ঐতিহ্যের সাথি পূর্বোত্তরের হাতি

পান্নালাল রায়

সম্প্রতি ত্রিপুরার অমরপুরে 'গজরাজ উৎসব' নামে এক অভিনব উৎসব উদযাপনের খবর পাওয়া গেছে।বন ও জৈব বৈচিত্র্য সুরক্ষা বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বন বিভাগের উদ্যোগে এই উৎসবের আয়োজন হয়েছিল।এই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে অমরপুর শহরে সুসজ্জিত হাতি নিয়ে ছাত্রছাত্রী সহ সর্বস্তরের মানুষের এক বর্ণাঢ্য মিছিল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বনাঞ্চল ধ্বংস সহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী আজ বিলুপ্তির পথে। আবার মাঝে মাঝে বন্য প্রাণী আর মানুষের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ত্রিপুরা সহ পূর্বোত্তরের বিভিন্ন স্থানে বন্য হাতির তান্ডব এবং তা প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ মাঝে মাঝে সংবাদ শিরোনামে আসে। নানা এলাকায় হাতি-মানুষের সংঘাত কোনো কোনো সময় অনিবার্য হয়ে উঠে। ত্রিপুরার ইতিহাস পর্যালোচনায় যেমন বারংবার হাতির প্রসঙ্গ আসবে তেমনই ব্যাতিক্রম নয় পূর্বোত্তরের অন্য রাজ্যও।

এক সময় ত্রিপুরার মূল্যবান অরণ্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো হাতি।সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজলের মতে সম্রাটের পিলখানার উৎকৃষ্ট হাতি ছিল ত্রিপুরার। আবার এই হাতির জন্যই মোগলদের হাতে ত্রিপুরা আক্রান্ত হয়েছে। এমনকি মোগলদের আগেও বাংলার মুসলমান শাসকরা উৎকৃষ্ট হাতির লোভে ত্রিপুরা আক্রমণ করেছে। ত্রিপুরার রাজাদের মাণিক্য উপাধি ধারণের সঙ্গেও হাতির এক ক্ষীণ যোগসূত্র রয়েছে বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর সুবিখ্যাত গ্ৰন্হ " রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস"-এ উল্লেখ করেছেন ত্রিপুরার রাজা রত্ন ফা গৌড়ের সুলতান মালিক তুগ্ৰলকে একটি মহামূল্যবান মণি ও একশ হাতি উপঢৌকন দিয়েছিলেন।গৌড়েশ্বর তখন ত্রিপুরার রাজাকে মাণিক্য উপাধি দেন। সেই থেকেই ত্রিপুরার রাজারা 'ফা' থেকে হলেন মাণিক্য। অবশ্য এব্যাপারে ভিন্ন মতও আছে।কেউ বলেছেন,'মাণিক্য' উপাধি আগে থেকেই ছিল। এদিকে স্টুয়ার্ট তাঁর 'হিস্ট্রি অব বেঙ্গল'-এ উল্লেখ করেছেন ত্রিপুরার রাজাকে পরাস্ত করে সুলতান অনেক ধনসম্পদ সহ একশ হাতি লুণ্ঠন করে নিয়ে যান ত্রিপুরা থেকে।আবার ত্রিপুরার সিংহাসনে রাজা বদলও ঘটেছে হাতির কারণে।প্রাসাদ ষড়যন্ত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে অরণ্যের এই আপাত নিরীহ প্রাণীটি।কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্য তাঁর সিংহাসন সুনিশ্চিত করার জন্য মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে হাতি উপহার দিয়েছিলেন। আবার এই রাজাই হাতির বিনিময়ে তাঁর রাজ্যে লবণ আমদানি করেছিলেন।সব মিলিয়ে ত্রিপুরার ইতিহাসকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করেছে হাতি।

ত্রিপুরার মতো অসমেও অনেক সময় হাতির তান্ডবের ঘটনা ঘটে। ঘটে মানুষের জীবন ও সম্পদ হানি। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে এই বন্য প্রাণীর সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। প্রতিবছরই হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে কিছু মানুষের মৃত্যু ঘটে। আবার মানুষের আক্রমণে হাতির মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়।বেশ কয়েক বছর আগে অসমের শোণিতপুর জেলার গ্ৰামবাসীরা ১৭টি হাতিকে মেরে ফেলেছিল।এ ধরনের সংঘাত এড়াতে একসময় অসমের কাজিরাঙ্গায় শুরু হয় অভিনব হস্তী উৎসব। হাতিদের মধ্যে নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সহ মানুষ ও হাতির সহাবস্থান প্রসঙ্গে আলোচনা ইত্যাদি নিয়ে শুরু হয়েছিল এ ধরনের উৎসব। শুধু অসম কেন, দেশের অন্য এলাকা থেকেও মাঝে মাঝে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে হাতি।

ক'বছর আগে কেরালায় এক গর্ভবতী হস্তিনীর মৃত্যুর ঘটনা ঝড় তুলেছিল সামাজিক মাধ্যমে।

যাই হোক, ত্রিপুরার মতো অসমেরও ঐতিহ্যের সাথী হচ্ছে হাতি। মহাভারতের যুগ থেকেই বহমান এই ঐতিহ্য ।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্তের হাতি ত্রাসের সঞ্চার করেছিল পাণ্ডব সেনাদের মধ্যে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ্ তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে অসমের সমৃদ্ধ হাতির কথা উল্লেখ করে গেছেন। মণিপুরের ইতিহাসেও অনুল্লেখ্য নয় হাতি। রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্রের রাজ্য ফিরে পাবার ঘটনার সঙ্গেও যেন জড়িয়ে আছে হাতি।ত্রিপুরা থেকে হাতি সংগ্ৰহের কথাও রয়েছে মণিপুরের ইতিহাসে।ডিমাছা রাজসভার কবি ভুবনেশ্বর বাচস্পতি তাঁর অমর কাব্য 'শ্রী নারদি রসামৃত' রচনার পর রাজার কাছে চেয়েছিলেন হাতি। কিন্ত রাজগুরুর চক্রান্তে রাজা কবিকে কিছু নগদ অর্থ দিয়েই বিদায় করতে চাইলেন। অবশ্য অভিমানী কবি তা প্রত্যাখ্যান করে ডিমাছা রাজ্য ছাড়লেন রিক্ত হস্তে। উল্লেখ করা যায় যে,'শ্রী নারদি রসামৃত' ডিমাছা রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত সর্ব শ্রেষ্ঠ কাব্য।ডিমাছা রাজসভার কবি ভুবনেশ্বর বাচষ্পতি সম্পর্কেও আছে এক চমকপ্রদ উপাখ্যান। একদা ডিমাছা রাজ্যে নরবলির প্রচলন ছিল।দুর্গা পূজার আগে রাজার লোকেরা বলির জন্য মানুষ ধরে আনতো। সেভাবেই ধরে আনা হয়েছিল ব্রাক্ষ্ণণ পন্ডিত বাচস্পতিকে।রাজার লোকেরা তার উপবীত ছিঁড়ে ফেলে আটকে রেখেছিল চন্ডী মন্ডপের পাশে। একদিন রাজা সুরদর্প নারায়ণ ভাগবত পাঠ শুনছিলেন সেখানে বসে। কিন্তু পাঠ শুদ্ধ না হওয়ায় বলির বন্দী মুখে কথা না বলে অন্য রকম শব্দ করছিল।রাজার নজরে পড়ে তা। বন্দী ব্রাক্ষ্ণণ তখন আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বলেন তার উপবীত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। তিনি কথা বলতে পারবেন না।রাজার নির্দেশে তাঁকে উপবীত ফিরিয়ে দেয়া হয়।ব্রাক্ষ্মণের মুখে শ্লোক শুনে রাজা বুঝতে পারেন তিনি মহা পন্ডিত।এরপর ডিমাছা রাজসভার কবি হিসেবে নিযুক্ত হন বাচস্পতি। রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা দেবীর আদেশে রচনা করেন 'শ্রীনারদি রসামৃত'।আর অজান্তে ব্রাক্ষ্মণ হত্যার মতো মহাপাপ এড়াত ডিমাছা রাজ্যে নরবলির প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।

সুপ্রাচীন কাল থেকেই হাতি এক বিরাট অরণ্য সম্পদ। এমনকি রাজা-বাদশা জমিদারের সম্পদের মাপ কাঠি হিসেবেও অনেক সময় বিবেচিত হতো হাতি। ত্রিপুরার হাতির প্রতি মোগলদেরও লোভ ছিল।সমতল ত্রিপুরা অধিকারের পর রাজস্ব হিসেবে হাতি নেয়া হতো। ত্রিপুরার রাজার কাছে হাতি সম্পদ এবং কিছুটা আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো।আগে ত্রিপুরায় বন্য হাতি ধরে এনে পোষা হাতির সাহায্যে তাদের পোষ মানানো ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।রাজ সরকারের রাজস্ব আয়ের উৎস ছিল হাতি।বন থেকে হাতি ধরার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের হাতি ধরার 'দোয়াল' ইজারা দেয়া হতো। এতে রাজভান্ডারে ভালো রাজস্ব আসতো। এ ছাড়া হাতির দাঁত থেকেও রাজ সরকারের আয় হতো। মহারাজা রাধাকিশোরের রাজত্বকালে সরকারি আদেশনামায় বলা হয়েছিল-' হস্তীদন্ত রাজস্ব সংক্রান্ত আয়ের অন্যতম প্রশস্ত উপায়।'

একদা ত্রিপুরার অরণ্যে বিপুল সংখ্যায় হাতি ছিল।আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী'তে উল্লেখ করেছেন যে, ত্রিপুরার রাজা বিজয় মাণিক্যের (১৫৩২-৬৩খ্রীঃ) এক হাজার হাতি ছিল। এখন অবশ্য ত্রিপুরার এই অরণ্য সম্পদ আর নেই।বহু আগেই তা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন রাজ্যের অরণ্যাঞ্চলে বন্য হাতির সংখ্যা হাতে গোনা। আর কিছু আছে পোষা হাতি। শুধু ত্রিপুরা কেন, গোটা পূর্বোত্তরের জঙ্গলেই দ্রুত কমছে হাতির সংখ্যা। তাই একদিকে যেমন বন্য হাতিকে রক্ষা করতে হবে, তাদের খাদ্যের সংস্হান সহ চলাচলের করিডর রাখতে হবে, তেমনই লোকালয়ে বন্য হাতির তান্ডব প্রতিরোধ করতে হবে।যাতে হাতির দল খাদ্যের অন্বেষণে জনপদে এসে হামলা না চালায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে।সব মিলিয়ে হাতির সংরক্ষণের পাশাপাশি মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষার জন্য উদ্যোগ চাই। এবার দেখা যাক কিভাবে তার কতটা কার্যকরী হয়!

ত্রিপুরার অমরপুরে ছোট পরিসরে যে গজরাজ উৎসব হয়েছে তার আহ্বান মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে অন্যান্য অঞ্চলেও এধরনের উৎসব উদযাপনের প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে কাজিরাঙ্গা উৎসবের কথা আগেই বলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে বন ও বন্যপ্রাণী না থাকলে একদিন মানুষও হারিয়ে যাবে।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.