বীরবিক্রমঃচিঠিপত্রে ধরা পড়েন এক ব্যতিক্রমী রাজা
পান্নালাল রায়
একজন রাজা তাঁর এক পদস্হ প্রবীন কর্মচারীকে প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখছেন। শুধু এই বিষয়টি থেকেই ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রমের বিনয়ী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে।১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে পিতা বীরেন্দ্র কিশোরের মৃত্যুর পর রাজা হন তিনি। রাজকুমার অবস্হায় বীরবিক্রমের গৃহশিক্ষক ছিলেন অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী সময়ে তিনি দেওয়ান,নিজ তহবিল সচিব পদে কর্মরত ছিলেন। মহারাজা রাজ্যান্তরে বা বিদেশ সফরে গেলে নিয়মিত আগরতলায় তাঁকে চিঠি লিখতেন । রাজা তাঁকে চিঠির শুরুতেই লিখতেন 'প্রণাম জানিবেন', আবার শেষেও লিখতেন 'প্রণাম জানিবেন'। রাজা যে কতটা বিনয়ী,উদার ও রুচিশীল ছিলেন তা স্পষ্ট ধরা পড়ে তাঁর চিঠিপত্রে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে বীরবিক্রমের চিঠিপত্রে যেন ধরা পড়েন এক অন্য রাজা।কখনও তিনি রাজ্যের আয় বাড়াতে লটারির কথা ভাবছেন, কখনও রাজ্যের উন্নয়নে রাস্তা নির্মাণের কথা বলছেন।কখনও আবার ত্রিপুরায় চিনিকল বসাবার উদ্যোগের কথাও জানা যায় রাজার চিঠিতে।
কলকাতায় বড়লাট সাহেবের সঙ্গে ডিনার করার কথা জানিয়ে রাজা আগরতলা থেকে লাটসাহেবের জন্য আনারস পাঠানোর কথা বলেন চিঠিতে। রাজা তাঁর নিজ প্রয়োজনে টাকার চাহিদার কথা বলছেন বিনয়ের সঙ্গে। তিনি চেক্ কাটবেন,ব্যাঙ্কে যেন টাকা জমা দেয়া হয়।
ত্রিপুরায় চালু বিভিন্ন নির্মাণ কাজ সম্পর্কেও কলকাতায় বসে চিন্তা করেন রাজা। উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারীকে বলেন--'দুমদুমীয়ার রাস্তার কাজ বন্ধ করিবেন না।' 'বাংলার কাজে ঢিলা দেবেন না এই অনুরোধ।' আবার ইউরোপ সফরকালীন সময়ে লন্ডন থেকে দেওয়ানকে তিনি লিখেন--'ভারতের গোলমাল সম্বন্ধে আমরা সর্ব্বদা খবর পাই। আপনার এতটা ভয় করিবার কোন কারণ নাই।.... ইংল্যান্ডে Reception ইত্যাদি ভালই হইতেছে।....'
১৯৩০ সালে মহারাজা বীরবিক্রম প্রথম ইউরোপ সফরে গিয়েছিলেন।প্রায় আট মাস ব্যাপী সেই দীর্ঘ সফরে রাজা তাঁর সফর সঙ্গীদের নিয়ে ইওরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরেছিলেন। সেবার ১৩ মে থেকে ১২ জুন এক মাস তিনি লন্ডনে ছিলেন।
বীরবিক্রম ত্রিপুরার উন্নয়নের ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট ছিলেন। বাইরে গেলেও সেখান থেকে তিনি রাজ্যের উন্নয়নের কথাই ভাবতেন। উন্নয়ন মূলক কাজ যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্য নির্দেশ দিতেন।১৯৩২ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে রাজা লিখছেন--'... পুকুর সম্বন্ধে সুপার ভাইসর ও এনজিনিয়ার প্রভৃতির মত লইয়া কার্য্য করিবেন।দুমদুমীয়ার রাস্তার কাজ বন্ধ করিবেন না।লক্ষ্ণীলুঙ্গা....পরও আমাদের অনেক রাস্তা করিতে হইবে। আগে এলাইনমেন্ট করিয়া তারপর রাস্তা করিবেন।... এখানে সব ভাল।লাট ও বড়লাটের সঙ্গে দেখা হইয়া গিয়াছে।প্রণাম জানিবেন।'
১৯৩৩ সালের ২২ ডিসেম্বর রাজা কলকাতা থেকে এক দীর্ঘ চিঠিতে 'নিজতহবিল' সচিব শ্রী মুখোপাধ্যায়কে লিখছেন--"আজকাল একটু ব্যস্ত আছি-একদিকে Govt. House functions অপরদিকে family functions... water works:-সম্বন্ধে যেখানে সস্তা হয় সেখানেই Order দিবেন।....
Band Stand:-ইহার পিলার ও গোল থাম্বা হবার কথা, খুব সম্ভব সুরকীতে পারা যাইবে।... ইঞ্জিনীয়ার কি Plan করিয়াছে।Planর একটি কপি আমার নিকট পাঠাইয়া দিতে বলিবেন।.....যেখান থেকে হউক টাকার জোগার করিয়া ইট কাটাইয়া ফেলুন কাজে লাগিবে।ট্রলী লাইনও বসাইয়া কাজ আরম্ভ করিয়া দেন।
...চিনির কল সম্বন্ধে কি করিতে বলেন। আপনার যখন ইচ্ছা হইয়াছে একটি কলের Order দিতে পারি--কোথায় পাওয়া যাইবে জানিয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখিব।.....
আমার পূর্বের পত্রে জানাইয়াছি Bank হইতে নিজের প্রয়োজনে মং ২০০০ হাজার টাকা চেক কাটিয়াছি। আরও চেক কাটার দরকার হইতে পারে-কাজেই কিছু টাকা Bankয়ে পাঠাইবার দরকার হইবে বলিয়া মনে হয়।এখন কিছু টাকা পাঠাইয়া দেন-কত টাকা আমার নিজের প্রয়োজনে, অর্থাৎ বাস্তবিক পক্ষে নিজের প্রয়োজন নহে In connection with the birth of a Son, লাগিবে তাহা পরে জানাইব।...."
এখানে উল্লেখ করা যায় যে,১৯৩৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় মহারাজা বীরবিক্রমের পুত্র কিরীটি বিক্রমের জন্ম হয়েছিল। রাজা ২২ ডিসেম্বর পুত্রের জন্ম সংশ্লিষ্ট কারণে আগরতলায় টাকার প্রয়োজনের কথা লিখেছিলেন।ডিসেম্বর মাসে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো রাজা কলকাতায় অবস্হান করছিলেন।
১৯৩৫ সালের ৭ আগষ্ট শিলং থেকে রাজা লিখেছেন--"...ঢাকা...রেল হইলে রাজ্যের আয় দেড়গুণ না বৃদ্ধি হইলেও কিছু বৃদ্ধি হইবে সন্দেহ নাই।
আজ এখানে বৃষ্টি হইয়াছে আশা করি ঐ.... বৃষ্টি হইয়া থাকিবে।P.W.D-র কাজ আস্তে আস্তে চলুক বন্ধ না হইলেই হইল।কোটকের বিবাহ হইতেছে শুনিয়া বরই আনন্দিত হইলাম, ভগবান তাহার মঙ্গল করুন।
এবারে লটারীটিকেSuccess করিতে হইবে... সেই জন্যই আপনার হাতে দিলাম- টিকেট ছাপা হইল কিনা জানাইবেন-টিকেট যত অধীক ছাপাইবেন তত টাকাও পাওয়া যাইবে।
আগামী কল্য মশুরী রওয়ানা হইতেছি।..."
সম্ভবত রাজ্যের রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মহারাজা বীরবিক্রম লটারির জন্য উৎসাহী ছিলেন। উপরোক্ত চিঠিতে 'এবারের লটারীটিকে' সফল করার কথা বলার মধ্যেই বোঝা যায় যে,আগেও এরকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। হয়তো তা সফল হয়নি।
১৯৩৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শিলং থেকে লেখা অপর এক চিঠিতেও রাজা লটারির সফলতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে লিখেছিলেন--"এবার লটারীটিকে একটা Grand Success করিতেই হইবে এবং শীঘ্র আরম্ভ হওয়া দরকার।"
সেপ্টেম্বরের এই চিঠিতে রাজা আরও লিখেছিলেন--"Palace Garden-য়ে চূনার Stone বসান কি হইল? এবং আঠার মালিকের কি অবস্থা? হাতি পাড়াতে... বসাইতে পারেন।
দালান হবার আগে আর বধূমাতাকে ঐ কুড়ে ঘড়ে আনিবেননা-বড় ঘড়ের মেয়ে কি না।
চারীপাড়া তাল্লুকে নূতন প্রজা বসান একান্ত...সাবেক প্রজা জাহাতে না চলে যায়...ব্যবস্হা হওয়া দরকার প্রয়োজন হইলে খাজানা...উচিৎ।..."
উপরোক্ত চিঠিগুলো থেকে মহারাজার কর্ম তৎপরতা ও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির একটা স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।রাজ্যের বাইরে অবস্থান কালেও ত্রিপুরার রাস্তাঘাট, নানা নির্মাণকাজ,রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য প্রজা বসানো, লটারি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি নিয়মিত নির্দেশ পাঠাতেন আগরতলায়।'নিজতহবিল'সচিব অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে রাজা খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয়ে অবহিত করতেন।এইসব চিঠিপত্রে যেন ধরা পড়েন এক ব্যতিক্রমী রাজা। ধরা পড়েন উদার, রুচিশীল, উন্নয়ন প্রয়াসী এবং বিনয়ী বীরবিক্রম।