পিছুটান
দেবারতি দত্ত
হঠাৎ মাথায় প্রশ্ন এলো একটা সম্পর্কের আয়ুষ্কাল কত? যে যত দিন বাঁচে ততটুকু, নাকি তারপরেও বেঁচে থাকে। বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে। ছোটবেলা থেকে এক একটা সম্পর্ক বদলাতে দেখেছি। মা থেকে বন্ধু হওয়া, বন্ধু থেকে প্রিয় বন্ধু হওয়া, কাছের মানুষ থেকে অচেনা অজানা হয়ে ওঠা। আবার ঠিক একইভাবে অচেনা সম্পর্কগুলো কোনও একদিন খুব কাছের হয়ে উঠলো। এত বছরে এতোটুকু বুঝতে পেরেছি যে একটা সম্পর্ক জন্ম নেয় মাতৃগর্ভে। সে এক চিরন্তন সত্য, যার টানে আমরা সবাই বাঁচি। একটা শিশুর প্রথম শব্দই হচ্ছে ' মা '। তার হাত ধরে বাকি সব নামডাক। যদি আমরা এক নজর চোখ তুলে তাকাই আমাদের চারপাশে কত সুন্দর সম্পর্ক গুলো বেঁচে আছে যুগ যুগ ধরে। আকাশের সাথে সুর্যের, মাটির সাথে গাছের,
মাঝির সাথে নৌকার, মেঘের সাথে বৃষ্টির, পাখির সাথে রিতুর, ঝরনার সাথে নুড়ি পাথরের। মানুষ বাঁচে না কিন্তু এরাই বহন করে চলেছে পরস্পরের সম্পর্ক। তেমনি প্রকৃতির কোলে যেকোনো সম্পর্ক লালিত হয় আস্তে আস্তে, রূপ নেয় চার দেয়ালের মধ্যে। কিছু ঝরে যায় অসময়ে আবার কিছু বেড়ে চলে তার আপন গতিতে।ঠিক এমনি সময়ে টানাপোড়েনে একটি সম্পর্কের পরিণতি ঘটে ' গোধূলিতে '
গোধূলি কোন বৃদ্ধাশ্রম নয়,এ এমন এক সুখের নীড় যেখানে শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো আবার সজীব হয়ে ওঠে। যেমন শুকিয়ে যাওয়া গাছ প্রাণ পায় এক বিশুদ্ধ জলে। আমাদের বদ্ধমূল ধারণাকে একেবারে পরিবর্তন করে নতুন ভাবে ভাবতে শেখায় গোধূলি। এই গল্পই আপনাদের সাথে করবো। কেমন করে সমরেশ বাবু খুঁজে পেল তার শেষ বেলার সাথী কে গোধূলির হাত ধরে। এই ঘটনা বছর পাঁচেক আগে ঘটে যাওয়া কোনো এক
দুপুরবেলার। সবাই একসাথে বসে গল্প করছিল। ঠিক তখনই গাড়ি থেকে নেমে এলো সমরেশ বসু। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। পত্নীবিয়োগ ঘটেছে বছর তিনেক আগে।নিয়ম অনুযায়ী ছেলের মনে হচ্ছিল বাবাকে আর এ বাড়িতে রাখা যায় না। তাই সমরেশ বাবুর স্থান হল এই গোধূলি। যা বলছিলাম, সবাই তাকিয়ে দেখল, সমরেশ বাবুকে নামিয়ে দিয়ে গেল এক কালো ইনোভা। তিনি ছিলেন প্রাণখোলা মানুষ। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তিনি গোধূলির প্রাণ হয়ে উঠলেন। গোধূলি আবার নতুন করে হাসতে লাগলো, গাইতে লাগলো, আনন্দ করতে লাগলো। এক লহমায় এই লোকটা সবাইকে নিজের করে নিলেন। সবাই তাদের নিজেদের মনের কথা বলে, সমরেশদা কে। তিনি খুব সাবলীল ভাবে বুঝিয়ে দেয় সব কিছুতেই আমাদের আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। হঠাৎ করেই অবচেতন মনে গেয়ে উঠলো- " একটু হাসির ছোঁয়া, একটু চোখের জল, অভিমান আড়াল করে ভালবাসার অতল। জীবনস্মৃতির দান এমনই সাজিয়ে রাখি, যেন বেলা শেষ ভাগে তুমি আমি ভালো থাকি"। হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল পল্টুর চিৎকারে! আমার ছেলেটা বোধ হয় আর বাঁচবে না, ডাক্তাররা বলল, 'অপারেশন ছাড়া কোন উপায় নেই'।
পল্টু দেখল যে যার শেষ সম্বলটুকু তার হাতে তুলে দিচ্ছে। তার চোখ বেয়ে জল এল। এভাবেই গোধূলির চাদরে ঢেকে থাকে তাদের সুখ-দুঃখ। এমনভাবেই কয়েকটা মাস কেটে গেল। পল্টুর ছেলেও অনেকটা সুস্থ। সমরেশবাবুর আজকে খুব আনন্দের দিন। তার নাতি আসছে বিদেশ থেকে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তার হাতে আরো তিন চার মাস বাকি। চায়ের আড্ডায় সেই কথাই হচ্ছিল। অর্চন হচ্ছে সমরেশ বাবুর নাতি।
তার সাথে এখানের সবারই ভাল সম্পর্ক। সমরেশের যাওয়ার কথা শুনে সবাই বলল,"দেখিস তোর যাওয়া হবেনা"। হঠাৎ পল্টু এসে বলল,"চলুন নতুন বোর্ডার এসেছে"। নিচে নেমে দেখল তাদেরই মত এক মহিলা গাড়ী থেকে নামছে। সমরেশ লক্ষ্য করলো তার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে, দৃষ্টি স্থির, মনে হচ্ছে প্রাণহীন। সবাই মিলে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। সমরেশ দৌড়ে তার জন্য জল নিয়ে এলো, ভাতের প্লেট এগিয়ে দিল। কেমন জানি নিজের অজান্তেই সবকিছু করছে সে। তার করতে ভালো লাগছে। বৃদ্ধাশ্রমে সবাই সম্পর্ক ছিন্ন করে আসে কিন্তু এখানেও যে নতুন বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়তে পারে তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। এভাবেই গোধূলির ছায়ায় তাদের সম্পর্কের আয়ুষ্কাল একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। দাদান! দাদান! তুমি কোথায়? এই দেখো আমি চলে এসেছি। সমরেশ দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, অর্চন কে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর অর্চন একে একে সবার জন্য আনা উপহার তাদের দিল। হঠাৎ চোখ পরল দরজায়। মনে হল কে যেন আড়াল থেকে সব শুনছিল। পরে সমরেশের কাছে শুনল নীলিমা দিদার কথা। মাস তিনেক আগে তাদের সাথে থাকতে এসেছে। রাতে সবাই একসাথে খুব গান-বাজনা করল, তারপর একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করলো। রাতে যখন অর্চন দাদুর ঘরে এলো, দেখল দাদুর দু চোখ বেয়ে জল, কাপড় জামা এলোমেলো হয়ে নিচে পড়ে আছে। অর্চনের বুঝতে খুব বেশী অসুবিধে হলো না কিসের কারণে বা কার জন্য দাদু তার সাথে ফিরে যেতে চাইছে না
কাউকে কাছে পেয়ে হারানোর ভয়? নাকি শেষ বেলায় একা হয়ে যাবার ভয়? বাইরে বেরিয়ে এসে অন্য ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল, নীলিমা দিদা বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে। আসলে সবাই তাদের শেষ জীবনের ভালোলাগাগুলো কে নিয়ে বাঁচতে চায়। অর্চন বুঝতো তার দাদুর অন্তর্নিহিত অনুভূতি। সকালে দাদুকে নিয়ে সবার কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে গাড়িতে উঠলো। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দাদুকে বলল ' যাও তোমাকে তোমার ভালো থাকার ঠিকানায় রেখে গেলাম'। এই বলে সবাইকে প্রণাম করে দাদু ও নীলিমা দিদার আশীর্বাদ নিয়ে অর্চন বেরিয়ে পড়ল। পাশের বাড়ির রেডিও থেকে ভেসে এলো- " কিছু স্বপ্ন বাঁচে মনে মনে বারো মাস, আর কটাদিন তোমাতেই থাকবো, কিছু সময় বলছে আমায়, তারাও ছিল রোজনামচায়"।