বিবর্ণ টাইমলাইন

দেবারতি দত্ত

ফেসবুক নামক বন্ধুটাকে বহুবার ভেবেছি ছেড়ে যাবো। ভাবতে ভাবতে, ভাবনার বয়সও বেড়ে পাঁচ মাস। আজও পারিনি তাকে ডিএক্টিভেট করতে। বলতে পারো মনের ভেতর থেকে পারিনি ছেড়ে দিতে। হয়তোবা সাময়িক রাগ, অভিমান, দুঃখ থেকে ভাবনাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। যতবারই তাকে ডিএক্টিভেট করতে চেয়েছি, ভেতর থেকে চাপা গলায় কেউ বলে উঠলো 'পারবে ভুলতে? পারবে ছাড়তে?' নিজের অজান্তেই আঙ্গুল সরে এলো। পারল না পৃথা কিছুতেই পারল না। এই ফেসবুকেই তো প্রথমবার আলাপ হয় রনজয়ের সাথে পৃথার। ব্যক্তিগত ভাবে কেউই কাউকে চিনত না। পৃথার কাছে তা আজও অধরা। পৃথা অনেকবার তাদের বন্ধুত্বের কারণ জানতে চেয়েছে। ততোবারই রনজয় বলেছে, "সম্পর্ক সবসময় কারণ দিয়ে হয়না মাঝে মাঝে খুঁজে নিতে হয় নিজেদের অজান্তেই"। পৃথা ও ভেবেছিলো ফেসবুক তো উন্মুক্ত, হতেই পারে কোনো-না-কোনোভাবে খুঁজে পেয়েছে। হয়তোবা হওয়ার কথা ছিল এমনটাই। সম্পর্কগুলো চেনা অচেনার বেড়াজাল থেকে সহস্ত্র যোজন দূরে। অনুভূতিগুলো যখন একটু একটু করে তার পরিবর্তন ঘটায়, তখন বুঝে নিতেই হবে সম্পর্কের সংযোগ ঘটছে। তাদের দেখা তেমনভাবে হতো না। দিনের অর্ধেক সময়ই কেটে যেত অফিসে। মাঝে মাঝে অফিস ফিরতি পথে রনজয় কল করতো পৃথাকে। আবার রাতে কিছুক্ষণ হোয়াটসঅ্যাপে ভাবনার আদান-প্রদান ঘটতো। সম্পর্কটা বড়ই সজীব ছিল তাদের, হয়তোবা তার জন্যেই ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের ডালপালা গুলো আজও কুঁড়ি মেলে ছ মাস পরেও। রনজয় খুব গার্ডেনিং ভালোবাসোতো, নতুন নতুন ফুলের চারা কিনে আনতো, তার সাথে বাহারি রঙিন টব। রোজ সকালে নিয়ম করে ফুলের অথবা ব্যালকনির ছবি তুলে, পৃথাকে

গুডমর্নিং মেসেজ পাঠাতো। এভাবেই তাদের সম্পর্কটা এগিয়ে গেল নিত্যদিনের মোবাইলে ছবির আদান-প্রদানে। পৃথা এভাবেই একটু একটু করে রনজয়কে চিনতে পেরেছিল।রনজয় নিজের কাজের কথা, ঘরের কথা, ইচ্ছের কথা কোনটাই পৃথার থেকে এড়িয়ে যায়নি। তাই পৃথার রনজয় এর সাথে দেখা না হলেও অতটা কষ্ট হত না। সবথেকে বড় ভালোলাগার দিকটা ছিল তাদের গানের পছন্দের হুবহু মিল। রনজয়ের গানের সিলেকশন পৃথার খুব হৃদয়ের কাছাকাছি। সম্পর্কের ছ' মাস পর রনজয় একদিন বলল "তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। পৃথা ভেবেই পেল না কি বলবে। রনজয় বলল, আমি অফিস থেকে তোমার এখানে আসছি জাস্ট পনেরো মিনিটের জন্য। তোমাকে দেখেই চলে যাব। পৃথা মনে মনে ভাবল, রনজয় পনেরো মিনিটের জন্য শুধু তাকে দেখতে এতটা দূর আসবে? এই অল্প সময়ের মধ্যে পৃথা নিজেকে তৈরি করে নিল। প্রথম দেখা বলে কথা। একটা হাল্কা আকাশী রঙের সালোয়ার স্যুট পরল। চুলটা খুলে দিল। হালকা একটু কাজল ব্যাস হয়ে গেল পৃথার সাজ। ঠিক ছটায় রনজয় কল করে বলল, "তোমার বাড়ির সামনে, একটু নিচে এসে গেইটে দাঁড়াও।" পৃথা দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। গেইট খুলে সামনেই দেখতে পেল রনজয়ের ছাই রঙের গ্রান্ড আইটুয়েন্টি। গাড়িটা পার্ক করে সোজা পৃথার হাত ধরে উপরে উঠে গেল। ঘরে ঢুকে পৃথার বাবা মায়ের সাথে কথা বলল কিছুক্ষণ। পৃথা তার বাবা-মাকে সম্পর্কের শুরুতেই সবটা জানিয়ে দিয়েছিল। তাই তাদেরো কোন আপত্তি ছিল না।রনজয় অপলক দৃষ্টিতে পৃথার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তাকে বড় একটা ডাইরি মিল্ক সিল্কের চকলেট দিল। পৃথা লাজুক মুখে তার থেকে উপহারটা নিল। এদিক-সেদিক কথা বলতে বলতে, কখন যে পনেরো মিনিট থেকে এক ঘন্টা হয়ে গেল কেউই টের পেল না। সেদিনই রনজয় যাওয়ার সময় বলে গেল এর মধ্যেই ওরা একটা লং ড্রাইভে বেরোবে। পৃথার আনন্দের আর সীমা রইল না। তার দিন গোনা শুরু হয়ে গেল। রাতে তাকে আজকের সন্ধ্যার অনুভূতির কথা জানাল রনজয়। পৃথা তার স্বপ্নের জ্বাল খুব নিপুণ হাতে বুনতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে সেই সন্ধিক্ষণ চলে এলো। আজ রনজয় পৃথাকে লং ড্রাইভ এ নিয়ে যাবে। সকাল থেকেই পৃথার মনে চিন্তার কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল। কি জানি রনজয় অফিসে হাফ্ ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে কিনা? তাদের বেড়াতে যাওয়া হবে কিনা? সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রনজয় পৃথাকে বলল আমি আসছি তোমাকে পিকআপ করতে। যথারীতি পৃথা রণজয়ের পছন্দ অনুযায়ী আজ সেজেছে। রণজয় পৃথার থেকে চোখ ফেরাতেই পারছিলনা। অপরূপা লাগছিল গোলাপী শাড়িতে। দুচোখে কাজল, হাল্কা লিপস্টিক, ছোট্ট টিপ আর খোলা চুলে, পৃথা যেনো মোহময়ী নারী। গাড়ি চলতে শুরু করলো সবুজ ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায়, আঁকাবাঁকা পথে হালকা সুরের আমেজে পৃথাকে রনজয়ের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসছিল। রনজয় পৃথার থেকে অনুমতি চাইলো তার হাত টা আলতো করে ধরার। পৃথা আশ্রয় খুঁজে পেলো রণজয়ের বুকে। কথায় আর গানে কখন যে সময় কেটে গেলো বুঝেই উঠতে পারলনা। হটাৎ ঘোর ভাঙলো পৃথার মায়ের ফোনে। পৃথা মাকে আশ্বস্থ করলো এখনই ফিরবে পৃথা। রনজয়ের গাড়ি এসে থামলো পৃথার বাড়ির গেইটে। খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে এই আশ্বস্ত করলো রনজয়। সারারাত পৃথা আর রনজয় পুরো বিকেলের অনুভূতিগুলোর রোমন্থন করলো। পরের দিন ফোনে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে দুজনেরই। পৃথা একা বসে বসে চিন্তা করলো এই সময়েও কি এমন প্রেম হয়? যেখানে আছে শুধুই অনুভূতি, কবিতা, গান আর অনেক ছবি। কোনো শরীরী মোহ ছিলনা। শুধুই কথার মায়াজালে আটকে ছিল দুজনেই।

পৃথার ফেসবুকের টাইমলাইন জুড়ে রনজয়ের ফটোগ্রাফি। হঠাৎ একদিন তাদের প্রথম পরিচয়ের সূত্রটা ব্লকলিস্টে চলে গেল। পৃথা চেষ্টা করেছে অনেকবার রনজয়ের সাথে যোগাযোগ করার। যতবারই কন্ট্যাক্ট করার কথা ভেবেছে ততোবারই নিরাশ হয়েছে। রনজয় ধীরে ধীরে সব কিছুর থেকে পৃথাকে ব্লক করে দিয়েছিলো। আজও সম্পর্কের টাইমলাইনে কোন নতুন ছবি সেট করতে পারেনি পৃথা। একদিন পৃথা ফেসবুকের নিউজ ফিডে তার লেখা পোস্ট করলো। তাতে লিখেছিলো"আমাদের আয়ুষ্কাল খুব স্বল্প দিনের, হয়তোবা আবার ব্লক লিস্ট খুলে দিতে পারবো, আনফ্রেন্ড থেকে নতুনভাবে ফ্রেন্ডলিস্টেও জায়গা দিতে পারব। হয়তো আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরোও নতুন নতুন পালক জুড়বে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। কিন্তু আফসোসটা তো থেকেই যাবে। পুরনো ফেলে আসা দিনগুলো, সম্পর্কগুলো আর কখনো নতুনভাবে আমাদের কাছে ধরা দেবে না। তখন ইচ্ছে করলেও ফিরে যেতে পারবো না সেই পুরনো ফেসবুকের টাইমলাইনে। এমনও তো হতে পারে, ফেসবুক নামক বন্ধুটার ইতি ঘটবে কোন একদিন। তখন শুধু বেঁচে থাকবে আমাদের মনের টাইমলাইন। তাতে সেট থাকবে শুধু সাদা কালো স্মৃতিরা।"

পৃথার এখনো বিশ্বাস কোন একদিন রনজয় তাকে আনব্লক করবেই। তাই আজও রোজ নিয়ম করে একবার অন্তত ফেসবুকের আইকনে আঙ্গুল চালায়। হয়তোবা এভাবেই ভাঙ্গার সম্পর্কের সাথে আজও সংযোগ স্থাপন করে চলেছে পৃথা।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
16.03.2022Supriyaস্মৃতিতে বেঁচে থাকুক না বলা ভালোবাসা গুলি❤️❤️
15.03.2022Akashdeep RakshitExcellent work..
15.03.2022B.Duttaভিন্ন স্বাদের গল্প। ভালো লাগলো পড়ে।
15.03.2022Bharati RakshitWell written n very realistic concept
15.03.2022Bharati RakshitWell written n very realistic concept