ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সন্ধানে পুঁথি চর্চা

পান্নালাল রায়

" দ্বিজ বংসীদাসে কয় ভাগবত সার।

অপুর্ব্ব পুরান কথা রচিয়া পয়ার।"

উপরের লাইন গুলো একটি পুঁথির।দ্বিজ বংশীদাশের পদ্মপুরাণ।লাইন দুটি রয়েছে পুঁথির ভণিতা অংশে।

প্রায় দুই শতাব্দী আগে লিপিকার তুলট কাগজে বাঁশের কলমে দ্বিজ বংশীদাসের এই অনবদ্য সৃষ্টি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এরকম মণিমুক্তা আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। মুদ্রণ মাধ্যমের বিস্ময়কর অগ্ৰগতিও যখন চাপা পড়ে যায় নেট-অন লাইনে, তখন আর শত শত বছর আগেকার হাতে লেখা পুঁথি? তবু সামনের দিকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেও আমাদের মাঝে মাঝে পেছন ফিরে দেখতে হয়।কি ভাবে ঘটলো সভ্যতার এই দীর্ঘ পরিক্রমা? জীবন যাপনের নানা ক্ষেত্রে অভাবনীয় উত্তরণ? মাঝে মাঝে পর্যালোচনা করতে হয় অতীত ঐতিহ্যের আলোয় উদ্ভাসিত আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারাকে।আর এজন্য হাতে লেখা পুঁথি নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। শুধু ‌সাহিত্য নয়, ইতিহাসও লুকিয়ে আছে এইসব পুঁথিতে।

একদা জনপদে কারও কারও কাছে পরম মমতায় সংরক্ষিত থাকতো এই সব পুঁথি। পরবর্তী সময়ে যাদুঘর সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করা হতে থাকে তা। তবু কালের প্রবাহে অনেক পুঁথি বিনষ্ট হয়ে গেছে। আবার সাম্প্রতিক কালেও মাঝে মাঝে পুঁথির উজ্জ্বল উদ্ধার ঘটে।শত শত বছর আগে যখন মুদ্রণ মাধ্যমের আবিষ্কার ও বিকাশ ঘটেনি তখন কবির অপূর্ব সব সৃষ্টিকে উৎসাহী পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেন লিপিকাররা।রাজসভা আশ্রিত কবি রাজাদেশে রচনা করেছেন কোনো কাব্য, কিংবা অনুবাদ করেছেন। কিন্তু তার বহুল প্রচার হবে কি ভাবে? উৎসাহী পাঠকের কাছে পৌঁছবে কি ভাবে? রাজপ্রাসাদের চার দেয়ালের মধ্যে কবির সৃষ্টি আবদ্ধ থাকলেতো চলবে না! এখানেই লিপিকারদের বিরাট ভূমিকা। আজকের দিনে গ্ৰন্হ প্রকাশকদের যে ভূমিকা সেদিন লিপিকারদের সেই ভূমিকাই ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে কবির সেইসব অমর সৃষ্টি ছড়িয়ে পড়তো তাদের হাতে লেখা পুঁথির মাধ্যমে। এভাবেই আমরা পেয়েছি মধ্যযুগের বাংলা কাব্য সাহিত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন 'পদ্মাবতী' , পেয়েছি প্রাচীন বাংলা কাব্যের নিদর্শন ত্রিপুরার 'রাজমালা' কিংবা ডিমাছা রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় ভুবনেশ্বর বাচস্পতির অমর সৃষ্টি 'নারদি রসামৃত'।

পরবর্তী সময়ে এইসব কাব্যের কিছু কিছু মুদ্রিত হয়ে বিপুল সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে। বাংলা কাব্য সাহিত্যের আদি রূপের সন্ধান যেমন মানুষ পেয়েছে, তেমনই সেসবে উঁকি দিয়েছে ইতিহাসও। কিন্তু তা সত্ত্বেও হয়তো নতুন আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে আরও পুঁথি,পান্ডুলিপি। তবে সেসব নিয়ে যে কাজ হচ্ছেনা তা নয়। চলছে নিরন্তর গবেষণা। সংরক্ষণেও কাজ চলছে।ন্যাশনেল মিশন পর ম্যানাসক্রিপ্ট এইসব পুঁথি -পান্ডুলিপি চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্হাও এবিষয়ে কাজ করছে।

সেদিন এরকম মণিমুক্তার সন্ধানে হাজির হলাম শিলচরের শতাব্দী প্রাচীন নর্মাল স্কুলে। সেখানে দেখা হলো বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট গবেষক ড.অমলেন্দু ভট্টাচার্যের সঙ্গে। নিবিষ্ট চিত্তে কাজ করে চলেছেন। সামনে টেবিলে ছড়ানো পান্ডুলিপি।বরাক উপত্যকায় সম্ভবত সর্বাধিক পুঁথি সংরক্ষিত আছে এই নর্মাল স্কুলে। বাংলা ও সংস্কৃত মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক পুঁথি সংরক্ষিত আছে এখানে। বর্তমানে কলকাতার আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ড. ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এখানের পুঁথি সমূহের বিবরণমূলক তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে।প্রায় চার বছর ধরে এই কাজ হচ্ছে।

প্রান্তীয় বাংলার বিভিন্ন রাজসভার উদ্যোগে একদা তুমুল চর্চা হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় যেমন মধ্যযুগে বাংলা কাব্যের অভিনব স্ফূরণ ঘটেছিল, তেমনই এ বিষয়ে চট্টগ্ৰাম, ত্রিপুরা,ডিমাছা, কোচবিহার ইত্যাদি রাজসভার উদ্যোগও সপ্রশংস আলোচনার দাবি রাখে।আর এই যাবতীয় চর্চার মাধ্যম ছিল পুঁথি।রাজাদেশ সহ রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা,কবির সৃজনশীলতা এবং লিপিকারদের নিষ্ঠায় যুগ যুগ ধরে এখনও টিকে আছে সেদিনের অমূল্য সব সম্পদ। শিলালিপি কিংবা তাম্রলিপির যুগ থেকে আজকের নেটযুগের মানুষও যেন সাহিত্য আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে সেই সব পুঁথির মাধ্যমে। অষ্টাদশ শতকে ডিমাছা রাজসভার কবি ভুবনেশ্বর বাচষ্পতি রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা দেবীর আদেশে রচনা করেছিলেন " শ্রীনারদি রসামৃত "।কবি তাঁর কাব্যে উল্লেখ করেছেন--

' ...তাম্রধ্বজ মহারাজা ছিলা মহাভাগ।

সর্ব্বলোকে সদা জারে করে অনুরাগ।।

তান পুত্র রাজা সুরদর্প মহাসয়।

চন্দ্রপ্রভা নামে দেবি তান মাতা হয়।।

কবি বাচস্পতি তান বাক্য অনুসারে।

শ্রীনারদি রসামৃত রচিল পয়ারে।।' এরকম ভাবে পঞ্চদশ শতকে ত্রিপুরায় মহারাজা ধর্ম মাণিক্যের আদেশে পন্ডিত শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর রচনা করেছিলেন "রাজমালা"। রাজা ও রাজবংশের গুণকীর্তন নির্ভর 'রাজমালা' পুরোপুরি ইতিহাস না হলেও ত্রিপুরার ইতিহাস চর্চায় তা অপরিহার্য।আর আমরা এসব পেয়েছি পুঁথির মাধ্যমে।মধ্যযুগের বাংলা কাব্যেও এভাবে উঁকি দিয়েছে আরাকানের ইতিহাস।

এখানে অবশ্য উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে নানা লিপিকারের কলমে মূল রচনার কিছু কিছু বিচ্যুতি ঘটে যায়।আর এটা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদিনের সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা সম্পর্কে অবহিত হতে সেসব পুঁথির কোনো বিকল্প নেই। শিলালিপির যুগ থেকে পুঁথি হয়ে আজকের সুমুদ্রিত দুই মলাটের গ্রন্হে ধরা আছে আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্য।তাই পুঁথির উপযুক্ত সংরক্ষণ, চর্চা, গবেষণা ইত্যাদি যেমন অতীতকে জানার জন্য খুবই প্রয়োজন, তেমনই তা ভবিষ্যতেরও দিশারী!


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.