রাজনীতি মুক্ত হোক বইমেলা
রাজীব দত্ত
সামনেই বই মেলা শুরু হচ্ছে। আগরতলা বই মেলা এখন যৌবনে। বইমেলাকে ঘিরে আবারও বই পিপাসুরা মেতে উঠবে কিছুদিন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর খুব চোখে পড়ে কিছু বিষয় যা সত্যিই এই মেলার ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকে দিন কে দিন ম্লান করে দিচ্ছে।
রাজা মহারাজারা তাদের সভায় সব সময়েই কিছু রত্নকে স্থান দিয়ে থাকতেন। উদ্দেশ্য একটাই এই সভাকবি বা রাজ কবিদের দিয়ে শাসক নিজেদের গুণগান করিয়ে নিতেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণাও নাকি নিজের গুণগান করতে গীতার রচনা করেছিলেন। এমনটাই দাবী অনেক ঐতিহাসিকদের। এখনও রাজ কবি বা সরকারের পছন্দের কবি তালিকা তৈরি করা হয় সরকারী দপ্তরে বসে। অথচ কস্মিনকালে এই কবি নির্বাচকরা একটি কবিতা পড়েছে কিনা এনিয়ে সন্দেহ হওয়াটাই কিন্তু স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, কবিতা পাঠের আসরেও চলে রাজনৈতিক আস্ফালন। সত্যিকারের কবি সাহিত্যিকরা আজ ব্রাত্য। রাজনৈতিক দলের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের রংটাও পাল্টে যায়। পাল্টে যায় কবি সাহিত্যিক দের মুখও। সত্যিই অবাক হওয়ার মতো এই রাজনীতিকরণ। কিন্তু বইমেলার প্রকৃত ইতিহাস জানলে কিন্তু অবাক হতেই হয়। বই মেলা শুধুই একটি মেলা বা বাণিজ্য নয়। দেখে নেয়া যাক বইমেলার ইতিহাস।
পৃথিবীর প্রথম বইমেলা কবে শুরু হয়! কীভাবে শুরু হয়! কেনই বা বই মেলার আয়োজন! প্রতিবছর সারা পৃথিবীজুড়ে উদযাপন হয় হাজারো উৎসব। কিন্তু বইয়ের উৎসব ঘিরে মানুষের আবেগ অন্য রকম। নতুন বইয়ের গন্ধে আর কত অজানা সব বিষয় নিয়ে উৎসাহী মানুষ এই ডট কম-এর যুগেও গিয়ে ভিড় করে বই মেলায়। আজকের জেনারেশান যেখানে ডিজিটাল লাইফেই অভস্থ সেখানে বই স্ব-মহিমায় একটা আস্তো মেলার আঙ্গিকে আমাদের সামনে হাজির হয় প্রতিবছর। ওয়েব দুনিয়ার পাশাপাশি ছাপার কালি-কাগজের দুনিয়া নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিজেই অক্ষুণ্ণ রেখেছে নীরবে। আর প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে এক অনন্য বিপ্লব।
বিশ্বের প্রথম বইমেলা শুরু হয় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বইমেলা শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গ থাকতেন ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে সামান্য দূরের মেঞ্জ শহরে। তার আবিষ্কৃত ছাপাখানার যন্ত্র বইয়ের জগতে নিয়ে আসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তিনি নিজের ছাপাখানার যন্ত্রাংশ এবং ছাপানো বই বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে আসেন।
গুটেনবার্গের দেখাদেখি ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসতে থাকে। আর এগুলো কিনতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষও আসতে শুরু করল। সেই আসা-যাওয়া থেকেই জমে উঠতে থাকে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে এই মেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় ‘জার্মান প্রকাশক সমিতি’। আর ১৯৬৪ সাল থেকে এই মেলা পেয়ে যায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। অক্টবরের মাঝামাঝি সময়ে এই মেলা শুরু হয়। মেলার সময়কাল পাঁচ দিন। মেলার আয়োজক জার্মান পাবলিশার অ্যান্ড বুক সেলার অ্যাসোসিয়েশন। প্রতি বছরই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার প্রকাশক, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, দর্শক ও সাংবাদিক সহ বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে এই মেলা প্রাঙ্গণ।
বইয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পৃথিবীতে প্রথম দিকে মানুষ গাছের বল্কলে, গুহায়, পাথরের গায়ে লেখালেখি করতো। আজ থেকে পাঁচ সাতশ বছর আগে যখন মানুষ প্রথম ছাপা যন্ত্র আবিস্কার করলো তারপর থেকেই নীরবে ঘটে গেলো এক রেনেসাঁ। ইতিহাস বলছে প্রথম নাকি বাইবেল এর কয়েকটি অধ্যায় ছেপেছিলেন গুটেনবার্গ সাহেব। তবে পৃথিবীর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘গিলগামেশ’, যা প্রায় চার হাজার বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় লেখা হয়েছিল। বর্তমানের ইরাক আর সিরিয়াজুড়ে ছিল সেই মেসোপটেমিয়া। লেখকের নাম জানা যায়নি।
বইটা কেন লেখা হয়েছিল, কে তার পাঠক ছিল, সেসবও কেউ জানে না। বইটি ব্রিটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে মাটির ফলকে। পৃথিবীর প্রাচীনতম বর্ণমালা কিউনিফর্মে (কীলকাকার) লেখা হয়েছিল বইটি। এই নাম এসেছে অক্ষরগুলোর আকার থেকে। তখনকার লিপিকারেরা কাদামাটির ওপর নলখাগড়া দিয়ে কীলক খোদাই করে লিখতেন।
হাজার হাজার বছর ধরে কেউ এই লেখা পড়তে পারেনি। ১৮৭০ সালে জর্জ স্মিথ নামে লন্ডনের এক শ্রমজীবী মানুষ ব্রিটিশ জাদুঘরের এই মাটির ফলক দেখতে দেখতে তার পাঠোদ্ধার করেন। ফলে গিলমামেশ–এর গল্পটা আমরা জানতে পারি।
‘গিলগামেশ’ এর গল্পে কি লেখা ছিল? গিলগামেশ ছিলেন উড়ুক প্রদেশ যা বর্তমানে ইরাকের দক্ষিণে অবস্থিত শহরের রাজা। তাঁর মা ছিলেন একজন দেবী। গিলগামেশ একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন। গ্লেজ করা ইট দিয়ে তিনি এক অসাধারণ সুন্দর শহর তৈরি করেছিলেন, যা ছিল অভিনব প্রযুক্তি। অথচ তিনি ছিলেন নারীলিপ্সু আর অত্যাচারী। বিয়ের আসর থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে আসতেন তিনি। এই কারণে দেবতারা মিলে ‘এনকিডু’ নামের এক বন্য মানুষ তৈরি করেন উড়ুকের বাসিন্দাদের নিপীড়ন থেকে উদ্ধারের জন্য। এনকিডু ছিলেন দেবীর হাত থেকে ঝেড়ে ফেলা মাটি দিয়ে তৈরি আধা মানুষ, আধা পশু, যাঁর সারা শরীর লোমে ভরা আর যিনি গাজেলাদের সঙ্গে ঘাস খেয়ে বড় হন।
পরে কীভাবে তিনি পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠেন, গিলগামেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিস্তার এবং তার কারণে গিলগামেশের মানসিক পরিবর্তন, পৃথিবীর সুরক্ষার জন্য তাঁদের একসঙ্গে যুদ্ধের কথা আছে এই উপন্যাসে। আর আছে শেষ পর্যন্ত গিলগামেশের উপলব্ধি। যত বড় বীরই হোন না কেন, মৃত্যুকে জয় করতে পারে না কেউই। ২০১১ সালে গিলগামেশ-এর দ্বিতীয় একটা ফলক উদ্ধার হয়েছে। এখন সেটা আছে ইরাকের সুলায়মানিয়া জাদুঘরে।
প্রথম বইমেলার ইতিহাস অবশ্য সে তুলনায় অনেক নতুন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা এখন যেখানে অনুষ্ঠিত হয় জার্মানিতে। জার্মানির সেই ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরেই পৃথিবীর প্রথম বইমেলা হয়েছিল। এর ইতিহাস ৫০০ বছর পুরোনো। বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপের বাণিজ্য ও ব্যাংকিংয়ের কেন্দ্রে ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর। সেই সুবাদে ফ্রাঙ্কফুর্টাস মেসের কথা সেই দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই শোনা যায়। বেশ কিছু সূত্র থেকে জানা যায়, সেই ১৪৭৮ সাল থেকেই এখানে বইমেলা হতো এবং তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পিটার ওয়েডহাস এই মেলার একজন পরিচালক ছিলেন ১৯৭৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। তাঁর একটা বই আছে, ‘আ হিস্টি অব দ্য ফ্রাঙ্কফুর্ট বুকফেয়ার’ (ফাঙ্কফুর্ট বইমেলার ইতিহাস) নামে।
সেখানে তিনি লিখেছেন, রাজা অষ্টম হেনরি নাকি স্যার টমাস বোডলিকে এই বইমেলায় পাঠিয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন লাইব্রেরির জন্য বই কিনতে।
পরবর্তীকালে, সম্ভবত রানি মেরির রাজত্বকালে (ধর্মের নামে গণ নিধনের কারণে যাঁর ডাকনাম হয়েছে ব্লাডি মেরি) নিষিদ্ধ বইয়ের এক তালিকা বানানো হলো। মেলার বহু বই ছিল সেই তালিকায়। এ কারণে ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রকাশনা ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্তও হয়। ১৭ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, প্রটেসন্ট্যান্ট শাসনাকালে ফ্রাঙ্কফুর্টকে ম্লান করে দিয়ে লেইপজিগ শহর প্রকাশনা বাণিজ্যের কেন্দ্রে চলে আসে। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৪৯ সালে ২০৫টি জার্মান প্রকাশনীকে নিয়ে নতুন উদ্যমে চালু হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলা। সেই মেলাই এখন আন্তর্জাতিকভাবে বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর অক্টোবর মাসে। আলবেনিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে পর্যন্ত প্রায় ১০০টি দেশ থেকে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ প্রকাশনী এতে অংশগ্রহণ করে।
ছাপা যন্ত্রের আবিস্কারক গুটেনবার্গ রেনেসাঁ ঘটিয়েছিলেন আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে। আর আজকের দিনে বই মেলার এই অনবদ্য ইতিহাসকে আমরা রাজনৈতিক মেরুকরণ করছি। কবি, সাহিত্যিক, লেখক বুদ্ধিজীবী যদি চুপ মেরে যায় তাহলে সভ্যতা একসময় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। আজ কিন্তু তাই হচ্ছে। ‘মানুষ বড় কাঁদছে…’। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী বিপন্ন। এই বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়েই হয়তো সম্ভব আরেকটা রেনেসাঁ। কিন্তু কে পথ দেখাবে? ভগবান নিদ্রা গেছেন…।