ই আর সি পি : একটি অভিনব প্রক্রিয়া

ডা. অমিতাভ রায়, পেট ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ

আশিস বাবুর পেটে ব্যাথা সারার নামই নিচ্ছিল না৷ ক’দিন পর জন্ডিস দেখা দেয়৷ কিন্তু সোনোগ্রাফিতে তেমন কিছুই ধরা পড়েনি৷ পিত্তথলীতে কোনও পাথর নেই৷ পাথর বাইল ডাক্টে নেই৷ এম আর সি পিতে পিত্তনালীতে কিছু সমস্যার আঁচ পাওয়া যায়৷ রোগটা পরিস্কার করে নির্ণয় ও উপাচারের জন্য তিনি বহির্রাজ্যের দিকে ছুটলেন৷ সুখ্যাত এক হাসপাতালে তার ই আর সি পি হলো৷ পিত্তনালীতে বর্জ্য জমে পথটা একেবারে সরু হয়ে গিয়েছিল৷ সে পথ সারাই হলো৷ তিনিও সেরে উঠলেন৷ আকর্ণ হাসি সমেত আগরতলায় ফিরলেন৷

এই সমস্যার জন্য আশিস বাবুদের বাহর্রাজ্যে ছোটার প্রয়োজনীয়তা এখন কেটে গেছে বলে দাবি করাই যায়৷ এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোলাঞ্জিওপেনক্রিয়াটোগ্রাফি অথবা ই আর সি পি এখন আগরতলাতেও সম্ভব। এটা মূলত একটা এন্ডোস্কোপিকবিধি এটা তার নামেই পরিস্কার৷ যেটা পিত্তথলি, পিত্তনালী এবং অগ্ণাশয়ের নালীর পরীক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য করা হয়৷

পিত্তথলিতে পাথরের সমস্যা আমাদের রাজ্যে সচরাচর দেখা যায়৷ যদি পিত্ত থলি থেকে পাথর বেরিয়ে পিত্তনালীতে পৌঁছে যায় তাহলে জন্ডিস হয়৷ কখনো কখনো পিত্তনালীর মধ্যেও পাথর তৈরি হয় যা পিত্তনালীকে ব্লক করে এবং জন্ডিস হয়৷ এই দুই অবস্থাতেই পিত্তনালীর থেকে পাথর বের করে আনতে ই আর সি পি-ই কার্যকর৷ আমাদের দেশে পিত্তথলি, পিত্তনালী এবং অগ্ণাশয়ের ক্যান্সারও খুব সচরাচর দেখা যায়৷ এই তিন ক্যান্সারই পিত্তনালীতে ব্লক তৈরি করে৷ যেহেতু পথ আটকে যাওয়ায় পিত্ত লিভার থেকে আসতে পারে না এজন্য জন্ডিস হয়ে যায়৷ ই আর সি পি’র মাধ্যমে এই বাধা অপসারণ করা যায়, স্টেন্ট লাগানো যায় যাতে ঐ নালী দিয়ে সুচারুভাবে পিত্তরস বা অগ্ণাশয় থেকে নির্গত রস খাদ্যনালীতে যেতে পারে৷

কখনও কখনও পিত্তনালীতে ইনফেকশন হয়৷ তখন সেখানে বর্জ্য জমে যায়৷ সে ক্ষেত্রেও ই আর সি পি’র প্রয়োগ করা হয়৷ পিত্তথলীর অপারেশনের সময় পিত্তনালীতে লিক হয়ে গেলে স্টেন্টের মাধ্যমে রস নির্গমণ রোখা যায়৷ এম আর আই, সিটি স্ক্যান, এম আর সি পি, আল্ট্রাসাউন্ড-এ যদি এমন কিছু রিপোর্ট আসে যে পিত্তনালীতে কোনও সমস্যা আছে তাহলেও সেটা দেখে উপাচারের জন্য ই আর সি পি’র দরকার পড়ে৷ যেমনটা আশিস বাবুর ক্ষেত্রে হয়েছিল৷

Tripurainfo-ERCP-A-fancy-process-Dr-Amitabh-Roy-Stomach-and-liver-disease-specialist-1.png

কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

ই আর সি পি মূলত আউট ডোর প্রসিডিউর৷ হাসপাতালে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা থাকার দরকার পড়ে৷ রোগীকে ৮ ঘন্টা খালি পেট থাকতে হবে৷ জল পর্যন্ত খেতে পারবেন না৷ রোগী যদি রক্ত তরল করার মতো ওষুধ যেমন এসপিরিন খান তাহলে তা চিকিৎসকের জানা থাকতে হবে৷ ই আর সি পি’র জন্য পিত্তলানীর মুখে খানিকটা কাটতে হয়৷ তাই রক্তপাত হতে পারে৷ অতিরিক্ত রক্তপাত ম্যানেজ করতে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী৷ রোগী যদি রক্তচাপ বা ডায়বেটিসের ওষুধ যদি খান তবে ৮ ঘন্টা আগে তা খেয়ে নিতে হবে৷ ৮ ঘন্টার মধ্যে আর কিছু খাওয়া যাবে না৷

সাধারণত রোগীকে ডে কেয়ারে রাখা হয়৷ ইন্টারভেনাস কেন্যুলা লাগানো হয় যাতে আই ভি ফ্লুইড, এন্টিবায়োটিক, ভিটামিন-কে দেওয়া যায়৷ ই আর সি পি বিধিতে দুই রকমের উপকরণ ব্যবহৃত হয়৷ এন্ডোস্কোপিক উপকরণ এবং সি আর্ম এক্স-রে৷ পুরো প্রক্রিয়ায় এনেস্থেসিয়ার দরকার৷ তাই এনেস্থেসিস্টের পর্যালোচনার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষাও করিয়ে নিতে হবে৷

পদ্ধতিটা কেমন?

রোগীর গলা দিয়ে পার্শ্ব দূরবীণ যুক্ত এন্ডোস্কোপ প্রবেশ করানো হয়৷ সেটা গলা, খাদ্যনালী, পাকস্থলী হয়ে পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্তের মধ্যবর্তী পর্যায় (ডিয়োডেনামে) পৌঁছুবে৷ সেখানে পেপুলা থাকে যেটাকে পিত্তনালীর মুখও বলা হয়৷ সেখানে পৌঁছে মূলত একটি ক্যাথিটার অথবা পেপিলোটোম পাস করানো হয়৷ তারপরে একটি গাইড ওয়ার পাস করানো হয় যাতে বাইল ডাক্টে যাওয়া যায়৷ বাইল ডাক্টে গেলে একটা ওষুধ পাম্প করা হয় যেটাকে কনট্রাস্ট বলে৷ এই কনট্রাস্টের মাধ্যমে পিত্তনালীর এক্স-রে নেয়া হয়, এই এক্স-রে’র মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায় পিত্তনালীতে কোনও বাধা বা পাথর আছে কিনা৷ কোথাও সরু হয়ে গেছে কিনা বা টিউমার আছে কিনা৷ পিত্তনালীর মুখ হালকা কেটে চওড়া করতে হয়৷ তারপর পিত্তনালীর ভেতরে কোনও স্টোন থাকলে তা আলাদা করে নেয়া হয়৷ বেলুন অথবা ডোরমিয়া বাস্কেট দ্বারা পিত্তনালী পরিস্কার করা হয়৷ যদি সেখানে কোনও বাধা থাকে, বা ভেতরে ফোলা থাকে তাহলে স্টেন্টের মাধ্যমে রাস্তা খুলতে পারি৷ ছিদ্র হলেও স্টেন্ট স্থাপন করে পিত্তরসের বাইএর বেরিয়ে যাওয়া আটকানো যায়৷ তারপর দূরবীন ফেরত চলে আসে৷ প্রক্রিয়াটা সবে ২০ - ৩০ মিনিটের৷ কিছু জটিল ক্ষেত্রে ঘন্টা খানেক সময় লাগতে পারে৷ এনেস্থেসিয়া দেড় থেকে দুই ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে৷ ৫-৬ ঘন্টা হাসপাতালে থাকতে হয় পর্যবেক্ষণের জন্য৷ বিশেষ ক্ষেত্রে একদিনের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়৷

ই আর সি পি’র পর কেমন মনে হবে?

এক থেকে দেড় ঘন্টা লেগে যায় পুরোপুরি অজ্ঞান অবস্থা থেকে বের হতে৷ তারপরও স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লাগতে পারে৷ ডিওডেনাম ফুলিয়ে রাখতে পেটের বাতাস ভরা হয়, সেজন্য প্রক্রিয়ায় কিছু সময় পরেও পেটে চাপ অনুভব হতে পারে৷ কাটা জায়গা থেকে কিছু সংখক রোগীর রক্তপাত হতে পারে৷ খানিক ব্যাথা হবে ৪-৬ ঘন্টা৷ এসব কারণেই রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়৷

Tripurainfo-ERCP-A-fancy-process-Dr-Amitabh-Roy-Stomach-and-liver-disease-specialist-2.png

ঝুঁকি কেমন?

সব অপারেশনে হালকা ঝুঁকি থাকেই৷ ই আর সি পি একটি সার্জিক্যাল প্রসিজিউর৷ পিত্তনালীর মুখে কাটা, স্টেন্ট বসানো, এসবে কিঞ্চিত জটিলতা আছে৷ ১ থেকে ৩ শতাংশ কমপ্লিকেশন রেট আছে, যা যে কোন প্রসিডিউর-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷ কিছু রোগীর পেনক্রিয়াটাইটিস হতে পারে৷ অগ্ণাশয় ফুলতে বা ব্যাথা হতে পারে৷ কনস্ট্রাস্ট ব্যবহার করায় ইনফেকশন হতে পারে যেটাকে কনোলজাইটিস বলা হয়৷ সচরাচর এই ধরনের সমস্যা হয় না৷

সত্যিই হেলথ হাব হবে ত্রিপুরা?

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুযোগ গ্রহণের কেন্দ্রে পরিণত হলে অবশ্যই হেলথ হাব হতে পারবে ত্রিপুরা৷ এই লক্ষ্যে রাজ্য ধীরে ধীরে আগুয়ান৷ উন্নত পরিষেবা আসছে৷ ই আর সি পি’র সুবিধা সম্প্রসারণ সেক্ষেত্রে একটা পদক্ষেপ ধরাই যেতে পারে৷ আমরা পারি, আমাদের এখনেই সম্ভব--- এই বোধ আমাদের মধ্যে জাড়িত হচ্ছে কিনা? কোনও সংকীর্ণতা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠছে কিনা? আমাদের সুচেতনা এসব প্রশ্ণের ইতিবাচক উত্তর দিয়ে বলুক--- অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যকে ‘‘হেলথ হাব’’ হিসাবে গড়ে তুলতে আমরা সবাই হবো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.