সাইবার সেল এবং আমাদের নিরাপত্তা
রাজীব দত্ত
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্লোগান তুলেছিলেন প্রায় বছর পাঁচ ছয় আগে। আর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে ডিমনিটাইজেশান করলেন রাতারাতি। দেশের ৮০ শতাংশ ডিজিটালি নিরক্ষর গরীব মানুষ ‘ক্যশলেস’ ‘বারকোড’ ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করলো। ডিজিটাল লেনদেন থেকে শুরু করে ওয়েব দুনিয়ায় এখন মানুষ অনেকটাই স্বচ্ছন্দ। কিন্তু আজ কি হাল দেশের অর্থনীতির? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ্ স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে ঢেলে সাজাতে কোটি কোটি টাকার সংস্থান রেখেছেন বাজেটে। চায়নার মতো দেশ ওঁত পেতে আছে। ঘারে নিঃশ্বাস ফেলছে পাকিস্তান। যে কোনও সময় আঘাত হানতে পারে দেশের নিরাপত্তায়। কিন্তু আমরা কতটা তৈরি? আমাদের দেশ কতটা তৈরি? সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্থান, রাশিয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে আমরা দেখেছি আক্রমণকারী দেশের প্রথম লক্ষই থাকে ‘সাইবার অ্যাটাক’। সম্প্রতি ইউক্রেনের ব্যাংকিং সিস্টেমকে তছনছ করে দিয়েছে রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলিও রাশিয়ায় চেষ্টা চালায় সাইবার হামলার। বিভিন্ন মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত খবর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশ কতটা তৈরি এই ধরনের হামলা থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে? আমাদের সামগ্রিক ব্যাংকিং সিস্টেম কি আদৌ সুরক্ষিত? আমাদের ডিজিটাল লেনদেন এতো বছরেও কেন সুরক্ষিত হোল না? যদি হয় তাহলে কেন একজনের একাউন্টের অর্থ বিনা অনুমতিতে আরেকজন তুলে নেয়? কীভাবে এটিএম হ্যাক হয়? কীভাবে মানুষের নিজস্ব একাউন্ট থেকে অন্য কেউ নিমেষে অর্থ আত্মসাৎ করতে পারে? কি করে কোটি কোটি টাকা একটি শিশুর একাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে যায় সরকারী দপ্তর থেকে? প্রতিদিন কি করে হ্যাকাররা এভাবে মানুষকে সর্বস্বান্ত করতে পারে? কি করে জাল একাউন্ট তৈরি করে অপরাধীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সর্বত্র ফেইক নিউজ ছড়ায়? সর্বোপরি এই সব সাইবার জালিয়াতির ঘটনার তদন্তে কতটা সাফল্য পেয়েছে আমাদের সাইবার সেল বা তদন্তকারী পুলিশ?
অবশ্য ত্রিপুরা পুলিশের থানায় আজকাল মামলা নেই (পড়ুন পুলিশ মামলা নেয়না, থানার বাইরে মিমাংসা করায় অনেক বেশী সাফল্য ত্রিপুরা পুলিশের)। এফআইআর থাক, জিডি এন্ট্রি (জেনারেল ডায়েরি) নিতেও ভয় পায় এই রাজ্যের পুলিশ। খুনের, অপহরণের, রাজনৈতিক হামলার নয়, সামান্য অর্থ তছরুপের জেনারেল ডায়েরি নিতেও হাত-পা কাপে তাদের। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, আমতলী থানার ল্যাজেগোবরে অবস্থা। মামলা নেয়নি জনৈক ব্যাক্তির, থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে উল্টো মারধর করে এক যুবককে থানা থেকে তাড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ন্যাশানেল হিউম্যান রাইটস কমিশনের নোটিশ পেয়ে এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। থানার সিসি টিভি থেকে সংশ্লিষ্ট ঘটনার ফুটেজ ডিলিট করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখনও এঁদের লজ্জা হয়নি। আমতলী থানার এএসআই সুরেন দেববর্মা এবং এ দেব বর্মা থানায় কেউ জিডি এন্ট্রি করতে গেলে বলেন, ‘এইখানে আইয়া কি হইব? পুলিশের এতো সময় নাই। জিডি লেইখ্যা আনছেন, রাইখ্যা যান। দুই ঘণ্টা পরে আইয়েন। রিসিভিং দেয়ন যাইত না…’। থানার ওসি কে বলবো, ‘সিসি টিভি ফুটেজ যাতে থাকে, লোডশেডিং আসিল না। ক্যামেরা অন ঐ আসিল এবং রেকর্ড আসে সব। শুধু একবার রিউইন্ড কইরা দেইখ্যা লন আপনার অধস্থনরা কি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে থানার ভেতরে বসে’। এই থানা এবং পুলিশের বেতন চলে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় এটা নিশ্চই জানে থানাবাবুরা। হপ্তা থেকে বেতন, ভাতা হয়না। এই হাল রাজ্যের রাষ্ট্রপতির কালারস প্রাপ্ত ত্রিপুরা পুলিশের? অবশ্য বহুদিন আগেই ত্রিপুরা পুলিশ তাদের মেরুদণ্ড হারিয়েছে। আমতলী থানা এবং তার পার্শ্ববর্তী থানা এলাকা ক্রাইম জোনে পরিণত হয়েছে অনেকদিন। আমতলী বাইপাস ধরে চলেনা এমন কুকীর্তি নেই। এনিয়ে অন্য একটি প্রতিবেদনে কোনদিন বলা যাবে।
এই দেশে মানুষের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট না থাকলেও রাজ্যের এবং কেন্দ্রের বাজেটে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয় দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, সাইবার সেল এবং পুলিশকে চাঙ্গা রাখতে। কিন্তু আমরা কতটা সুরক্ষিত! আমাদের দেশ, আমাদের সার্ভার, অর্থনীতি, কতটা সুরক্ষিত? একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। ভারত সরকারের সাইবার ক্রাইমে আপনি অভিযোগ করতে গেলে প্রথমেই হড়কে যাবেন। কারন সাইবার সেলের হেল্প লাইন নাম্বার পাল্টে গেছে। নাম্বারটা ১৯৩০। এই নাম্বারে ফোন করলেই আপনাকে কম্পিউটার বলবে ত্রিপুরার বাসিন্দা হলে ৬ টিপুন। এরপরেই শুরু হবে ত্রিপুরার সাইবার এক্সপার্টদের একের পর এক ফোন। রীতিমতো ধ্মকে বলবে, ‘ফোন ধরেন না কেন’? অথচ এরাই কিন্তু ফোনটা কেটে দিচ্ছে বা কেটে যাচ্ছে। এরপর স্যার, ম্যাডাম, জি’হুজুর করে করে আপনি আপনার অভিযোগ বললেন, উনারা শুনলেন এবং সমাধান দেবেন, স্থানীয় থানায় জিডি ডায়েরি করুন এবং ন্যাশানেল পোর্টালে গিয়ে আপনার অভিযোগ রেজিস্টার করুন। সঙ্গে সঙ্গে একটি টেক্সট ম্যসেজও আপনার ফোনে আসবে। এবং ঐ টেক্সট ম্যাসেজে যাবতীয় ডিটেল এর সঙ্গে একটি লাইন লেখা থাকবে যে, ‘If fail your complain will be treated as invalid. Regards, National Cyber Crime Reporting Portal’ অর্থাৎ আপনি যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাইবার ক্রাইমের ন্যাশানেল পোর্টালে গিয়ে অন লাইনে আপনার অভিযোগ দায়ের করতে না পারেন তাহলে আপনার অভিযোগ ইনভেলিড হয়ে যাবে। এটা কেমন আইন?? বিশ্বাস করুন আপনি সারাদিন চেষ্টা করেও (যদি সাইবার সেলের কেউ না হয়ে থাকেন) অন লাইনে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না। এরপর হতাশ হয়ে আপনি হয়তো খুঁজতে শুরু করলেন রাজ্যের মহামান্য আধিকারিক কে আছেন, যিনি সাইবার সেল-এর প্রধান! খুঁজে পেলেন ৩৩ নাম্বারে অজিত প্রতাপ সিং (Dy. SP Crime) এবং সুব্রত চক্রবর্তী’র (AIGP Crime) নাম জ্বলজ্বল করছে। সুব্রত চক্রবর্তীর মেইল এড্রেস ([email protected])। ভাবলেন একটা মেইল করেই জানাই, ত্রিপুরার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া স্যারেরা সাহায্য তো করবেই। কিন্তু মেইল এড্রেসটাই ভুল। যদি সাইবার সেলেই আধিকারিকদের মেইল এড্রেস খুঁজে না পায় গুগল এবং জন সাধারণ তাহলে অপরাধীকে পাবে কি করে পুলিশ?
এরপর ভাবলেন এইবার থানায় যাই। পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে বলে দিয়েছেন সাইবার ম্যাডাম (!) স্থানীয় থানায় গিয়ে জিডি করতে। থানায় গেলেই ডিউটি অফিসার বলবে, ‘লেইখ্যা আনছেন জিডি দিয়া যান’। আপনি এবার রিসিভিং চাইলেন, ডিউটি অফিসাত মিঃ দেববর্মা বলবেন, ‘অখন হইত না। দুই ঘণ্টা পরে আইয়েন…।‘ এইবার আরেক ছোট কর্তা মিঃ সুরেন দেববর্মা সাহেব সরকারী চেয়ারে বসে আপনাকে উল্টে চোর-ডাকাত টাইপ জেরা শুরু করে শেষে বলবে, ‘পুলিশ কিতা করতো? পুলিশের কি কাম নাই নি?’
ঠিকই তো পুলিশ কি করছে? কিইবা আর করবে? এবং কি করবে আগামীদিনে সেটাও এই রাজ্যের মানুষ ভালো করেই জানে, দেখেছে এবং দেখছে। কিন্তু এই রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী জানেন কি? তিনি কি জানেন উনার পুলিশের কিছুই করার নেই? নিন্দুকেরা বলে, তিনি জানেন সবই। উনার নির্দেশেই পুলিশ মামলা নেয়না। ন্যাশানেল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোতে এই রাজ্যের ক্রাইম রেশিও দেখে স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীরও নাকি মাথায় হাত। এইবার আমি নিশ্চিত জানি, ‘পুলিশ মামলা লইয়া কাদম্বিনীর মতো প্রমান করিবেন উনারা বাঁচিয়া আছেন। এবং এই প্রতিবেদকের উপর প্রথম মামলা সাজাইয়া এবং লিপিবদ্ধ করিয়া প্রমান করিবেন উনারা জীবিত হইয়াছেন’। মনে রাখা দরকার সবাই ‘অন রেকর্ড’ থাকে আজকাল।
দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। তারা বোঝেনা ডিজিটাল লেনদেন, সাইবার-ল, সাইবার ক্রাইম, হ্যাক, ন্যাশানেল পোর্টাল, অনলাইন এফআইআর ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশের একটা বৃহত্তর অংশের মানুষ এই সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে বা অনলাইন ব্যাংকিং প্রতারনা সম্পর্কে কোন ধারনাই রাখেন না। জানেনা হেল্প লাইন নাম্বার। ১০০ নাম্বারকে ১০০ বার ডায়েল করলে তবে লাইন পাওয়া যায়। ততক্ষণে সব শেষ। অর্থাৎ অপরাধী, অপরাধ করিয়া সুখনিদ্রায় আচ্ছন্ন। তখন পুলিশ জাগেন। এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমেই ফোন দেয় স্থানীয় শাসক দলের নেতাকে। এরপর রফা হয়। রফা না করলেই উল্টো মামলা, এফআইআর চেপে দেয়া হয়। আসামিকে থানায় ডেকে বিরানি মাংস সহযোগে মহান বানিয়ে পুলিশের তদন্তকারী অফিসার মুক্তা, হীরারা ট্রেন্সফার বা প্রমোশন হাঁকায়। অন্যদিকে এফ আই আর করতে গিয়ে নিরপরাধীই, অপরাধী বনে গেলেন। পুলিশের মাথায় রাখা দরকার সরকারী চেয়ারগুলি কোন দলের বা সম্প্রদায়ের নয়। সরকারী চেয়ারগুলির অন্তত মর্যাদা রাখা দরকার। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ওয়েব দুনিয়ায় প্রতারনার শিকার হচ্ছেন, কিন্তু এই প্রতারনার ঘটনার কোন তদন্ত নেই। হলেও নাম কে ওয়াস্তে।
সর্বোপরি একবার ভেবে দেখা উচিৎ এই সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে এবং পুলিশ নিয়ে আমরা কতটা সুরক্ষিত? দেশ, দেশের অর্থ ব্যবস্থা, জাতীয় সার্ভার, এবং জাতীয় নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে এই প্রশ্নগুলি কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য অরুনাচলে ওঁত পেতে বসে আছে চায়নার মতো দেশ। আমাদের রাজ্যের চারদিকেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত। যে দেশের নাগরিক এবং তাঁর সম্পত্তি সুরক্ষিত নয় নিজ দেশের অন্দরেই, সেই দেশ কি করে সুরক্ষিত থাকবে বিদেশী শ্ত্রুর সামনে? সময় থাকতেই ভাবা দরকার। সর্বোপরি দেশের সার্বিক সাইবার নিরাপত্তার আধুনিকীকরণ দরকার। ব্যাংকিং সিস্টেমকে আরও সুরক্ষিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন পুলিশের মানবিক হওয়া। দল, রাজনীতি, মন্ত্রী-সান্ত্রী আজ আছে কাল নেই, কিন্তু পুলিশের ইতিহাসে কিন্তু সব লেখা থাকছে।