাখের গান । তারপর বিহুর গান । ভূপেন হাজারিকার গান ।
"বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের-
হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি-
গঙ্গা বইছ কেন?
বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের-
হাহাকার শুনেও,
নৈতিকতার স্খলন দেখেও –
মানবতার পতন দেখেও-
নির্লজ্জ অলস ভাবে বইছ কেন?"
গান শোনা বন্ধ করে দিই । মনে মনে গানের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজি । উত্তর মেলে না । মনে হয় প্রতিদিন নৈতিকতার অপমৃত্যু ঘটছে । পুলিশের কাজে জড়িয়ে পড়ি । দুপুরে পরিবারের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি । মুইট্টার রেসিপি ভালো হয় । সঙ্গে নববর্ষ দিনের আনুষঙ্গিক খাবার । প্রশ্নগুলো অবচেতনে থেকে যায় । রাত্রিতে মৌতাত আসে ।
আপনারা যারা আমার লেখার সঙ্গে অপরিচিত তাঁদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি কথা বলছি ৷ আমার শরীরে একটি অ্যানামলি আছে ৷ প্রথমে জানতাম না ৷ কয়েক বছর হল বুঝতে পেরেছি ৷ আমার লিভার থেকে সময় সময় এক বিচিত্র এনজাইম ক্ষরণ হয় ৷ এই জারক-রসের প্রভাবে শর্করা জাতীয় খাবার মাদকে পরিণত হয় ৷ ফলে অজান্তেই আমি বেশ নেশার আমেজ পাই ৷ মৌতাত আসে । এমনি মৌতাতের মুহূর্তে প্রায়ই আমি পৌঁছে যাই বিধাতার দরবারে ৷ এইভাবে কয়েক দফা সফর করেছি ৷ যার বর্ণনা অন্যত্র দিয়েছি ৷ তবে এই সুবাদে বিধাতা এবং তাঁর সারাক্ষণের দুই সহচরের সঙ্গে সখ্যতা হয়ে গেছে ৷ মানিকজোড় শুম্ভ-নিশুম্ভ আসলে দুই যমজ ভাই ৷ অসুরের মত চেহারা ৷ ব্যবহার কিন্তু অমায়িক ৷ আগের জন্মে এঁদের একজন ছিলেন অংকের প্রফেসর ৷ অপরজন কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান পড়াতেন ৷ দুই জনেই ছিলেন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ।
বিধাতার রুমের দিকে এগিয়ে যাই । মানিকজোড়ের একজন আমাকে কড়িডোরেই থামায় । মুচকি হাসে । ওদের দুজনকে আলাদা করে সনাক্ত করতে পারি না । যেমন বুঝতে পারিনা মুচকি হাসির কারণ । আমাকে এই অসহায় অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন বিধাতা । তিনি যেন আমার অপেক্ষাতেই বসে ছিলেন । আদর করে ডাকেন, "কেমন আছ হে বাছা !"
- আপনি আমায় এই প্রশ্ন করছেন !
- আমি কি সাঙ্ঘাতিক বেশি জানি !
- জানেনই তো ! আপনি জগতের সৃষ্টিকর্তা । কার কতদিন আয়ু আপনার নখদর্পণে ।
- একদমই ঠিক নয় । শুধু জেনারেল আইডিয়া । চিত্রগুপ্ত হয়তো আরাও অ্যাকুরেট বলতে পারবে ।
- সে কেন?
- সে যে ডাটা এন্ট্রি ওপারেটর । পরিসংখ্যানবিদও বলতে পার ?
- সে কেমন কথা ?
- জীবন হচ্ছে রিয়াল ভ্যারিয়েবল্ । বছর, দিন, ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড, মিলি সেকেন্ড, মাইক্রো সেকেন্ড, ন্যানো সেকেন্ড, পিকো সেকেন্ড, এমনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পল পর্যন্ত ব্যপ্তি । একটা সময় পর দুটো মাইলফলকের মধ্যে আটকে থাকে । তখন দশমিকের পর, ঘরের পর ঘর গড়িয়ে যায় ।
- মাইলফলক কি ?
- মাইলফলক বলতে আমি বছর বুঝাতে চেয়েছি ।
- আজ যেমন ১৪২৯ বাংলার প্রথম দিন । জীবন পথের মাইলফলক !
- ভালো বলেছ । জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান কখনও ইন্টিজার বা পূর্ণ সংখ্যা হয় না ।
- কেন ? বিধানচন্দ্র রায়ের ক্ষেত্রে পূর্ণ সংখ্যা ছিল । জুলাইয়ের ১ তারিখ ।
- জন্ম ও মৃত্যু মুহূর্ত কিন্তু ভিন্ন ছিল । ফলে পূর্ণ সংখ্যা থেকে ভগ্নাংশ পরিমাণ কম বা বেশি হবে ।
- এমন কেন হয় ?
- মানুষ বাউন্ড বাই বাউন্ড চলতে পছন্দ করে । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করে । বিশেষ করে জীবনের কোনও নতুন মাইলফলকে পৌঁছে । অতিরিক্ত সচেতন হয়ে পড়ে ।
- ঠিক কি তাই!
- কোনও সন্দেহ ?
- এমনি মনে এলো । গতবছর অর্থাৎ ১৪২৮-এর ১ লা বৈশাখ আমি আই সি ইউ-তে ভর্তি ছিলাম । ভেন্টিলেশনে ছিলাম ।
- আমি জানি । কিন্তু তোমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করবে । পরদিন একটু সুস্থ হওয়ার পর কি বলেছিলে ?
- আমার স্ত্রী পারমিতা বলেছে । জ্ঞান ফেরার পর আমি নাকি রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার বায়না ধরেছিলাম !
- তখনও অক্সিজেন সাপোর্টে ছিলে ।
- প্রভু, আমি আপনার কাছে ঋণী । অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে । এখন একটি প্রশ্ন মনে জেগেছে । আপনিতো অন্তর্যামী! বলতে হবে!
- কোন প্রশ্ন? সকাল থেকে তুমি যা ভাবছ । ভূপেন হাজারিকার গান !
"বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের-
হাহাকার শুনেও,
নৈতিকতার স্খলন দেখেও –
মানবতার পতন দেখেও-
নির্লজ্জ অলস ভাবে বইছ কেন?"
- হ্যা । একদম ঠিক!
- আচ্ছা, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক । কল্পনা কর মা-গঙ্গা শুকিয়ে গেছেন । গঙ্গা নদীতে আর জলস্রোত বইছে না ।
- তাহলেতো অনর্থ হবে । জলচর এবং স্থলচর প্রাণী, উদ্ভিদকুল শুকিয়ে মরবে । শত সহস্র লোকজন অন্যত্র বাসস্থান খুজবে । ব্যবসা-বানিজ্য গুটিয়ে যাবে । অনেক লোক মারা যাবে । গঙ্গার পাড়ের জনপদ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে ।
- কিন্তু নির্লজ্জ অলস অপবাদ থেকে মা-গঙ্গা রেহাই পাবেন । নৈতিকতার স্খলন কিংবা মানবতার পতন দেখে তোমাদের মত লোকেরা অসহায় বোধ করবে না । প্রতিদিন নৈতিক অপমৃত্যু ঘটছে, মনে এই অনুভূতি আসবে না ।
- আমার মনে হয় গানের অন্তর্নিহিত অর্থ তা নয় । প্রতিবাদী জনতা মা-গঙ্গাকে সঙ্গে চাইছে । মা-দুর্গার রূপে । অন্যায় এবং অশুভ শক্তির বিনাশে ।
- মা-গঙ্গা কিংবা কোন দেবতাই তা করবেন না । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের কথা ভাব । তিনি অস্ত্র হাতে নেননি । শুধু পাণ্ডবদের পৌরুষ জাগিয়ে তুলেছিলেন ।
- পুরুষ বলতেতো শুধু ভিম!
- অর্জুনের মধ্যেও পৌরুষ ছিল । আমি বলবো পরিশীলিত ।
- কিন্তু মহাভারতের প্রসঙ্গ টেনে আপনি কি বলতে চাইছেন?
- যুধিষ্ঠিরের মত জুয়াড়ি সব যুগেই থাকে । এখন যেমন নেশায় আসক্তি । অর্থে আসক্তি । যৌন আসক্তি । অবৈধ পথে অর্থপ্রাপ্তির আসক্তি । রাজনৈতিক ক্ষমতার আসক্তি । মোবাইল ফোনে আসক্তি । ভিডিও গেমসে আসক্তি । যশের জন্য আসক্তি । অনলাইন জুয়ায় আসক্তি । ক্যাসিনোতে আসক্তি । এমনি নানাহ আসক্তি তোমাদের সমাজে ছড়িয়ে আছে । আর আজকের যুগের কৌরব, শকুনিরা এর ফায়দা নিচ্ছে । জুয়া খেলতে বাধ্য করছে । এই খেলায় একমাত্র যারা খেলায় তারাই নিশ্চিত লাভবান হয় । বাকিদের বড় অংশ লুজার । তারা তাদের পরিবার কিংবা ভরসার লোকদের অসহায় অবস্থায় নিয়ে আসে ।
- তাই গরীবের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পায় । ধনীর ধনও বৃদ্ধি পায় ।
- দেবতা কোন পক্ষ নেন না । শুধু সত্য তোমাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন । ফাইটার কিন্তু তোমরাই । মাইলফলক টাচ করার পথে যাত্রাপথের আনন্দগান গাইতে হয় । আর আমরা তা উপভোগ করি ।
- সেটা কেমন?
- আজ যেমন জলিকে গরু দৌড়ানি দিলে তোমরা হাসলে । আর মহাদেবের ষাঁড়ের ভয়ে তোমাদের ভীতসন্ত্রস্ত দেখে আমরা হাসলাম ।
- পাঁঠাদের দুর্ভোগও কি উপভোগ করেন ?
নববর্ষের শুভদিনে নিজেদের মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা পাঁঠাদের কথা বলতে চাই । কিন্তু বিধাতার সাড়া পাই না । বুঝতে পারি আমার মৌতাত টুটে গিয়েছে ৷