গল্প - অসমীকরণ
দেবারতী দত্ত
পুরো সপ্তাহ ব্যস্ততার মধ্যে কাটে তিতাসের। সকালে উঠেই কাজে লেগে পরে। একার হাতেই সব দায়িত্ব সামলাতে হয় তার। তিতাস সরকারি অফিসে চাকরি করে। তাই তাকে বাড়ি থেকে ন'টায় বেরিয়ে পড়তে হয়, তা না হলে দশটার মধ্যে পৌঁছোতে পারবে না। তাই তার সকালটা ঘরে থাকা মেয়েদের মত অলস ভাবে কাটে না। তিতাস বিয়ের মত একটা গতানুগতিক প্রথায় নিজেকে জড়ায়নি বা বলতে পারো জড়াতে চায়নি। নিজের আত্মসম্মান বোধ নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে একাই। মেয়েরাও যে একা ভালো ভাবে থাকতে পারে তার প্রমাণ করে দিয়েছে তিতাস।
নিজের রোজগারের টাকায় শহরের আভিজাত্য এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। গাড়ি চালানো ছিল তার একটা প্যাশন। মন খারাপ বা কাজের একঘেয়েমি থেকে মনকে ফুরফুরে রাখতে লংড্রাইভ হলো তার একমাত্র উপশম। আরেকটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি, তিতাসের বাঁচার অক্সিজেন ছিল গান। সব রকম গান নয়, গানেরও কিছু রকমফের ছিল। এই সময়ের আর্টফিল্ম গুলির কিছু গান, গজল ও রবীন্দ্র দখল করে নিয়েছিল তার মোবাইলের মিউজিক ফোল্ডার। বলা যায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গানই তাকে কাজের উৎসাহ দিয়ে থাকে। তিতাসের মুড ভালো রাখতে বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া আর তার সাথে পছন্দের গান হলেই চলে। এমন ভাবেই তিতাসের দিন কেটে যেতো। কোনো অভিযোগ ছিল না তার কারোর উপরেই। নিজের মত করে বাঁচতো সে।
কিছুদিন হলো নতুন ভালো লাগারা এসে ঘর বেধেছে তিতাসের মনে। প্রকৃতির রোজকার জীবনকে ক্যামেরাবন্দি করা, আবার ব্যালকনি কে শীতের মরসুমী ফুল দিয়ে সাজানো। নতুন ভাবনারা ভিড় জমায় তার গোপন ডেরায়। তিতাসের ক্যামেরায় কত কত ছবিরা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফটোগ্রাফিটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছে সে। ভোরে উঠে গাছগুলোতে জল দিয়ে, আদর করে ঘুম ভাঙায় তাদের। হঠাৎ একদিন তিতাস আবিস্কার করলো তার ব্যালকনিতে দুটো চড়ুই পাখি আপন মনে রেলিংয়ের একটা ধারে বসে আছে। সে অপলক দৃষ্টিতে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন থেকে নিয়ম করে তিতাস বারান্দার এক কোণে তাদের জন্য ছোট্ট পাত্রে জল রাখে। ঐ সুখ পাখির জোড়া এসে জল খেতো, কিছুক্ষণ জল নিয়ে খেলাও করতো আবার উড়ে যেত। তিতাস তাদের গোপন প্রেমের মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে রাখতো। কি জানি ওই জোড়া পাখি তিতাসের জীবনে এক নতুন বসন্ত নিয়ে আসবে কিনা? নাকি আবার সব এলোমেলো করে দেবে?
রবিবারটা আসলে তিতাস একটু রিলাক্স থাকে। অফুরান সময় থাকে নিজের ভালো লাগাদের সাথে সময় কাটানোর। ঠিক আজকের দিনটাও শুরু হলো তার পছন্দের গান দিয়ে- " তুমি হয়তো বহুদূর, তবুও তোমার কথার সুর, দেখো বাজছে আমার বেসুরো জীবনে"। গানটা শুনতে শুনতে, ব্যালকনিতে চা নিয়ে আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইল তার নিজের হাতের তৈরি সখের ছোট্ট ফুল বাগানে। হঠাৎ তার ভাবনায় ছন্দ পতন ঘটল কলিংবেলের শব্দে। সে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেখল একজন ফুলের তোড়া হাতে দাড়ানো। লোকটা বলল " ম্যাডাম আপনি কি তিতাস সেন?" উত্তরে বলল হুমম আমিই তিতাস। আপনার জন্য আমাদের ডাইরেক্টর স্যার এই গিফট্ টা পাঠিয়েছেন। এই বলে লোকটা চলে গেল। তিতাস ঠিক কিছুই বুঝতে পারলো না। দরজা বন্ধ করে ঘরে এলো। কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর আস্তে আস্তে উপহারটা খুললো। দেখল একটা বাক্স, তাতে রয়েছে তিতাসের কয়েকশো ছবি। তিতাস যা একেবারে মুছে ফেলেছিলো জীবন থেকে, ঠিক দশ বছর পরে আবার সেই মানুষটা এসে কড়া নাড়লো তার মনের দরজায়। মনে মনে ভাবল অভ্র আজও দিনটা ভোলেনি। দীর্ঘ দশ বছর পরেও মনে হয় সেইদিন ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। তাদের স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটি'তে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত। একসাথে কাটানো সব স্বপ্নীল দিনগুলো কেমন এক লহমায় ধুয়ে-মুছে শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তারপর যা ঘটেছিলো সেটা ছিল ইগোর লড়াই। দুজনের মধ্যে ইগো নামক তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশে তাদের সম্পর্কের ভাঙ্গন ধরেছিলো। যা কখনো জোড়া লাগানোর চেষ্টাই করেনি তিতাস। হয়তোবা ভুল বোঝার হিসেবটা অভ্রই কষেছিলো। তাই অংকের সঠিক যোগফলটা তিতাসের কাছে আজও অধরা। একটা চিঠি ও ছিল তার জন্য। তাতে লেখা ছিল- দুজন মিলে হারানো সূত্র মেলাবো বলে দীর্ঘ দশ বছরের অপেক্ষায়। তোমার চেনা ঠিকানা আজও আছে শেষ প্রতীক্ষায়... ।
তিতাস সযত্নে তার শূন্য ফুলদানি সাজিয়ে তুললো অভ্র র ভালোবাসায়। সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি তিতাস। পরের দিন ঘুম ভাঙতেই বেড়িয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। গাড়ির কাঁচ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছিল কুয়াশায়। তাও তিতাস ছুটে যাচ্ছিল কিন্তু কেন? দশ বছরের অপেক্ষার ইতি টানবে বলে? নাকি অভ্র র ওপর জমে থাকা একরাশ অভিমানের হিসেবে চাইবে বলে? ঠিক তখনই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। ওপার থেকে পুরুষ কন্ঠে কেউ বলল- " ম্যাডাম! স্যারকে শেষ দেখাটা দেখবেন না" ?